সাইফুল আজম: অসীম সাহসী এক বাংলাদেশী বীরের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আরব-ইজরাইল যুদ্ধে আকাশে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন তিনি, ইজরাইলী ফাইটার প্লেনগুলোর কাছে হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। আমেরিকান এয়ারফোর্স তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বের ২২ জন লিভিং ঈগলসের একজন হিসেবে...
আজ থেকে পাঁচ দশক আগে এক বঙ্গসন্তানের অসীম সাহসিকতায় কেঁপে উঠেছিল দখলদার ইজরাইলী দেনাদের অন্তরাত্মা। আরব যুদ্ধে আকাশে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন তিনি, ইজরাইলী ফাইটার প্লেনগুলোর কাছে হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। আমেরিকান এয়ারফোর্স যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বের ২২ জন লিভিং ঈগলসের একজন হিসেবে- সেই অকুতোভয় যোদ্ধা সাইফুল আজম গতকাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ঢাকার সিএমএইচে। অথচ ৭৯ বছর বয়সে জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়া এই মানুষটার কীর্তিগাঁথা সম্পর্কে এই প্রজন্মের খুব বেশি মানুষ জানেই না।
সাইফুল আজমের জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত ভারতের পাবনায়, ১৯৪১ সালে। বাবার কর্মসূত্রে কলকাতায় কেটেছে শৈশব। দেশভাগের সময় তার পরিবার ফিরে আসে বাংলাদেশে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। মাধ্যমিকের পড়াশোনা করেন এখানেই। ১৪ বছর বয়সে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয় উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষালাভের জন্য। ১৯৫৮ সালে তিনি ভর্তি হন পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ক্যাডেট কলেজে। দুই বছর পর তিনি পাইলট অফিসার হিসেবে উন্নীত হলেন। দারুণ পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি স্বরূপ সেবছরেই জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জন্যে সাইফুল আজম ছিলেন একজন অ্যাসেট। সেটা বিমান বাহিনীর কর্তারাও বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্যে পাঠানো হয়েছিল আমেরিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনার ‘লুক এয়ারফোর্স বেইস’ এ ট্রেনিং নিয়েছিলেন তিনি। তার সঙ্গী হয়েছিল সবচেয়ে তুখোড় জঙ্গী বিমান ‘এফ-৮৬ স্যাবরজেট’, যেটি ছিল সেই সময়ে আকাশপথের ত্রাস, যুদ্ধবিমানের সবচেয়ে উন্নত ভার্সন। এছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়নের বানানো মিগ-১৫ বিমান চালনারও প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন তিনি। এফ-৮৬ এর সমতুল্য বিমান তখন কেবল মিগ-১৫ ই ছিল।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে দুর্দান্ত সাহসিকতার নজির রেখেছিলেন সাইফুল আজম ও তার দল। আকাশপথে সম্মুঝ যুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিমান ভূপতিত করেছিলেন তিনি, গ্রেফতার করা হয়েছিল ভারতীয় এক পাইলটকে। এমন দারুণ কীর্তি স্থাপন করায় তাকে ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান স্বয়ং তাকে এই সম্মাননা দিয়েছিলেন। প্রথম বাঙালি পাইলট হিসেবে এই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন সাইফুল আজম। বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানীদের একচোখা দমন নীতি থাকলেও, সাইফুল আজম নিজের কৃতিত্বেই তাদের কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন।
তবে পাক-ভারত যুদ্ধে নয়, জীবনের সবচেয়ে সাহসী কীর্তিটার জন্ম সাইফুল আজম দিয়েছিলেন তৃতীয় আরব-ইজরাইল যুদ্ধে। চার আরব রাষ্ট্র মিশর, জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাকের উপর আকাশপথে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল ইসরাইল। মিশর তার সৈন্যদের ইসরাইল সীমান্তে নিযুক্ত করেছিল, জবাবে একটানা আক্রমণ করে মিশরের প্রায় গোটা বিমান বাহিনীর যুদ্ধ সরঞ্জাম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল ইসরাইলি বাহিনী। ইজরাইলীদের তাণ্ডবের সামনে অসহায় হয়ে পড়েছিল আরব দেশগুলো।
আরবদের এহেন লজ্জাজনক পরাজয়ের মাঝখানে বুক চিতিয়ে লড়েছিলেন বিমান সেনা সাইফুল আজম। প্রশ্ন হচ্ছে, আরব-ইজরাইল যুদ্ধে সাইফুল আজম কোত্থেকে এলেন? ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে জর্ডানের বিমানবাহিনী ‘রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ার ফোর্স’-এ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে যান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম। সেখানে তিনি জর্ডানের বিমানবাহিনীতে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। সেকারণেই এই যুদ্ধের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন তিনিও।
১৯৬৭ সালের ৫ই জুন, জর্ডানের মাফরাক ঘাঁটি থেকে উড়লেন সাইফুল আজম। জর্ডানের পাইলটদের সাথে নিয়ে চারটি ‘হকার হান্টার’ জঙ্গী বিমানের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। আকাশযুদ্ধে মুখোমুখি হলেন ইজরাইলের বিমান বাহিনীর, ইজরাইলী বিমান সেনারা আশাই করেনি, এমন তাণ্ডবের পরে আরব বিমানগুলোর পক্ষ থেকে কোন প্রতিরোধ আসতে পারে। তাদেরকে হতবিহবল করে দিয়ে ইজরাইলের একটি ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে বিমান ধ্বংস করলেন সাইফুল আজম। হতভম্ভ হয়ে গেল ইজরাইলের বিমান সেনারা।
সাইফুলের বীরত্বের এখানেই শেষ নয়। দুদিন বাদেই ইজরাইলের আক্রমণের খবর পেয়ে ইরাকে ছুটে গেলেন তিনি। দুটো বিমান ঘাঁটি রক্ষা করাটা তার মিশন। জুনের ৭ তারিখ, ইজরাইলের বিমানগুলো ছুটে এলো হামলা করতে। সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন সাইফুল আজম ও তার স্কোয়াড। ইরাকের আকাশে শুরু হলো 'ডগ ফাইট'। সেই যুদ্ধে সাইফুল একাই ধ্বংস করেছিলেন দুটো ইজরাইলি যুদ্ধ বিমান। বন্দী হলো দুই ইজরাইলী পাইলট। পৃথিবীর ইতিহাসে সাইফুল আজম একমাত্র পাইলট, যিনি একা তিনটি ইজরাইলী যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছেন! বন্দী দুই ইজরাইলী সেনার সঙ্গে বিনিময় চুক্তি হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ইজরাইলের হাতে বন্দী হওয়া হাজারো আরব সেনাকে। সাইফুল আজমে তার অসামান্য বীরত্বের জন্য ভূষিত করা হয়েছিল 'হুসাম-ই-ইস্তিকলাল’ সম্মাননায়।
সাইফুল আজমের জীবনের আক্ষেপ একটাই, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। একাত্তরের গোটা সময়টাই তিনি অবরুদ্ধ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তার ওপর কড়া নজর রাখা হয়েছিল। পাকিস্তানীরা জানতো তিনি কি জিনিস, কোনভাবে ভারতে চলে যেতে পারলেই যে সাইফুল আজম পাকিস্তানের জন্য ত্রাস হয়ে উঠবেন, তাতে তাদের কোন সন্দেহই ছিল না। সাইফুল আজম ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের সরাসরি ইন্সট্রাক্টর, মতিউরের মতো তিনিও বিমান নিয়ে পালানোর প্ল্যান করেছিলেন, স্ত্রী-সন্তানকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্ত কড়া নজরদারীর কারণে সেটা করতে পারেননি তিনি। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান যখন বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন, তখন সাইফুল আজমকে কঠোর জেরার মধ্যে পড়তে হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসেন সাইফুল আজম। ১৯৭৭ সালে তিনি উইং কমান্ডার পদে উন্নীত হন। তাকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির অধিনায়ক করা হয়। বিমানবাহিনীতে 'ডিরেক্টর অব ফ্লাইট সেফটি' ও 'ডিরেক্টর অব অপারেশনস' এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ১৯৭৯ সালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন তিনি। অবসরের পর সাইফুল আজম বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দায়িত্বেও ছিলেন তিনি, সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাংসদও হয়েছেন ১৯৯১ সালে।
অকুতোভয় বীর সাইফুল আজম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন গতকাল। অথচ তার বীরত্বগাঁথা দেশের খুব বেশি মানুষ জানেই না, তার নামটাও জানে কিনা সন্দেহ আছে! হলিউডি সিনেমায় ডগ ফাইটের দৃশ্য দেখে আমাদের গা কাঁটা দিয়ে ওঠে, লোম খাড়া হয়ে যায়, অথচ আমরা খোঁজ রাখি না যে আমাদের এক পূর্বসূরি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে এমন নজির বাস্তবেই স্থাপন করে এসেছেন! গোটা বিশ্বে এযাবৎকালে মাত্র বাইশ জন বিমান সেনাকে আমেরিকান এয়ারফোর্স 'লিভিং ঈগলস' উপাধি দিয়েছে, সাইফুল আজম সেই বিরল তালিকায় নাম লিখিয়েছেন নিজের সাহসিকতা দিয়ে- তার বীরত্বের এরচেয়ে বড় নমুনা আর কি হতে পারে?