সেন্টমার্টিনে এই মৌসুম থেকে দিনে ১২৫০ জনের বেশি পর্যটক যেতে পারবেন না, অনলাইনে করতে হবে নিবন্ধন। নিঃসন্দেহে ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যেগুলোর নেই ঠিকঠাক উত্তর...

জীববৈচিত্র‍্য রক্ষা করতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে এবছর থেকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১২৫০ জন করে পর্যটককে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে- এমন একটা সংবাদ গতকাল প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক প্রথম আলোতে। যারা সেন্টমার্টিন ভ্রমণে আগ্রহী পর্যটকেরা অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে সেখানে যাওয়ার অনুমতি সংগ্রহ করতে পারবেন। ইতিমধ্যেই পরিবেশ অধিদপ্তর এই সংক্রান্ত অ্যাপ তৈরির কাজও শুরু করে দিয়েছে। নিবন্ধন ছাড়া কোন পর্যটক যাতে প্রবাল দ্বীপটিতে যেতে না পারে, সেজন্যেই এই উদ্যোগ।

এই সিদ্ধান্তটার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথাই হবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশী পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত স্থানগুলোর মধ্যে সবার ওপরেই থাকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের নাম। বেশিরভাগ মানুষই এক কথায় এই দ্বীপটাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটন স্পট হিসেবে মেনে নেন নির্দ্বিধায়। সাগরের বুকে জেগে থাকা ছোট্ট এই দ্বীপটাকে তাই পর্যটনের মৌসুমে সামলাতে হয় বিপুল সংখ্যক 'ঘুরতে যাওয়া' মানুষের চাপ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পর্যটন কর্পোরেশনের নেয়া এই সিদ্ধান্তটা কি আসলেই বাস্তবায়িত হবে? নাকি এর আড়ালে কোন শুভঙ্করের ফাঁকি লুকিয়ে আছে? 

পর্যটনের মৌসুমে(নভেম্বর-মার্চ) প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যায় এবং অবস্থান করে। এতে দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পথে। কচ্ছপের প্রজনন ব্যহত হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে মহামূল্যবান প্রবাল। শেষ হয়ে যাচ্ছে ভূগর্ভের নিচে থাকা পানির সামান্য স্তরটুকুও। এছাড়া সেন্টমার্টিন দ্বীপের পানিতে যে পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, এই পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া ঢাকা শহরের ওয়াসার পানিতেও থাকে না! ছোট্ট একটা দ্বীপে হাজার হাজার মানুষ গিয়ে মাসের পর মাস ধরে মেলা বসালে এমনটাই তো হওয়ার কথা, তাই না? 

প্রথম আলোর সেই প্রতিবেদন

স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে নির্মাণ করা রাস্তায় দ্বীপটির ক্ষতি বাড়ছে। পর্যটকদের থাকার জন্যে যেসব হোটেল বা রিসোর্ট নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর সবই অবৈধ, কারণ সেন্টমার্টিন দ্বীপে কোন পাকা স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি নেই। পরিবেশবিদরা যেখানে বারবার বলছেন যে সেন্টমার্টিনের হারানো জীববৈচিত্র‍্য ফিরিয়ে আনতে হলে সেখানে পর্যটকদের যাওয়া কয়েক বছরের জন্য বন্ধ রাখতে হবে, সেটা না করে আমরা শুধু সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথাই ভাবছি- এতে কি সমাধান আসবে আদৌ? 

এর আগেও কয়েক দফায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, দ্বীপে কোন জমি বেচাকেনা করা যাবে না। জেনারেটর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হবে না, জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে। ২০১৯ সালের পয়লা মার্চ থেকে দিনে মাত্র পাঁচশোজন করে পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাওয়ার অনুমতি পাবেন, অনলাইনে আবেদনের ভিত্তিতে তাদের অনুমতি দেয়া হবে, পর্যটকেরা সেন্টমার্টিনে রাতে অবস্থানের অনুমতি পাবেন না। দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসতে হবে- এরকম কথাও জানানো হয়েছিল। কিন্ত পালন করা হয়নি একটাও। 

বরং কি হয়েছে জানেন? সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যটকদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হবে- এমন গুজব রটিয়ে একশ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ী আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে স্রেফ কয়েক মাসেই। নিবন্ধন, রাত্রিযাপন বন্ধ করে দেয়া- এসবে বিশ্বাস করে মানুষজন হুড়মুড় করে ছুটেছে সেন্টমার্টিনের পানে, মাথায় কাজ করেছে- এবার না গেলে হয়তো আর কখনোই যাওয়া হবে না! হোটেল ভাড়া স্বাভাবিকেত চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে এই চাপ সামলাতে গিয়ে, জাহাজের টিকেট দুই সপ্তাহ আগে থেকেই শেষ হয়ে গেছে। 

সেন্টমার্টিন দ্বীপ

আমাদের আশঙ্কার জায়গাটা এখানেই। আরও একবার সেন্টমার্টিন বন্ধের নাম করে 'হাইপ' তুলে দেয়া হচ্ছে না তো? পর্যটন মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে, এখনই এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই হুজুগে লোকজন ছুটবে সেন্টমার্টিনের দিকে। যে লোকটার প্ল্যানে হয়তো এবছর সেন্টমার্টিন বেড়াতে যাওয়া ছিলোই না, সেও চাইবে ঝামেলাবিহীনভাবে ঘুরে আসতে, এত নিবন্ধনের গ্যাঁড়াকলে পড়ার কথা অনেকেই মাথায় আনবে না। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, আমাদের অবস্থাও হয়েছে তেমন। বারবার প্রতারণার শিকার হয়ে ভালো কোন উদ্যোগের পেছনেও শুভঙ্করের ফাঁকির কথা মাথায় আসে। 

আগামী কিছু দিনে সেন্টমার্টিনে সবকিছুর দাম পাল্লা দিয়ে বাড়বে, হয়তো আকাশ ছোঁবে। বিশ টাকার ডাব তো এমনিতেই সিজনে আশি-একশো টাকায় বিক্রি হয়, এবার নাহয় দুশো হবে। লঞ্চের ভাড়া বাড়বে, বাড়বে হোটেলের ভাড়া। গত বছর যে রুমের ভাড়া ছিল এক-দেড় হাজার টাকা, সেটা এবার তিন-চার হাজার হবে। তবুও লোকজন ছুটবে পঙ্গপালের মতো। কারণ ওই যে, 'সীমিত সংখ্যক পর্যটক নেয়ার ঘোষণা'! যদি অনুমতি না পাই, এই ভেবে 'শেষবারের মতো' নারিকেল জিঞ্জিরার স্বাদ নিতে ছুটবে সবাই, আর এটাই তো চায় বেড়াতে যাওয়া লোকজন দেখলেই ছুরি নিয়ে ওৎ পেতে থাকা কসাই প্রবৃত্তির কিছু ব্যবসায়ী। 

কে জানে, আগামী কিছুদিনে হয়তো দেদারসে পকেট কাটা হবে মানুষের। অনুমতি পাবো কি পাবো না, নিবন্ধন শুরু হবার আগেই ঘুরে আসি একবার- এই ভেবে সেন্টমার্টিন যাওয়ার কথা ভেবে অনেকে হয়তো এসব গায়েই মাখবেন না! তবুও স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয়, কর্তৃপক্ষের নেয়া এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হবে, সেন্টমার্টিন দ্বীপটা আবার প্রাণ ফিরে পাবে ধীরে ধীরে, ফিরে পাবে তার হারানো সৌন্দর্য্যও। কিন্ত অতীতের স্মৃতিগুলো যে আমাদের স্বপ্ন দেখতে বাধা দেয় বারবার... 

বিশেষ কৃতজ্ঞতা- সজল জাহিদ, ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশ ফেসবুক গ্রুপ

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা