এই বিজয় কাজী সালাউদ্দিনের, বাংলাদেশের ফুটবলের নয়!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
যে সভাপতির আমলে জাতীয় দলের কোন অর্জন নেই, আছে শুধু ব্যর্থতার খেরোখাতা- যোগ্য প্রার্থীর অভাবে তিনি নির্বাচনে জিতলে সেই বিজয়কে কোনোভাবেই 'দেশের ফুটবলের বিজয়' বলার সুযোগ নেই।
যা হবার কথা ছিল সেটাই হলো। বাফুফের নির্বাচনে বেশ বড়সড় ব্যবধানে জিতে আরও একবার সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন কাজী সালাউদ্দিন। ২০০৮ সালে প্রথমবার এই পদে নির্বাচিত হবার পর গত একযুগ টানা দায়িত্ব পালন করছেন তিনি, আরও চার বছরের জন্য দায়িত্ব পেয়েছেন, অর্থাৎ বছরের সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬-তে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এটা বিরল ঘটনা বটে। নির্বাচনে ১৩৯ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১৩৫ জন ভোট দিয়েছেন। সভাপতি পদে সম্মিলিত পরিষদের প্রার্থী কাজী সালাউদ্দিন ভোট পেয়েছেন ৯৪টি। তার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বাদল রায় ৪০টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুল ইসলাম মানিক মাত্র ১টি ভোট পেয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে কাজী সালাউদ্দিন এবং তার গত একযুগের প্রতিশ্রুতি এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল, সালাউদ্দিন আউট হ্যাশট্যাগের বহর বইছিল; তাতে পাত্তা দিতে না চাইলেও এই জয়টা বাফুফে সভাপতির জন্য অক্সিজেন হয়ে এসেছে। সংবিধান অনুযায়ী আরও চার বছর নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালনে কোন বাধা নেই তার। সালাউদ্দিনের আমলনামা নিয়ে যত সমালোচনাই হোক, এই নির্বাচনে এটা অন্তত প্রমাণ হয়ে গেছে যে, সালাউদ্দিনের সমালোচনা করার অজস্র জায়গা থাকলেও, বাফুফে সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার জন্য তার চেয়ে উপযুক্ত এবং সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তি অন্তত এদেশের ফুটবল অঙ্গনে নেই এখন।
আনন্দের আতিশয্যে বিজয় নিশ্চিত হবার পর কাজী সালাউদ্দিন বললেন, এই জয় নাকি তার একার নয়, এই জয় বাংলাদেশের ফুটবলেরও বিজয়! কাজী সালাউদ্দিনকে অভিনন্দন জানিয়েই তার এই বক্তব্যের সঙ্গে কঠোরভাবে দ্বিমত পোষণ করছি। যে সভাপতির আমলে বাংলাদেশ তার ফুটবল ইতিহাসের সর্বনিম্ন র্যাংকিংয়ে পৌঁছে যায়, ভুটানের কাছে হেরে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার যোগ্যতা হারায়, যার আমলে জাতীয় দলের কোন অর্জন নেই, আছে শুধু ব্যর্থতার খেরোখাতা- যোগ্য প্রার্থীর অভাবে তিনি নির্বাচনে জিতলে সেই বিজয়কে কোনোভাবেই 'দেশের ফুটবলের বিজয়' বলার সুযোগ নেই।
বাফুফে সভাপতি হিসেবে কাজী সালাউদ্দিন দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০০৮ সালের ২৮শে এপ্রিল। তখন ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০তম। গত ১২ বছর ধরে তিনিই সভাপতি, এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা- এখন আমাদের অবস্থান ১৮৭-তে! ২০১৮ সালে তো ১৯৭-তেও পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা, যেটা কিনা বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সর্বনিম্ন র্যাংকিং। বয়সভিত্তিক এবং নারী ফুটবল দলগুলো কিছু সাফল্য পেলেও, জাতীয় দলের ক্ষেত্রে গত বারো বছরে বলার মতো কোন অর্জন নেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও, বরং আছে ব্যর্থতা আর ভরাডুবির অজস্র গল্প। ফুটবলার হিসেবে অজস্র অর্জনে সমৃদ্ধ কাজী সালাউদ্দিনের যে ফুটবল প্রশাসক হিসেবে চরমভাবে ব্যর্থ, সেটারই সামান্য একটা নমুনা এটা।
সালাউদ্দিনের ব্যর্থতার গল্পে ভুটানের নামটা উচ্চারিত হবে বারবার। ২০১৬ সালের ১০ই অক্টোবর থিম্পুতে স্বাগতিক ভুটান ৩-১ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশকে। ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশ এপর্যন্ত ১৩ বার মুখোমুখি হয়েছে আন্তর্জাতিক ফুটবলে, ওই একবারই হেরেছে বাংলাদেশ। অনেকেই বলতে পারেন, হারের পেছনে খেলোয়াড়দের দোষ থাকতে পারে, কোচের ভুল ট্যাকটিকস থাকতে পারে- সভাপতির কি দোষ? তাহলে জানিয়ে দিই, ভুটানের বিরুদ্ধে খেলা ১৩ ম্যাচের মধ্যে এক হার এবং দুই ড্রয়ের সবগুলোই এসেছে সালাউদ্দিনের আমলে। গতবছর অনূর্ধ্ব-১৯ এএফসি কাপের বাছাইপর্ব এবং সাফ গেমসে অনূর্ধ্ব-২৩ দলও হেরেছে ভুটানের কাছে। দেশের ফুটবল যে গত ১২ বছরে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়েছে, এটা তার একটা প্রমাণ।
কাজী সালাউদ্দিন লিওনেল মেসির আর্জেন্টিকে বাংলাদেশে এনেছেন, নাইজেরিয়ার সঙ্গে তাদের প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করেছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস ঘটনাগুলোর একটি হচ্ছে এটি। কিন্ত এই গ্ল্যামার দিয়ে তো দেশের ফুটবলের কোন লাভ হয়নি। জাতীয় দলের পারফরম্যান্সের অবস্থা তথৈবচ, সালাউদ্দিনের আমলে ৭৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে মাত্র ১৯টিতে! বিগত চারটি সাফ ফুটবল টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বই পার হতে পারেনি বাংলাদেশ জাতীয় দল। পারফরম্যান্সের হতদরিদ্র্য অবস্থা বোঝানোর জন্য এটুকুই মনে হয় যথেষ্ট।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, যে বনে বাঘ নেই, সেই বনে শেয়াল রাজা। বাংলাদেশের ফুটবলাঙ্গনের অবস্থা হয়েছে এই প্রবাদের মতোই। কাজী সালাউদ্দিন বাফুফে সভাপতি হিসেবে ব্যর্থ, কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, তার জায়গায় আসার মতো যোগ্য লোকও নেই কোথাও। এই নির্বাচনেই তার দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখুন। বাদল রায় তো কয়েক দফা নাটক করলেন নির্বাচনে থাকবেন কি থাকবেন না সেটা নিয়েই। একবার নাম প্রত্যাহার করেন তো আরেকবার বলেন আমি আছি! শফিকুল ইসলাম মানিক কোচ হিসেবে বেশ ভালো, কিন্ত সংগঠক হিসেবে তাকে যে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, সেটা তার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাটাই বলে দিচ্ছে।
যারা কাজী সালাউদ্দিনের কট্টর সমালোচক, সালাউদ্দিনের পদত্যাগ চান বারবার, তারাও স্বীকার করে নেন যে, এই নির্বাচনে অন্য কেউ আসার চেয়ে সভাপতি হিসেবে সালাউদ্দিনের থেকে যাওয়াটাই ভালো হয়েছে। সালাউদ্দিনের আমলে অন্তত ঘরোয়া ফুটবল চালু ছিল, প্রতি বছর পেশাদার লিগ মাঠে গড়িয়েছে। পাতানো খেলার অভিযোগ থাকলেও, ফুটবলারদের আয়টা অন্তত বন্ধ হয়নি। এই একটা জায়গায় কাজী সালাউদ্দিন নিজেকে সফল দাবী করতে পারেন, এবং করেনও। অন্য কেউ এই জায়গায় এলে প্রতিবছর লিগ আয়োজিত হতো কিনা সন্দেহ আছে। তাছাড়া ফিফায় কাজী সালাউদ্দিনের যোগাযোগ ভালো, সেটাও বাংলাদেশের জন্য একটা বাড়তি সুবিধা। তবে সেই সুবিধা বাংলাদেশের ফুটবলের কাজে আসছে কিনা- এটাও একটা প্রশ্ন।
দেশ-বিদেশে নানা জায়গায় কাজী সালাউদ্দিনের আমলে জাতীয় দলের ফুটবলারদের ক্যাম্প আয়োজিত হয়েছে, তবে প্রত্যাশিত সফলতা আসেনি। বরং সাফল্য এনে দিয়েছে বয়সভিত্তিক দল এবং নারী দল। সেই নারী দলের সঙ্গে বাফুফের অপেশাদার আচরণ নিয়েও কম সমালোচনা হয়নি। দেশের ফুটবলের প্রাণকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বেহাল দশা, মাঠটার চেহারা হয়েছে পাড়ার মাঠের চেয়েও খারাপ, সেখানে সবজির চাষ হয় এখন। ঢাকার বাইরে ফুটবলের অন্যরকম উন্মাদনা থাকলেও, ফুটবলকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটা কাজী সালাউদ্দিন একযুগেও করতে পারেননি। হবিগঞ্জে ব্যারিস্টার সুমন তার ফুটবল অ্যাকাডেমিতে যে অত্যাধুনিক জিম তৈরি করেছেন, সেটা নেই বাফুফের কাছেও! কোটি কোটি টাকার অনুদান তাহলে কোথায় যায়?
তবুও কাজী সালাউদ্দিন নিজেকে সফল ভাবেন। র্যাংকিংয়ের ১৮৭ নম্বরে থেকে বছর শেষ করেও তিনি দাবী করেন, বছরটা সফল! সফলতার মানদণ্ডটা তার কাছে কি, সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। অথচ আমাদের পক্ষে তাকে পাশমার্ক দেয়াটাই দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়! আর তাই তিনি যখন বলেন যে বাফুফের সভাপতি পদে তার বিজয় মানে দেশের ফুটবলের বিজয়- সেটা মেনে নিতে আমাদের ঘোর আপত্তি আছে। আশা করব, সাফল্যের দৃষ্টিভঙ্গিটা আরেকটু বড় হয়ে ধরা দেবে কাজী সালাউদ্দিনের কাছে, এত অল্পে তৃপ্ত তিনি হবেন না আগামী চার বছরে। অবশ্য, বাফুফের গত একযুগের আমলনামা দেখলে এমন কিছু কল্পনা করতেও দুঃসাহস লাগে...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন