সিনেমার সময়ে কাস্টিং লিস্টে 'মাহবুব আহমেদ সাদেক' পরিবর্তন করে বসিয়ে দেয়া হলো 'সাদেক বাচ্চু'। সেই থেকে তাঁর নামই হয়ে গেলো সাদেক বাচ্চু। এহতেশাম যতবারই দেখতেন তাকে, সোল্লাসে বলতেন, তু বাড়া বাচ্চু হ্যায় রে, তেরে নাম বাচ্চু, সাদেক বাচ্চু।

কোনো একটি কল্পিত চরিত্রের সার্থকতা কোথায় জানেন? যখন সাধারণ মানুষজন, কল্পিত চরিত্রটির সাথে অভিনেতার বাস্তব জীবনকেও পাকিয়ে গুবলেট বানিয়ে ফেলেন, তখন। অর্থাৎ অসাধারণ অভিনয় করে একজন অভিনেতা চরিত্রকে এতটাই অন্যরকম করে ফেলেন যে, তাঁর বাস্তব জীবনও ফিকে হয়ে যায়, আরোপিত চরিত্রের কাছে। সে কারণেই হয়তো গেম অব থ্রোন্স এর জফ্রি অথবা সার্সি, ব্রেকিং ব্যাড এর স্কাইলার কে দেখলে আমরা ঘৃণায় নাক কুঁচকে উঠি। এটাই এই চরিত্রগুলোর সার্থকতা। এখানেই তাদের জয়। আমাদের সিনেমাজগতেও এরকম বেশ কয়েকজন মানুষ আছেন, যাদের দেখলেই আমরা তিতিবিরক্ত হয়ে যেতাম। পর্দায় যখনই তাদের দেখতাম, ভাবতাম- কূটবুদ্ধি নিয়ে এসেছে। এখনই সিনেমাটা শেষ করে দেবে। সেরকমই একজন ছিলেন মাহবুব আহমেদ সাদেক। এই নাম শুনে চেনার কথা না। তাকে সবাই চিনতো সাদেক বাচ্চু নামে।

পৈত্রিক ভিটে চাঁদপুরে হলেও জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা ঢাকায়। মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার তিন মাসের মধ্যেই বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারের বিশাল চাপ তার উপর আসে। মেট্রিক পাস করা এক কিশোরের জন্যে এটা মোটেও সহজ কিছু ছিলো না। মা,ভাই, বোন, দাদি সহ ১১ জনের পুরো সংসারের পর্বতসমান ভার সামলাতে পড়াশোনার পাশাপাশি ডাকবিভাগের চাকরীতে যোগ দেন তিনি। ১৯৭০ সালে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে।

পড়াশোনা, ডাকবিভাগের চাকরী পাশাপাশি রেখেই এগোচ্ছিলেন। যুদ্ধের পর‍ যুক্ত হলেন থিয়েটারের সাথেও। এমনিতেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সাংস্কৃতিকভাবেও খুব একটা স্থিতিশীল অবস্থাতে নেই কোনোকিছু। এরকম টালমাটাল সময়েই  'উন্মোচন' নামে একটি গ্রুপের সাথে যুক্ত হলেন তিনি। থিয়েটার আর মঞ্চনাটকে নিয়মিত দেখা যেতো লাগলো তাকে।

এরমধ্যে টিভিপর্দায়ও এলেন। নিয়মিতই অভিনয় করা শুরু করলেন টিভি নাটকে। মাঝখান দিয়ে ভেঙ্গে গেলো 'উন্মোচন'। তবে সাদেক বাচ্চু হতাশ হলেন না। গড়ে তুললেন মতিঝিল থিয়েটার। যেই প্রতিষ্ঠানের সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন তিনি। যাই হোক, মতিঝিল থিয়েটারকে আস্তে আস্তে দিকনির্দেশনা দিয়ে ভালো একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে লাগলেন। সে সাথে টিভি নাটকে অভিনয় তো আছেই। সোজন বাদিয়ার ঘাট, নকশী কাঁথার মাঠ, প্রথম অঙ্গীকার,জোনাকী জ্বলে সহ অনেক নাটকেই অভিনয় করে হয়ে গেলেন টেলিভিশনেরই তুমুল জনপ্রিয়, পরিচিত মুখ।

এরপর আসেন বড়পর্দায়। 'রামের সুমতি' সিনেমা দিয়ে শুরু। তবে দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা পান এহতেশামের 'চাঁদনী' সিনেমা দিয়ে। এরপরই বিভিন্ন সিনেমায় ডাক পেতে থাকেন। কিন্তু সবই ভিলেনের চরিত্রে। হয়ে যান ভিলেন। পুরোদস্তুর ভিলেন। এ পর্যন্ত পাঁচশোরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করা এ মানুষটি বাংলা সিনেমার 'খলনায়ক' চরিত্রটিকেই নিয়ে গিয়েছেন অন্য এক উচ্চতায়। ২০১৮ সালে 'একটি সিনেমার গল্প' সিনেমার খলচরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করে নিয়েছেন।

জীবদ্দশায় নাটক, সিনেমা, থিয়েটারে করেছেন বৈচিত্র্যময় সব অভিনয়! 

তাঁর 'সাদেক বাচ্চু' নামের পেছনের কাহিনীও বেশ অন্যরকম। প্রখ্যাত পরিচালক এহতেশাম এর 'চাঁদনী' সিনেমার সময়ে কাস্টিং লিস্টে 'মাহবুব আহমেদ সাদেক' পরিবর্তন করে বসিয়ে দেয়া হলো 'সাদেক বাচ্চু'। সেই থেকে তাঁর নামই হয়ে গেলো সাদেক বাচ্চু। এহতেশাম যতবারই দেখতেন তাকে, সোল্লাসে বলতেন,

তু বাড়া বাচ্চু হ্যায় রে, তেরে নাম বাচ্চু, সাদেক বাচ্চু।

খুব অল্পবয়সেই ধরতে হয়েছিলো পরিবারের হাল। এগারোটি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার যে গুরুদায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন, তা পালন করার পাশাপাশি তিনি অভিনয়ও করেছেন সমানতালে। থিয়েটার, মঞ্চ, টিভি, সিনেমা; কাঁপিয়েছেন সবখানেই। ছিলেন দক্ষ সংগঠকও। 'মতিঝিল থিয়েটার' যার প্রমাণ। লিখেছেন বইও৷ মাঝখানে ভালো চরিত্রের সুযোগ পান নি বলে অভিনয়েও অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিলেন। নিয়মিত আক্ষেপ করতেন বাংলাদেশের বর্তমান সিনেমাজগৎ এর দুরবস্থা নিয়েও। ইচ্ছে ছিলো, করোনার প্রকোপ শেষ হলেই আবার অভিনয়ে আসবেন।

কিন্তু করোনাই গ্রাস করে ফেললো এই মানুষটিকে। যদিও সময়ের ক্যাশমেমো জমা রেখে তিনি আজ চলে গিয়েছেন পৃথিবীর সরাইখানা ছেড়ে, তাও জীবদ্দশায় তাঁর যে অবদান, নিষ্ঠা ও কাজের ব্যাপ্তি, তাকে ভুলে যাওয়া যাবে না। সেটি সম্ভবও না।

বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি রইলো এই অসম্ভব গুনী মানুষটির জন্যে। তিনি পরপারে ভালো থাকুন, এটাই স্রষ্টার কাছে প্রার্থণা।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা