কুয়েত দখল: সাদ্দাম হোসেনের যে অপরিণামদর্শী মানসিকতা ডেকে এনেছিল মধ্যপ্রাচ্য সংকট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এই যুদ্ধে অন্তত ২৫,০০০ ইরাকি সৈন্যের মৃত্যু হয়, আর আহত হয় ৭৫,০০০ এর বেশি। আরো প্রায় লক্ষাধিক ইরাকি সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয় যুদ্ধাহত হয়ে, কিংবা পানি, খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে। আর এই বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল শুধুমাত্র সাদ্দাম হোসেনের উচ্চাভিলাষী অভিপ্রায়ের কারণে...
১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাক কর্তৃক ইরান আক্রমণের মাধ্যমে ইরাক-ইরান যুদ্ধের যে দামামা বাজে, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে তার সমাপ্তি ঘটে ১৯৮৮ সালের ২০ আগস্ট। কিন্তু এরপরও প্রায় দুই বছর কেটে গেলেও, দুই পক্ষের মধ্যে কোনো শান্তিচুক্তির লক্ষণ দেখা যায় না।
অবশ্য ১৯৯০ সালের জুলাইয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন জেনেভায় সাক্ষাৎ করেন, তখন শান্তির সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বলই মনে হচ্ছিল। অনেকেই ধারণা করে, এবার বুঝি ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেন সব বিবাদের মীমাংসা করবেন, এবং তার সেনাবাহিনীর দখল করে রাখা ভূমি ফিরিয়ে দেবেন।
কিন্তু এর মাত্র সপ্তাহ দুয়েক পরেই, এক ভাষণে সাদ্দাম হোসেন অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র কুয়েতের দিকে। তিনি বলেন, কুয়েত নাকি দুই দেশের সীমান্তবর্তী আর-রুমালিয়া তৈলক্ষেত্র থেকে অবৈধভাবে তেল উত্তোলন করছে। এছাড়া তিনি অভিযোগ করেন, কুয়েত ও সৌদি আরব তেলের দাম কম রাখার চক্রান্ত করছে, যেন পশ্চিমা তেল-ক্রয়কারী দেশগুলোকে হাতে রাখা যায়।
তিনি আরো বলেন, ইরানের সাথে তার দেশ যে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তার ফলে ওই দুই দেশই যথেষ্ট লাভবান হয়েছে, কেননা যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি ইরানের হাত থেকে মধ্যপ্রাচ্যকে রক্ষা করেছেন। সুতরাং তিনি দাবি জানান, কুয়েত ও সৌদি আরবের কাছে ইরাকের যে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ রয়েছে, তা যেন মওকুফ করে দেয়া হয়।
কুয়েত সাদ্দাম হোসেনের এই ভাষণের সকল অভিযোগ ও দাবিকে অস্বীকার করে। কিন্তু সাদ্দাম হোসেন তো থেমে থাকার পাত্র নন। তিনি কুয়েতের সীমান্তে প্রচুর পরিমাণ সেনা মোতায়েন করতে শুরু করেন। সাদ্দাম হোসেনের এই কর্মকাণ্ডে সতর্ক হয়ে যান মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক। তিনি ইরাক ও কুয়েতের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দেবার উদ্যোগ গ্রহণ করেন যেন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা বাইরের কোনো শক্তি উপসাগরীয় অঞ্চলে হানা দিতে না পারে।
কিন্তু সাদ্দাম হোসেন মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ওই তথাকথিত সমঝোতায় জল ঢেলে দেন, এবং আদেশ দেন কুয়েত দখলের। তার ধারণা ছিল, অন্যান্য আরব দেশগুলো ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখল করতে দেখে তার পাশে দাঁড়াবে, এবং বহিঃশক্তিদেরকে ডেকে আনবে না।
এরকম চিন্তা থেকেই ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট স্থানীয় সময় রাত দুটোর দিকে ইরাকি বাহিনী আক্রমণ করে তাদের প্রতিবেশী দেশ কুয়েতকে। আকস্মিক এই আক্রমণে ১২ ঘণ্টার মধ্যেই কুয়েতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। অনেক বাহিনীকে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। আর যারা বেঁচে যায়, তারা পিছু হটে চলে যায় সৌদি আরবে। এদিকে কুয়েতের আমির, তার পরিবার, এবং অন্যান্য সরকারি নেতারাও সবাই সৌদি আরবে পালিয়ে যান।
ইরাকিরা কুয়েত সিটি দখল করে নেয়, এবং সেখানে একটি প্রাদেশিক সরকারও প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। সাদ্দাম হোসেন একে ইরাকের ১৯তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। আর তার এই আগ্রাসনের ফলে এক হাজার কুয়েতি নাগরিকের মৃত্যু ঘটে। সৌদি আরবসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় আরো চার লক্ষ মানুষ। কুয়েত দখলের মাধ্যমে ইরাকের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে বিশ্বের মোট মজুদকৃত তেলের ২০ শতাংশ। এছাড়া প্রথমবারের মতো তাদের নাগালে আসে পারস্য উপসাগরের বেশ বড়সড় একটি উপকূলীয় অঞ্চলও।
এদিকে সাদ্দাম হোসেনের পূর্বানুমানকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে, ২১ সদস্যবিশিষ্ট আরব লিগের দুই-তৃতীয়াংশ ইরাকি আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানায়। এছাড়া সৌদি আরবের কিং ফাহাদ এবং সেখানে নির্বাসিত প্রবাসী কুয়েত সরকার যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট) অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে সাহায্য চায়।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও সর্বসম্মতিক্রমে ইরাকের কুয়েত আক্রমণের নিন্দা জানায় এবং ইরাকের প্রতি আহ্বান জানায় যেন তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কুয়েত ত্যাগ করে। ৬ আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদ বিশ্বব্যাপী ইরাকের সাথে বাণিজ্যের উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
৯ আগস্ট সৌদি আরবের আমেরিকান প্রতিরক্ষা বাহিনী অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড শুরু করে, যারা পারস্য উপসাগর অভিমুখে ধাবিত হয়। অপরদিকে ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন কুয়েতে সেনাসদস্যের পরিমাণ বাড়িয়ে তিন লক্ষে নিয়ে যান।
২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে 'রেজল্যুশন ৬৭৮' পাস হয়। সেখানে হুঁশিয়ারি জানিয়ে বলা হয়, ইরাক যেন ১৯৯১ সালের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে কুয়েত থেকে সকল সৈন্য অপসারণ করে নেয়, অন্যথায় জাতিসংঘ ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে বাধ্য হবে।
সাদ্দাম হোসেন এবারও কুয়েত থেকে সৈন্য অপসারণ করতে অস্বীকৃতি জানান। নিরাপত্তা পরিষদের বেঁধে দেয়া সময় যত ঘনিয়ে আসতে থাকে, ৩৪টি দেশের প্রায় সাত লক্ষের মতো মিত্রবাহিনীর সৈন্য (যাদের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের, তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য ছিল ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, মিশর, তুরস্ক ইত্যাদি দেশেরও) মধ্যপ্রাচ্যে এসে জড়ো হতে থাকে।
১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি, অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সময়ের এক দিন পর, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকের উপর শুরু হয় অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম। আর এভাবেই সূচনা ঘটে পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের। প্রতিদিন ইরাকে সহস্রাধিক বিমান হামলা শুরু হয়, যার বেশিরভাগই পরিচালিত হয় সৌদি আরবের মাটি থেকে। অল্প সময়ের মধ্যেই মিত্রবাহিনী ইরাকের বিমানবাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়।
পরের ছয় সপ্তাহ ধরে মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধ চলে ইরাকের। ইরাকের বিমানবাহিনী তো ধ্বংস হয়ে যায়ই, পাশাপাশি ইরাকের অন্যান্য বাহিনীর অবস্থাও ছিল তথৈবচ। যুদ্ধের এই পর্যায়ে সাদ্দাম হোসেনের একমাত্র উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল ইসরায়েল ও সৌদি আরবের উপর মিসাইল আক্রমণ। সাদ্দাম হোসেন ভেবেছিলেন, মিসাইল আক্রমণের মাধ্যমে ইসরায়েলকে যুদ্ধে উসকে দেয়া যাবে, এবং একবার ইসরায়েল ইরাকের উপর হামলা চালালে অন্যান্য আরব দেশগুলোর সহানুভূতি আদায় করা যাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে ইসরায়েল যুদ্ধে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকে। বরং মিত্রবাহিনীই একে একে ইরাকের যাবতীয় অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দিয়ে দেশটিকে পুরোপুরি খোঁড়া করে দেয়। একই অবস্থা করা হয় ইরাকের অধীন কুয়েতের সামরিক স্থাপনাগুলোরও।
২৪ ফেব্রুয়ারি নাগাদ যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পুরোপুরি ইরাকের হাতের বাইরে বেরিয়ে যায়। মিত্রবাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে ইরাকি সেনাবাহিনীর সেকেলে সরঞ্জাম কোনো কাজেই আসছিল না। তাই ওইদিনই ইরাকি সেনাবাহিনী অনেকটা হার মেনে নেয়। ১০,০০০ ইরাকি সৈন্যকে জেলে বন্দি করা হয়, এবং ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি এয়ার বেস স্থাপন করা হয়। এর চারদিনেরও কম সময়ের মধ্যে কুয়েত স্বাধীন হয়ে যায়।
২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। ৩ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাশ হয় 'রেজল্যুশন ৬৮৭', যেখানে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দেয়া হয়। বলা হয়, বুশের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা আনুষ্ঠানিক হবে, কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে, কিন্তু ইরাকি তেল বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে, যতদিন না তারা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে 'ওয়েপনস অভ মাস ডেস্ট্রাকশন' ধ্বংস না করে। ৬ এপ্রিল ইরাক এই শর্তসমূহ মেনে নেয়, এবং ১১ এপ্রিল নিরাপত্তা পরিষদ এটিকে কার্যকর ঘোষণা করে।
পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধে ১৪৮ জন মার্কিন সেনার মৃত্যু হয়, এছাড়া আহত হয় আরো ৪৫৭ জন। মিত্রবাহিনীর অপরাপর দেশগুলো মিলিয়ে প্রায় ১০০ জনের মতো মৃত্যুবরণ করে। এদিকে ইরাকি হতাহতের কোনো নিশ্চিত সংখ্যা পাওয়া যায় না। তবে বলা হয়ে থাকে, এই যুদ্ধে অন্তত ২৫,০০০ ইরাকি সৈন্যের মৃত্যু হয়, আর আহত হয় ৭৫,০০০ এর বেশি। আরো প্রায় লক্ষাধিক ইরাকি সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয় যুদ্ধাহত হয়ে, কিংবা পানি, খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে। এছাড়াও পরবর্তী বছরগুলোতে মৃত্যুবরণ করে আরো দশ লক্ষের বেশি সাধারণ ইরাকি নাগরিক।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন