শুধু চিন্তা করছি, এই ভদ্রলোকের জায়গায় যদি কোন নারী পর্যটক থাকতেন, তার সঙ্গে এরা আরও কত জঘণ্য আচরণ করতে পারতো!

গতকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ভিডিও ভেসে বেড়াচ্ছিল। চোখের সামনে কয়েক দফা পড়লেও, শুরুতে কেন যে পাত্তা দেইনি। পরিচিত কয়েকজন শেয়ার দিয়েছে দেখে ভিডিওতে ক্লিক করলাম, ভীনদেশী এক নাগরিক জাহাজে চড়ে সেন্টমার্টিনে যাচ্ছেন, তাকে ঘিরে আছে এদেশীয় কয়েকজন তরুণ, কারো বয়সই বিশ-বাইশের বেশি নয়। ভল্যুম বাড়িয়ে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, প্রচণ্ড আক্রোশ জাগলো মনের ভেতর। 

বিদেশী এক নাগরিক যাচ্ছিলেন সেন্টমার্টিনে, সাদা চামড়া দেখেই হয়তো আমাদের কারো কারো ফাজলামি করার জোশ জেগে উঠেছিল মনের ভেতরে। কিন্ত আমরা তো জানিনা, ফাজলামির লিমিটটা কোথায়, কোন পয়েন্টে গিয়ে থামতে হবে। সেই পর্যটককে অনেকটা হায়েনার পালের মতো ঘিরে ধরেছে এদেশীয় কয়েকজন তরুণ, তারপর হাসিমুখেই তার সঙ্গে দেশী আর ইংরেজীর মিশ্রিত একটা জগাখিচুড়ি ভাষায় কপথা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ছেলেগুলো। ভাষাচয়ন দেখলে যে কেউই স্তম্ভিত হবে, ঘৃণা জানানোর ভাষা খুঁজে পাবেন না সেন্সিবল কোন মানুষই। 

ভিডিওতে কী কথাবার্তা হয়েছে সেসবের বিস্তারিত বর্ণনায় যাওয়ার ধৈর্য্য, রুচি বা ইচ্ছা, কোনটাই নেই। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবহার হওয়া শব্দগুলোর মানে হয়তো ওই পর্যটক ভদ্রলোকও বুঝতে পারেননি, কিন্ত তার চোখেমুখে বিরক্তিভাব ছিল স্পষ্ট, তাকে নিয়ে যে নোংরা একটা গেম খেলা হচ্ছে, সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন। তবুও ভদ্রতার খাতিরে পুরোটা সময় মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছেন তিনি। সেই ভদ্রতার প্রতিদানে তাকে যা উপহার দেয়া হলো, সেটার কি নাম দেয়া যায়, আমাদের তা জানা নেই। 

পর্যটককে হেনস্থাকারী সেই তরুণকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ

কোনটা মজা, আর কোনটা নোংরামি, এটা আমাদের দেশের অনেকেই বুঝতে পারে না। এসব বিবেকবর্জিত অমানুষদের জন্যে লজ্জার মুখে পড়ে পুরো দেশের ভাবমূর্তি। সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সেই জাহাজেও এই ঘটনাটাই ঘটেছে। ভিডিওতে যে ছেলেটা সবচেয়ে বেশি নোংরা কথা বলেছে, তার নাম সালমান, বাড়ি কক্সবাজারের হ্নীলা উপজেলায়। ভিডিওটি অনলাইনে ভাইরাল হবার পর কক্সবাজারের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে, অমানুষটা এখন পুলিশি হেফাজতে আছে। 

এমনিতেই আমাদের দেশে বিদেশী পর্যটক আসার পরিমাণটা কম। নিরাপত্তা একটা বড় ইস্যু, তাছাড়া ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি দেশ হিসেবেও বাংলাদেশের সুনাম নেই কোথাও। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আছে আমাদের দেশে, আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বট ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, তবুও এদেশে বিদেশী পর্যটকের ঢল নামে না। কয়েক কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত দিয়ে এশিয়ার সেরা ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনে পরিণত হয়েছে থাইল্যান্ড, অথচ সোয়াশো কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত থাকার পরেও এর ধারেকাছেও যেতে পারিনি আমরা। 

এরইমধ্যে আছে সালমানের মতো নোংরা মনের অমানুষের দল, যারা ভীনদেশী মানুষ সামনে দেখলে ভাবে এলিয়েনের দেখা পেয়েছে বুঝি! নিজেদের নিকৃষ্ট মানসিকতার পরিচয়টা যারা যেখানে সেখানে দিতে চায়, সেটার আবার ভিডিও ধারণ করে রাখে! অনেকেই সাফাই গাইতে পারেন, ছেলেগুলো তো মজা করছিল, হয়তো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, এটা নিয়ে এত জলঘোলা করার কি আছে। এসব অজুহাত যারা দেখাচ্ছেন, তারা মজা আর হয়রানির পার্থক্যটা জানেন না। বেড়াতে আসা একটা মানুষের সাথে কি আচরণ করতে হবে, এটুকু জ্ঞান যদি পরিণত বয়স্ক একটা মানুষের মধ্যে না থাকে, তার জায়গা জেলখানাতেই হওয়া উচিত, সভ্য সমাজে তার থাকার কোন দরকার নেই।

এদের মানসিকতা, আর বিবেকবোধ এত বেশি জঘন্য, এতটাই নিম্নস্তরের পার্ভাট এরা যে এদের হাত থেকে নারী-শিশুরা তো দূরে থাক, একজন বয়স্ক পুরুষও নিরাপদ নন! একজন বিদেশীর সামনে দেশের মান-মর্যাদা ডোবানোর কথা এদের মাথায় আসেনি। শুধু চিন্তা করছি, এই ভদ্রলোকের জায়গায় যদি কোন নারী পর্যটক থাকতেন, তার সঙ্গে এরা আরও কত জঘণ্য আচরণ করতে পারতো! 

সালমানকে খুব দ্রুত আটক করেছে কক্সবাজার পুলিশ, তাদেরকে ধন্যবাদ। কিন্ত ভিডিওতে এই ছেলের সঙ্গে  আরও কয়েকজন ছিল, যারা অংশ নিয়েছে সেই পর্যটকের সঙ্গে নোংরা আচরণে, ভিডিও ধারণ করেছে, কটু মন্তব্য করেছে, এদের প্রত্যেকটাকে আইনের আওতায় আনা উচিত। মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানোর অধিকার এই অমানুষদের অন্তত নেই...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা