বাবা-মেয়ে দুজনই অণুজীববিজ্ঞানী। তাদের নিয়ে লিখেছেন স্বয়ং বিল গেটস! এবার তারা আবিস্কার করেছেন করোনার জিনোম সিকোয়েন্স, প্রতিষেধক আবিস্কারে যা রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা...

বাংলাদেশে নাকি গুণের কদর হয় না। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে না, বরং অনেকাংশে সত্য। আমরা তারকা বা জনপ্রিয় লোকজনকে যতটা মাথায় তুলে রাখি, সেই তুলনায় সত্যিকারের অনেক গুণীরা আড়ালেই থেকে যান। তারা নিজের কাজটা করে চলেন একমনে, বাইরের বিশ্ব ঠিকই তাদের কাজের স্বীকৃতি দেয়, অথচ আমরা খোঁজও রাখি না সেসবের। এমনই দুই গুণী ব্যক্তিত্ব হলেন অণুজীব বিজ্ঞানী ডা. সমীর কুমার সাহা ও ডা. সেঁজুতি সাহা। সম্পর্কে তারা বাবা-মেয়ে, সম্প্রতি করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স উদঘাটন করেছেন তারা। তাদের এই আবিস্কার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটির এদেশে গতি প্রকৃতি নির্ণয় করতে এবং দেশের মানুষের জন্য প্রতিষেধক তৈরিতে সাহায্য করবে।

ডা. সমীর সাহা বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। আর তার মেয়ে ডা. সেঁজুতি সাহা ঢাকা শিশু হাসপাতালে চাইল্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক হিসেবে কর্মরত আছেন। সেঁজুতি সাহার তত্বাবধানে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) আট সদস্যের একটি গবেষক দল জিনোম সিকোয়েন্সের ম্যাপিংয়ের কাজ করেছে। বাবা-মেয়ে যৌথভাবে তাদের এই কৃতিত্বের কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। 

ডা. সেজুঁতি সাহা বলেছেন, "আমরা শুধুমাত্র একটি জিনোম সিকোয়েন্স বের করতে সক্ষম হয়েছি। আগামী সপ্তাহে আরও একটি জিনোম সিকোয়েন্স শেষ হবে। প্রথমবারের মতো করা জিনোম সিকোয়েন্সে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ভাইরাসটির সঙ্গে তাইওয়ান, সুইডেন, শ্রীলঙ্কা ও রাশিয়ার করোনাভাইরাসের সাদৃশ্য রয়েছে। এই ভাইরাসটির এখন পর্যন্ত নয় বার মিউটেশন হয়েছে।"

জিনোম সিকোয়েন্স আবিস্কারের গুরুত্ব যারা বুঝতে পারছেন না, তাদের জন্যে জানিয়ে রাখি- জিনোম সিকোয়েন্স করা এখন রোগের মূল অনুসন্ধানের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। একে বলা হয় ‘জিনোমিক প্রেডিকশন’। একটি ভাইরাস সংক্রমণ যখন জনসংখ্যার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তখন সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষকদের ভাইরাসটির জেনেটিক পরিবর্তনগুলো শনাক্ত করতে সহায়তা করবে। 

সমীর কুমার সাহা ও সেঁজুতি সাহা

বেশ কয়েকজন রোগীর কাছ থেকে সংগৃহীত ভাইরাল জিনোমের জিনগত অনুক্রমের পরিবর্তনগুলো দেশে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে এ রোগের বিস্তারকে পর্যবেক্ষণ করতে সহায়তা করবে। মোদ্দাকথা, ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি, ধরণ, ভয়াবহতা, বৈশিষ্ট্য- এসবকিছু নিরূপণ করে সংক্রমণ রোধ এবং প্রতিষেধক আবিস্কার করা সম্ভব নয়, যদি না সেটার জিনোম সিকোয়েন্স বের করা যায়। ডা. সমীর কুমার সাহা, ডা. সেঁজুতি সাহা এবং তাদের দলের বাকী সদস্যরা মিলে সেই অসামান্য কাজটিই করে ফেলেছেন। 

আজ করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স আবিস্কার হয়েছে বলে বাবা-মেয়ের নাম সবাই জানছে, পত্রপত্রিকায় তাদের হাসিমুখের ছবি ছাপা হচ্ছে। অথচ তারা কিন্ত দেশের জন্য, মানবকল্যানের জন্য অনেক আগে থেকেই অবদান রেখে যাচ্ছেন, নিভৃতে নিজেদের কাজ করে চলেছেন। স্বয়ং বিল গেটস তার গেটস নোটে সমীর সাহা এবং সেঁজুতি সাহাকে নিয়ে প্রশংসা করে লিখেছেন, সেখানে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ এসে কমেন্ট করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বাবা-মেয়েকে। এসব কি আমরা জানতাম? এগুলো কি আমাদের মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করেছিল? (এগিয়ে চলো করেছিল, সেকারণেই বুক ফুলিয়ে প্রশ্নটা করতে পারছি।) 

অণুজীববিজ্ঞানী সমীর সাহা কয়েক দশক ধরে গবেষণা করছেন শিশুদের প্রাণসংহারী রোগের জীবাণু নিয়ে। সম্প্রতি দারুণ এক স্বীকৃতি পেয়েছেন এই বিজ্ঞানী। অণুজীব বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সংগঠন আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজি চলতি বছর পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেছে সমীর সাহাকে। ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে গবেষণার জন্য এই পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৭৮ সাল থেকে দেওয়া হচ্ছে এ পুরস্কার। তালিকায় চোখ বুলিয়ে এলে আপনি অবাক হয়ে দেখবেন, গত ২৯ বছরে পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে এই উপমহাদেশ তো বটেই, এশিয়ার কোনো দেশের বিজ্ঞানীর নামও নেই! যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডার বাইরে এই পুরস্কার আগে দেওয়া হয়নি। সেখানে ডা. সমীর কুমার সাহার হাতে এবছর উঠতে যাচ্ছে পুরস্কারটা, এটা যে কত বড় গৌরবের, সেটা এদেশের অনেকের ধারণাও নেই। 

পরিবারের সবাই অণুজীববিজ্ঞানী!

২০১৭ সালে বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে মেনিনজাইটিসের সংক্রমণ হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়েছিল। তাৎক্ষনিকভাবে এর কোনো কারণ খুঁজে বের করা যাচ্ছিলো না। তখন ডা. সেঁজুতি সাহা উদ্ভাবন করলেন যে চিকুনগুনিয়ার বিস্তারের কারণেই মেনিনিজাইটিসের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় এবং সে ভাইরাস ছড়ায় মশার মাধ্যমে। বিস্তারিত জানার জন্য সেঁজুতি তার গবেষণার নমুনা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই দরিদ্র দেশসমূহে রোগ নির্ণয়ের জন্য স্বল্পমূল্যের উপকরণে টেস্ট কিট তৈরি করেন সেঁজুতি সাহা। এই গবেষণা শুধু বাংলাদেশই নয়, বরং সাহায্য করেছে দক্ষিণ এশিয়ার মতো দরিদ্র দেশসমূহে।

ব্যবসায়ী চন্দ্রকান্ত সাহা ও গৃহিণী দুলানী প্রভা সাহার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের একজন সমীর সাহা। রাজশাহীর চারঘাট থানার মনমোহনী হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং চাঁদপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছিলেন তিনি। বাবার ব্যবসা না দেখে তিনি বেছে নিয়েছিলেন পড়াশোনা আর গবেষণাকে। সমীর সাহার পরিবারকে চাইলে যে কেউ ‘অণুজীববিজ্ঞানী পরিবার’ বলতে পারেন। মেয়ে সেঁজুতি সাহার কথা তো বলা হলোই, চাইল্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনে গবেষক হিসেবে যোগ দেয়ার আগে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজিতে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। সমীর সাহার স্ত্রী সেতারুননাহার একজন অণুজীববিজ্ঞানী। কিছুদিন আগে তিনি অবসর নিয়েছেন বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে। ছেলে সুদীপ্ত সাহাও টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞান ও গ্লোবাল হেলথ বিষয়ে পড়ছেন। 

স্বল্পোন্নত দেশসমূহে স্বল্প খরচে রোগ নির্ণয়ের সর্বাধুনিক পদ্ধতি ও সেসব রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধে বাবা-মেয়ে যুগলের অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমানে এই দুজন বিশ্বস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নাম। কিছুদিন আগেই বিল গেটস তার ব্লগ 'গেটসনোটস'-এর সিরিজ ‘হিরো অফ দ্যা ফিল্ড’ এ সমীর সাহা এবং সেঁজুতি সাহার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এখন সময়, নিভৃতে থাকা এই মানুষগুলোর অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার, তাদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের। তাহলেই আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীরা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি জমানীর পরও দেশে ফেরার ইচ্ছেটা বুকের ভেতর পুষে রাখবে, অজস্র তরুণ-তরুণী সমীর কুমার সাহা বা সেঁজুতি সাহা হতে চাইবে... 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা