দুনিয়ার মানুষ ঘুরতে যায়, নতুন জায়গা আবিস্কার করতে যায়, আর আমরা যাই 'চিল' করতে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তি করে আসতে। আমাদের সেই 'চিল' আর শো-অফের মাশুল দিতে হয় প্রকৃতিকে...
খাগড়াছড়ির সাজেকে গিয়েছিলাম ২০১৩ সালে। তখন সেখানে কেবল দুটো রিসোর্ট ছিল, দুটোরই তত্ত্বাবধানে ছিল সেনাবাহিনী। আগে থেকে বুকিং দিয়ে যাওয়া লাগতো, কারন রুম না পেলে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হবে, এই কারনেই সেখানে যাওয়া ট্যুরিস্টদের সংখ্যাটা ছিল হাতেগোনা। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাজেক থেকে তোলা মেঘের ছবি আর পাহাড়ের ভিউ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে ধীরে ধীরে, প্রকৃতির এই সৌন্দর্যসুধা পান করার জন্যেই হোক কিংবা সাজেকে গিয়ে একটা চেকইন দিয়ে নিজেকে জাতে তোলার জন্যেই হোক- দর্শনার্থীদের ভীড় বেড়েছে।
এখন সাজেকের প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে হেলিপ্যাড পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে গণ্ডায় গণ্ডায় রিসোর্ট আর হোটেল। বাহারী সব নাম, ভাড়াও যে নাগালের বাইরে- তেমনটা নয়। আর তাই সব শ্রেনী-পেশার মানুষ ছুটে যাচ্ছে কাতারে কাতারে। গত বছর এক সরকারী ছুটির দিনে কংলাক পাহাড় থেকে লাইন ধরে নামার দৃশ্য ফেসবুকে খুব ভাইরাল হয়েছিল। বিষয়টা নিয়ে হাসিঠাট্টাও হয়েছে, যদিও আদতে ঠাট্টা করার মতো জিনিস না এটা। সাজেকের মতো ছোট্ট একটা জায়গায় যদি ছুটি কাটাতে একসঙ্গে এতগুলো মানুষ যায়, সেই জায়গাটার যে কি ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে, সেটা তো ছবিতেই দেখা যাচ্ছে।
করোনার কারনে ট্যুরিজম থমকে ছিল অনেকদিন। নইলে ছুটির দিনগুলোতে সাজেকের চিত্রটাকে গুলিস্তান-বঙ্গবাজার বা ফার্মগেটের চাইতে আলাদা করা যাবে না, প্রবেশমুখে বিজয় সরণীর জ্যাম লাগাটা তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ট্যুরিস্ট গ্রুপগুলো নামে-বেনামে ট্যুরের আয়োজন করছে, অনেকে বন্ধুবান্ধব বা পরিবার নিয়ে দলবেঁধে যাচ্ছে। এই যে এতগুলো মানুষ একই সময়ে এই ছোট্ট জায়গাটায় গিয়ে উঠছে, তাদের তৈরি করা বর্জ্য পদার্থগুলোর কি গতি হবে, সেটা কি সাজেক নির্মাণের সময় ভাবা হয়েছিল? জনপদ থেকে এতটা দূরে, যেখানে পানি পর্যন্ত খাগড়াছড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া লাগে, সেখানে পানির বোতলগুলোর গন্তব্য কোথায় হবে, সেটা নিয়ে কেন কেউ ভাবেনি? পাহাড়ের আদিম অধিবাসীদের তাদের ভূমি থেকে জোর করে হঠিয়ে দিয়ে বাঙালির মনোরঞ্জনের জন্য যখন সাজেক বানানো হচ্ছিল, তখন কি কারো মাথায় এসেছিল যে, জোর করে মানুষগুলোকে নাহয় জঙ্গলের আরও গহীনে ঠেলে দেয়া গেল, কিন্ত এই পাহাড়, এই প্রকৃতির কী হবে?
আমরা সবসময় শর্টকাট সল্যুশানে বিশ্বাস করি। আমাদের স্বভাব হচ্ছে ধরো তক্তা মারো পেরেক টাইপের। তাতে যে দীর্ঘমেয়াদি সফলতা আসে না, এটা জেনেও চোখ-কান বন্ধ করে রাখি আমরা। সাজেকের বেলাতেও সেটাই হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র রিসোর্ট আর আবাসিক হোটেল বানানোর অনুমতি দেয়ার কারনে দলে দলে মানুষ ছুটেছে পাহাড়ে, তাদের ফেলা ময়লা আবর্জনায় সয়লাব হয়েছে জায়গাটা। চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, বাচ্চার ডায়পার, ছেঁড়া স্যান্ডেল থেকে শুরু করে কলার খোসা, সিগারেটের গোড়া- সবকিছুই পড়ে আছে যেখানে সেখানে। একটা জায়গাকে কত সুনিপুণভাবে নোংরা করা যায়- এই বিষয়ে তো আমাদের পিএইচডি ডিগ্রি নেয়া আছে, বাঙালির রক্তের মধ্যে মিশে আছে এই ব্যাপারটা।
সাজেক একটা উদাহরণ মাত্র। সেন্টমার্টিন প্রথমবার গিয়েছিলাম ২০১২ সালে, তখন বোধহয় শুধু কেয়ারী সিন্দাবাদ জাহাজটাই চলতো টেকনাফ থেকে, এটা ছাড়া যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল ট্রলার। কাজেই ট্রাভেল ফ্রিক ছাড়া খুব বেশি মানুষ এতদূর যাওয়ার ঝুঁকি নিতেন না। এখন পিক সিজনে ছয়-সাতটা জাহাজ যায় সেন্টমার্টিনে, গড়ে উঠেছে অজস্র হোটেল-মোটেল। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই পাঁচ মাসে প্রতিদিন অন্তত সাত হাজার করে মানুষ সেন্টনার্টিনে বেড়াতে যায়। আর এত মানুষের চাপে স্বভাবতই দ্বীপটার ত্রাহি দশা। যত্রতত্র ময়লা পড়ে আছে, জীববৈচিত্র্য সংকটে পড়ছে সেসবের কারনে। প্রতিদিন টনকে টন ময়লা তৈরি হচ্ছে, সেসব পরিস্কার করার মানুষ নেই, নিয়ে ফেলবেই বা কোথায়? ছেঁড়াদ্বীপের মতো চমৎকার একটা জায়গাও চিপসের প্যাকেট আর এনার্জি ড্রিংকসের বোতলে সয়লাব।
আপনি টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যান, তাহিরপুরে নামলে পানিতে শুধু বিরিয়ানির প্যাকেট নজরে পড়বে। সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সময় আমাদের বিবেকবুদ্ধির বিসর্জন দেয়া শুরু হয় জাহাজে ওঠার পরপরই, গাংচিলকে চিপস খাওয়ানো আর প্যাকেটটা নাফ নদীতে ফেলার মাধ্যমে। অমিয়াখুমের মতো দুর্গম জায়গায় যাওয়ার রাস্তায় ঝিরিতে পেয়েছি ছেঁড়া মোজা, অন্তর্বাস আর বাটারবানের প্যাকেট। গুলিয়াখালি সী বিচটা জনপ্রিয় হবার সাথে সাথে সেটাও নোংরা করার মচ্ছবে নেমেছে সবাই, বিরিয়ানির প্যাকেট আর পানির বোতলে ভরে আছে সেই জায়গাটাও। এরপরেও আমরা আফসোস করি, কেন আমাদের দেশে বিদেশী ট্যুরিস্ট আসে না! টাকা খরচ করে এই আবর্জনার স্তুপ দেখতে আসবে, এমন ঠ্যাকা কার পড়েছে?
খৈয়াছড়া, নাপিত্তাছড়ায় চোখ-কান খোলা রেখে হাঁটলেই পরিত্যাক্ত কনডমের প্যাকেট নজরে আসে। এরকম জায়গায় কেন এই বস্তুটাকে যেতে হবে? কনডমের নিশ্চয়ই পা নেই যে নিজে থেকে হেঁটে চলে গেছে! চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ওপরটা ভর্তি হয়ে আছে ডাবের খোসা, পানি-স্পিডের বোতল আর পলিথিনে। কিশোরগঞ্জের হাওড়গুলোর অবস্থাও কাছাকাছি, বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে সেখানে পিকনিক করতে যায় বাঙালি। নিজেরা ফিরে আসে, প্যাকেটগুলো বিসর্জন দিয়ে আসে হাওড়ের বুকে, যেভাবে অনেক আগে বিসর্জন দিয়ে ফেলেছে কমনসেন্স। মনপুরা, নিঝুম দ্বীপ বা হাতিয়া-মহেশখালির মতো জায়গাগুলোও এই নোংরামির মচ্ছব থেকে রেহাই পায়নি পায়নি বাংলাদেশের কোন প্রান্তরই।
জাতিগতভাবেই আমরা অসভ্য এবং নোংরা স্বভাবের, এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। পরিপাটি একটা জিনিস দেখলে অযথাই সেটাকে বিগড়ে দিতে ইচ্ছে করে আমাদের। দুনিয়ার মানুষ ঘুরতে যায়, নতুন জায়গা আবিস্কার করতে যায়, আর আমরা যাই 'চিল' করতে, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তি করে আসতে। ঘুরে বেড়ানোটা আমাদের কাছে যতটা না শখ পূরণ। তার চেয়ে অনেক বেশি শো-অফ। আমাদের এই দেখনদারি আর ফুর্তির মাশুল গুণতে হয় প্রকৃতিকে। তাতে অবশ্য আমাদের থোড়াই কেয়ার! এই নোংরা মানসিকতা, বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে চলার যে স্বভাব- এটা তো বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। কয়লা ধুয়ে কি আর ময়লা তাড়ানো সম্ভব?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন