'আসসালামু আলাইকুম' কখনো জঙ্গিবাদের প্রতীক হতে পারে না
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নাস্তিকের নাম শুনলেই যারা কতল করতে চায়, যুক্তি না বুঝেই যারা মৌলবাদীদের হাতে ঘটা নৃশংস মৃত্যুর ঘটনাগুলোকে হালাল করে, তাদের ক্লিনচিটের সঙ্গে সালাম নিয়ে অধ্যাপক জিয়ার এই একপেশে মন্তব্যটার কোন পার্থক্যই নেই...
ছোটবেলায় মক্তবে সালাম দেয়ার রীতিনীতি শেখানো হয়েছিল আমাদের। সালামের মানে, কতটুকু সালাম দিলে কয় নেকি পাওয়া যাবে, সালামের জবাবে কি বলতে হবে, তাতে কি পরিমাণ সওয়াব- সব। স্কুলে পড়ার সময় তাড়াহুড়ায় আসসালামু আলাইকুমকে শর্টকাটে 'স্লামালাইকুম' বলার একটা 'স্টাইল' বানিয়ে নিয়েছিলাম নিজেরাই। সেই 'স্টাইল' মাটিচাপা পড়েছিল এক শিক্ষকের কড়া ধমকে। তিনিই বুঝিয়েছিলেন, 'স্লামালাইকুম' শব্দটার আসলে কোন অর্থ নেই। কাউকে মন থেক শ্রদ্ধা করলে তাকে যাতে ঠিকঠাকভাবে সালাম দেই, আর শ্রদ্ধা না এলে সালাম দেয়ারই দরকার নেই- এই ছিল সেই শিক্ষকের বক্তব্য।
স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া অনেক শিক্ষাই গিলে খেয়ে বসেছি, ভুলে গেছি বেমালুম। সালাম নিয়ে শ্রদ্ধেয় সেই শিক্ষকের কথাগুলো মস্তিস্ক তার স্মৃতির ভাণ্ডারে জমা করে রেখে দিয়েছে, সেগুলো ভুলিনি। আমার সেই শিক্ষককে রোজার মাস ছাড়া নামাজ পড়তে দেখিনি, কাউকে নামাজ পড়ার জন্য বলতে বা ডাকাডাকি করতেও শুনিনি। নিজের ইবাদতটা করেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন। কোন ধরনের ধর্মীয় কট্টরপন্থার সঙ্গে তার দূরতম সংযোগ ছিল না। কাজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জিয়া রহমান যখন বলেন যে, স্লামালাইকুমকে যারা আসসালামু আলাইকুম বানাতে চায়, তারা জঙ্গী মানসিকতার লোকজন- তখন তার বক্তব্যটাকে বড্ড একপেশে, জেনারালাইজ করে ফেলা বলে মনে হয়।
অধ্যাপক জিয়ার এই বক্তব্যটা ভাইরাল হয়েছে সম্প্রতি, যদিও ডিবিসি নিউজের একটা টকশোতে এই কথা তিনি বলেছিলেন প্রায় দেড় বছর আগে। সেই টকশোতে তিনি যেটা বলেছিলেন, তার সারমর্ম হচ্ছে, ইদানিং অনেকে স্লামালাইকুমকে আসসালামু আলাইকুম বলে শুদ্ধ করে দিতে আসে, বা হঠাৎ করে ধর্মের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠে। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার দরকার আছে। এই ঘরানার লোকগুলোকে তিনি 'বিএনপি জামাতী মানসিকতার' বলেও উল্লেখ করেছেন সেই টকশোতে।
অধ্যাপক জিয়া অপরাধবিজ্ঞান পড়ান, অপরাধীর মনস্তত্ত্ব তিনি সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক ভালো বুঝবেন। হঠাৎ করে ধর্ম পালনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়া, চারপাশের জগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, অন্যদের ধর্মের পথে ডাকা- এগুলো একজন নব্য জঙ্গীর বৈশিষ্ট্য হতেই পারে, এরকম স্বভাব আচমকা কারো মধ্যে দেখা দিলে তার ব্যাপারে সতর্ক থাকারও দরকার আছে। কিন্ত অধ্যাপক জিয়া যেভাবে পুরো ব্যাপার্যাকে জেনারেলাইজ করলেন, সেটা প্রচণ্ড দৃষ্টিকটু, এবং কুরুচিপূর্ণও। ফেসবুকে প্রথম আলো বা বিবিসির কোন খবরের নিচে আলটপকা মন্তব্য করা কোন ফেসবুক ইউজার হলে বিষয়টা মেনে নেয়া যেত, কিন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের মুখ থেকে এমন একপেশে বক্তব্য মোটেই কাম্য নয়।
সালাম দেয়াটাকে আমাদের দেশে নম্রতা এবং ভদ্রতার একটা অংশ হিসেবে ধরা হয়। ছোটবেলা থেকে পরিবার আর সমাজ আমাদেরকে শেখায়, বয়স্ক কারো সাথে দেখা হলে তাকে সালাম দিতে। সবকিছুরই একটা সিস্টেম আছে, একটা এটিকেট আছে। পরীক্ষার খাতায় মনগড়া বাক্য লিখে এলে অধ্যাপক জিয়া নিশ্চয়ই তার ছাত্রদের নম্বর দেন না, ক্লাসে কেউ ভুল করলে সেটা সংশোধন করে দেন, শিক্ষক হিসেবে এটা তার দায়িত্ব। তাহলে কাউকে ভুল পদ্ধতিতে বা ভুল উচ্চারণে সালাম দিতে দেখলে কেউ যদি সেটা শুদ্ধ করে দিতে চায়, তাকে কেন 'জামাতী' বা 'জঙ্গী' মানসিকতার ব্যক্তি হিসেবে আখ্যা দেয়া হবে? এটার পেছনে যুক্তিটা কী?
একজন উগ্রপন্থী আল্লাহ'র নাম মুখে নেন বলে আল্লাহকে ডাকা প্রতিটি মুসলমান জঙ্গি হয়ে যান না। একজন জঙ্গী মানুষকে নামাজ পড়তে বলতেই পারে, তাই বলে তাকে যদি আপনি একজন ধর্মভীরু মুসলমানের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন, তাহলে সমস্যা। ওসামা বিন লাদেনের দাড়ি আর একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের দাড়ির মধ্যে আপনি যদি তফাৎ না দেখেন, সেটা আপনার সমস্যা, ওই ব্যক্তির নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক গবেষণাপত্র চুরির দায়ে ধরা পড়েছেন। এখন যদি কেউ বলে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা শিক্ষক চোর, সেই মন্তব্য নিশ্চয়ই অধ্যাপক জিয়া রহমান গ্রহণ করবেন না। তাহলে তার এই ভিত্তিহীন বক্তব্যকে আমরা কীভাবে গ্রহণ করি?
নাস্তিকের নাম শুনলেই যারা কতল করতে চায়, গালাগালি দেয়, যুক্তি না বুঝেই যারা মৌলবাদীদের হাতে ঘটা নৃশংস মৃত্যুর ঘটনাগুলোকে হালাল করে দেয়, তাদের ক্লিনচিটের সঙ্গে অধ্যাপক জিয়ার এই একপেশে মন্তব্যটার কোন পার্থক্যই নেই। অধ্যাপক জিয়ার এই বক্তব্য একজন প্রগতিশীল উগ্রবাদীর বক্তব্য। আর উগ্রবাদী প্রগতিশীল হোক কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল, সেই ব্যক্তি সবসময়ই বর্জনীয়। শুদ্ধভাবে সালাম দেয়াটা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ডিসকোর্স, জামায়াত-শিবিরের নয়। জামায়াত-হেফাজত যেমন ইসলামটাকে নিজেদের সম্পত্তি হিসেবে দাবী করে, অধ্যাপক জিয়ার বক্তব্যটাও তারচেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। তিনিও ইসলাম আর জামায়াত-শিবির আর জঙ্গীবাদকে এক করে ফেলেছেন এই কয়েকটা লাইনে।
আসসালামু আলাইকুম শব্দটার বাংলা অর্থ হচ্ছে আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। এত চমৎকার একটা কথা কখনোই জঙ্গিবাদের প্রতীক হতে পারে না। আমার নিজের লেখায় অনেক বানান ভুল থাকে, তবুও কোথাও বাংলা বানানে ভুল দেখলে সেটা ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। সালামের ব্যাপারেও অনেকের সেরকম মনোভাব থাকতে পারে, যারা সালাম দেবে, তাদের সবাই শুদ্ধভাবে, অর্থ বুঝে সালামটা উচ্চারণ করবে- এমন চাওয়া অনেকেরই হতে পারে। কাউকে সালামের শুদ্ধ রীতিটা বললে তাদের সবাইকে জঙ্গী হিসেবে ট্যাগ দেয়াটা বিষাক্ত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন