সানজিদা ব্যাট হাতে ফটোশুট করবেন নাকি ঝাড়ু হাতে করবেন, সেটা ঠিক করে দেয়ার আপনি কে? আইসিসি বা ক্রিকইনফোর পোস্টে বিদেশীরাও যখন সানজিদাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, তখন এদেশীয় কিছু বরাহ শাবক মেতেছে নোংরামিতে...

জাতীয় প্রমীলা দলের ক্রিকেটার সানজিদা ইসলাম বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন। বর মীম মোসাদ্দেকও ক্রিকেট খেলেন। বাংলাদেশের হয়ে ৫৪টি ওয়ানডে এবং ১৬টি টি-২০ ম্যাচ খেলা সানজিদা গায়ে হলুদের ফটোসেশনের জন্য বেরিয়েছিলেন, গিয়েছিলেন রংপুর বিভাগীয় স্টেডিয়ামে। সেখানে গিয়ে দেখলেন ছোট ছেলেরা দলবেঁধে ক্রিকেট খেলছে। চোখের সামনে ব্যাটবল দেখেই কিনা নেশা ধরে গেল সানজিদার, তিনিও হাতে তুলে নিলেন ব্যাট, কয়েকটা বলের মোকাবেলাও করলেন। সেই মুহূর্তগুলো ক্যামেরায় বন্দী হলো, সানজিদা সেগুলো ফেসবুকে শেয়ার করতেই ভাইরালও হয়ে গেল মুহূর্তেই। অথচ এভাবে ছবি তোলার কোন পরিকল্পনাই ছিল না এই ক্রিকেটারের। 

আইসিসির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে সানজিদার এই ছবিগুলো শেয়ার দেয়া হয়েছে, তাকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। ক্রিকেট বিষয়ক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোও ছবিগুলো শেয়ার দিয়েছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একজন ক্রিকেটের নিজের ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে ক্রিকেট ব্যাট হাতে পোজ দিয়েছেন, এটা তাদের চোখে দারুণ একটা বিষয়। আইসিসির পেজ এবং ক্রিকইনফোর পোস্ট- দুই জায়গাতেই কমেন্টবক্স চেক করলাম, যেখানে ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীদের সাথে আমাদের নিত্য সাইবার যুদ্ধ লেগে থাকে, সেই ভারতীয় বা পাকিস্তানী নাগরিকেরাও সানজিদাকে নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানিয়েছে। কেউ তাকে ধর্মের বাণী শোনায়নি, কেউ বলেনি যে সানজিদা 'ভাইরাল' হবার বাসনায় এভাবে ফটোশুট করেছেন। 

অথচ প্রথম আলোতে প্রকাশিত সানজিদার বিয়ের খবরের কমেন্টবক্সে যান। দেখবেন, সেখানে নোংরামির আসর বসিয়েছে একদল লোক, সবাই বাংলাদেশী। যা তা ভাবে ব্যক্তি আক্রমণ করা হচ্ছে নববিবাহিতা এই তরুণীকে। আট বছরের বেশি সময় ধরে সানজিদা বাংলাদেশের জার্সি পরে খেলছেন, দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এই ব্যাট হাতে অজস্রবার তিনি দাঁড়িয়েছেন, বিয়ের পোশাকে ব্যাট হাতে দাঁড়ানোটা এখন অপরাধ হয়ে গেল? নাকি তিনি নারী বলেই এই আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে? সাকিব আল হাসান ব্যাট হাতে নিজের ওয়েডিং ফটোশুটে অংশ নিলে নিশ্চয়ই তিনি এমন নোংরা আক্রমণের শিকার হতেন না। সানজিদা ব্যাট হাতে ফটোসেশন করবেন নাকি ঝাড়ু হাতে করবেন, সেটা ঠিক করে দেয়ার আপনি কে?

ব্যাট হাতে এভাবেই ক্যামেরাবন্দী হয়েছেন সানজিদা

সানজিদা যে নিজের দেশের কিছু লোকের হাতেই এভাবে জঘন্য আক্রমণের শিকার হয়েছেন, তাতে খুব বেশি অবাক হইনি। নারীর খেলাধুলা করাটা এদেশের কোটি কোটি মানুষের চোখে অপরাধের শামিল, যে মেয়ে মাঠে গিয়ে ক্রিকেট-ফুটবল খেলে সে তো চরিত্রহীনা, তাকে যা খুশি বলা যায়- এই হচ্ছে ধর্মান্ধদের মাইন্ডসেট। সানজিদার এই ছবি তাদের জায়গামতো আঘাত করেছে। আর যারা এই ছবির পেছনে 'ভাইরাল হবার বাসনা' খুঁজে পাচ্ছেন, তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন- বিয়ে সানজিদার, ছবি সানজিদার, ভাইরাল হবার ইচ্ছা থাকলে সেটাও সানজিদার, তাতে আপনার সমস্যা কোথায়? তিনি তো  আপনার বা আমার টাকায় বিয়ে করছেন না, কারো ক্ষতি করছেন না, তার ছবিগুলোও কারো বিপদের কারন হচ্ছে না। সানজিদা তো 'অসম্ভবকে সম্ভব করা বাংলা সিনেমার কোন কমেডিয়ান নায়ক' নন যে তাকে ভাইরাল হওয়ার জন্য এটাসেটা করে বেড়াতে হবে। 

আমাদের জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশের যে কমনসেন্স বলে কিছু নেই, সেটার প্রমাণ পাবার জন্য বেশি ঘোরাঘুরি করতে হয় না, নিউজ বা মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর ফেসবুক পেজের কমেন্টবক্সে চোখ রাখলেই হয়। গায়িকা-অভিনেত্রী মিথিলা কাকে বিয়ে করলেন, যশোরের জনৈক তরুণী কেন মোটরসাইকেলে করে গায়ে হলুদের ছবি তুললেন, কিংবা একজন নারী কেন বোরকা পরে ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেললেন- সব ইস্যুতেই বিচ্ছিরিভাবে ব্যক্তি আক্রমণ করার জন্য একটা দল মুখিয়ে থাকে। 

মাঝেমধ্যে ভেবে অবাক লাগে, আমাদের কি বিনোদনের এতই অভাব পড়েছে যে কেউ নিজের বিয়ের ছবি আপলোড দিলে সেখানে গিয়েও নোংরা বিনোদন খুঁজতে হবে? নিজেদের বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়ে আসতে হবে? কি অদ্ভুত আর বিচিত্র মানসিকতা নিয়ে বিচরণ করছি আমরা! এটা তো মজা করার মতো কিছু নয়, এটা স্পষ্টতই মানসিক বিকারগ্রস্থ আচরণ৷ সমস্যাটা সেলিব্রেটিদের মধ্যে না। সমস্যাটা আসলে আমাদের নিজেদের। পাবলিক ফিগার আর পাবলিক প্রোপার্টি যে এক নয়, এই সহজ জিনিসটাই অনেকের মাথায় ঢোকে না।

সানজীদার এই ছবি শেয়ার করা হয়েছে আইসিসির অফিসিয়াল পেইজে

আমাদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা সুস্থ স্বাভাবিক আচরণ করতে জানে না৷ হয়তো করতে চায়ও না৷ নিজের বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করার জন্যেই হোক, কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক, তারা নোংরামির পথটা বেছে নেয়৷ সেজন্যেই আমরা সাকিব-মাশরাফিদের পোস্টে গিয়ে গালির বহর বইয়ে দেই, লিটন-সৌম্যদের ছবিতে গালিগালাজ করে আসি, সৃজিত-মিথিলা বা শমী কায়সারের বিয়ের ছবিতে আজেবাজে কমেন্ট করে আমাদের নোংরা মানসিকতার স্বাক্ষর রাখি, ক্রিকেটার সানজিদার নতুন জীবনের শুরুতে তাকে ভালোবাসা জানানোর পরিবর্তে কটুকথা শোনাই। আপনারা কাউকে ভালোবাসা উপহার দিতে না পারেন, শুভেচ্ছা জানাতে না পারেন, সমস্যা নেই। নিজেদের নোংরা মুখ আর মানসিকতাটা তো বন্ধ রাখতে পারেন, দয়া করে সেটাই করুন না প্লিজ!

আমরা ভেবে নেই, সেলিব্রেটিদের সঙ্গে বুঝি এমনই আচরণ করতে হয়! তাদের গালিগালাজ করলে, তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নোংরা কথা বললে হয়তো কিছুই হয় না৷ আসলেই কিছু হয় না, কেউ তো এসে বাজে কমেন্টের জন্যে আপনাকে শাস্তি দিচ্ছে না, গালাগালি করার জন্যে জরিমানা করছে না৷ আর তাই আমাদের কাছে এগুলো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আমরা তো মজা পেলাম কমেন্টটা করে, তাই না? দু-চারশো লাইকও জড়ো করলাম হয়তো। নিজেদের মধ্যেই একটা ‘মুই কি হনুরে’ টাইপের ভাব চলে আসে এতে! 

কিন্ত আমরা ভুলে যাই, সেলিব্রেটিরাও মানুষ, তারা অন্ধ নন। এসব মন্তব্যের অল্প কিছুও যদি তাদের চোখে পড়ে, কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যদের চোখে পড়ে, তাহলে তাদের কেমন লাগতে পারে, সেটা আমরা ভাবি না, আমাদের বোধশক্তি অতদূর কাজ করে না, কমনসেন্সের ওয়াইফাই জোন যে বড়ই সীমাবদ্ধ আমাদের! দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একদল লাইফলেস মানুষ এগুলো করে বেড়াচ্ছে, তাও বুক ফুলিয়ে। কোথায় কখন থামতে হয়, নিজেদের নোংরা নাকটা কোথায় গলাতে হয় আর কোথায় হয় না, সেটা আমরা জানি না, বুঝিও না। এই মানসিক বিকৃতির শেষ কোথায় সেটাও আমাদের জানা নেই। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা