সাবরা ও শাতিলা গণহত্যা: ইসরায়েলি সেনাদের যে নির্মমতার বিচার হয়নি আজও!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
লেবাননের সাবরা ও শাতিলা শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলো হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। সেই শরনার্থী শিবিরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে মাত্র ৩৬ ঘন্টায় পাঁচ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল ইসরায়েলি সেনারা!
যারা একটু হলেও ভূ-রাজনীতি নিয়ে খবর রাখেন, তারা সবাই ইসরাইল ও প্যালেস্তাইনের দ্বন্দ্ব নিয়েও বেশ ওয়াকিবহাল। প্যালেস্তাইনের সীমান্তে ইসরাইলের ঢুকে যাওয়া এবং একটা সময়ে এসে প্যালেস্তাইনকেই কোনঠাসা করে দেয়ার যে গল্প, সে গল্পের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় রয়েছে বিচিত্র সব চমক, বিষাদ ও রক্তপাতের গল্প। তবে প্যালেস্তাইনদের উপর ইসরাইলি বর্বরতার সর্বশ্রেষ্ঠ গল্প যদি বলতে হয়, তাহলে সেখানে অবধারিতভাবে আসবে সাবরা ও শাতিলা শরনার্থী শিবিরে চালানো বর্বরতম ধ্বংসযজ্ঞ।
সে ধ্বংসযজ্ঞের উপাখ্যানে যাওয়ার আগে প্রথমেই যেতে হবে সিধুজ্যাঠার ইতিহাসের নোটখাতায়। ইসরাইল ও প্যালেস্তাইনের সংঘর্ষের সূত্রপাত কবে থেকে, সেটা নিয়ে সবাই জানেন। সে আলাপে না যাই বরং। তবে ইসরাইল- প্যালেস্তাইনের ক্রমাগত সংঘর্ষ যখন বাড়াবাড়ি আকার ধারণ করেছিলো, সেরকমই এক সময়ে ১৯৬৪ সালের দিকে ফিলিস্তিনিদের উদ্যোগে গঠিত হয় পিএলও বা প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন। এদের প্রধান কাজ ছিলো ইসরাইলের সহিংসতা থেকে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বাঁচানো।
ইসরাইলিদের সহিংসতায় অনেক ফিলিস্তিনি অবস্থান নিয়েছিলো লেবাননে। পিএলও- এর অজস্র নেতাকর্মীও লেবাননেই ঘাঁটি গেড়েছিলো। এরইমধ্যে লেবাননে শুরু হয়ে গৃহযুদ্ধ। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা চলতে থাকা এ গৃহযুদ্ধে মারা যায় অজস্র নিরীহ মানুষজন। এক পর্যায়ে এসে লেবাননের গৃহযুদ্ধে যুক্ত হয় ইসরাইলি সেনারা। পিএলও এর সাথে ইসরাইলি সৈন্যদের তিন মাস ব্যাপী সংঘর্ষ হয়, পিএলও পিছু হটে একসময়ে। ইসরাইলি সৈন্যরা দখল নিয়ে নেয় লেবাননের।
ইসরাইলি সেনাদের ইচ্ছে ছিলো, লেবানন থেকে পিএলও এর সব সদস্যকে চিরতরে নির্মূল করে দেবে তারা। কিন্তু রাজনৈতিক কিছু কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছিলো না। লেবানিজ ফোর্সের বশির জামায়েল লেবাননের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার সাথে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনশান বেগিন কয়েকটা চুক্তি করেন, যার মধ্যে একটি ছিলো- পিএলও এর সেনাদের তুলে দিতে হবে ইসরাইলের হাতে। কিন্তু বশির জামায়েল তাতে রাজী হলেন না। দুইপক্ষের তর্কাতর্কির মধ্য দিয়ে পিএলও এর সদস্যরা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীর সহায়তায় দেশ ছেড়ে চলে যায়। এতে করে ক্ষিপ্ত হয় ইসরাইলি প্রশাসন। হাতের শিকার হাত ফসকে চলে গেলে কারই বা ভালো লাগে?
বিষয়টি মেনে নিতে পারেন নি ইসরায়েলি রণমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন। তিনি গুজব ছড়াতে থাকেন, লেবাননের উদ্বাস্তু শিবিরে কিছু পিএলও গেরিলা গা ঢাকা দিয়ে আছে। ইসরাইলি বাহিনীকে তিনি খেপিয়ে দেন উদ্বাস্তু শিবিরে আক্রমণ করার জন্যে। এরমধ্যেই ঘটে আরো কিছু ঘটনা। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী লেবানন ত্যাগ করে। নিজ কার্যালয়ে এক বোমা বিস্ফোরণে ২৬ কর্মকর্তাসহ বশির মারা পড়েন। এই হামলার পুরো দায় এরিয়েল শ্যারন চাপান পিএলওর উপর। সাধারণ লেবানিজদের বোঝানো হয়, শরনার্থী ফিলিস্তিনরা হামলা করে তাদের প্রেসিডেন্টকে মেরেছে, একসময়ে তারা সাধারণ লেবানিজ নাগরিকদের জন্যেও হুমকি হয়ে আসতে পারে।
শান্তিরক্ষী বাহিনী নেই, বশির মৃত, লেবাননের সাধারণ জনতা খেপে আছে ফিলিস্তিনি শরনার্থীদের উপর, এরকমই এক মওকার অপেক্ষাতেই ছিলো ইসরাইল। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শরনার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিলো যে দুই শরনার্থী শিবিরে, সাবরা ও শাতিলা নামের সেই দুই শরনার্থী শিবিরে অবস্থান নেয় ইসরাইল ও মার্কিন মদদপুষ্ট লেবাননের ম্যারোনাইট খ্রিস্টানপন্থী ফালাঞ্জিস্ট জঙ্গিরা। ১৬ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলায় তারা হামলা চালায় এই দুই শরনার্থী শিবিরে।
নৃশংসতার সব সীমা লঙ্ঘন করে তারা। সাবরা ও শাতিলা শরনার্থী শিবিরের অধিকাংশই ছিলেন নারী, শিশু ও বৃদ্ধ মানুষজন। শুধু ফিলিস্তিনিই নয়, এর মাঝে ছিলেন ১৪০ জন লেবানিজও। ১৬ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যা ছয়টা থেকে শুরু করে ১৮ সেপ্টেম্বর সকাল আটটা পর্যন্ত চলা, মোট ৩৬ ঘণ্টার গণহত্যায় তারা খুন করেন পাঁচ হাজারের কাছাকাছি নিরীহ ফিলিস্তিনিকে! ১৬ তারিখ সন্ধ্যার দিকে গিয়ে শরনার্থী শিবিরের ঘরে ঘরে ঢুকে তারা গুলি করে মানুষ মারলেও এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়া শুরু করেছিলো সকাল বেলাতেই। পানির লাইন থেকে যখন শরনার্থীরা সকালের পানি সংগ্রহ করছিলেন, তখনই তাদের উপর নির্বিচারে গুলি ছোড়া শুরু করে জঙ্গিরা।
একজন স্থানীয় ডাক্তারের থেকেও শোনা যায়, হাসপাতালে হাজার হাজার রক্তাক্ত মানুষ ছুটে এসেছিলো সেদিন। হাসপাতালের এমন কোনো জায়গা ছিলো না, যেখানে রক্তের দাগ আর মানুষের কালো মাথা ছিলো না। সেখানেও ঘটে বর্বরতা। যেসব নার্স রোগীদের সেবা দিচ্ছিলো তাদেরকে ধরে ধরে ধর্ষণ করে জঙ্গিরা।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড হার্স্ট, যিনি বহুবছর যাবত ইসরায়েলি– ফিলিস্তিনি সংঘর্ষ নিয়ে কাজ করছেন, তাঁর ‘The Gun & The Olive Branch’ বই থেকে জানা যায় আরো কিছু রোমহষর্ক তথ্য। ছোট ছোট বাচ্চাদের স্রেফ চিরে ফেলতো জঙ্গিরা অথবা মাথা ফাটিয়ে মগজ বের করে আনতো। মহিলাদের ধর্ষণ করে স্তন, যৌনাঙ্গ কেটে দিতো, চামড়া ছিলে দিতো, যৌনাঙ্গে বেয়নেট বা রডও ঢুকিয়ে দিতো। এক মা সন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন, সে অবস্থায় তাকে গুলি করা হয়। সন্তান এবং মায়ের দেহ ঝাঁঝরা হয় অজস্র বুলেটে। উপড়ে নেয়া হয় অসংখ্য মানুষের চোখ। রাতেও ধ্বংসযজ্ঞ, ধর্ষণ, খুন যাতে ঠিকভাবে করা যায় তাই আলো জ্বালিয়ে রাখতো জঙ্গিরা। আতশবাজিও ফোটাতো। গলা কেটে চেইন নেওয়া, আঙ্গুল কেটে আংটি নেওয়া সহ যত রকমের লুটতরাজ দরকার... সবই করেছে তারা৷
এ ঘটনা আসলে হার মানিয়েছে অনেক গনহত্যাকেই। এই ঘটনার পরে নড়েচড়ে বসেছে অনেক রাষ্ট্রই। এরিয়েল শ্যারনকে 'বৈরুতের কসাই' উপাধিও দেওয়া হয়েছে, কারণ পুরোটাই হয়েছে তার ইন্ধনে। কিন্তু অবাক হলেও এটাই সত্যি, এই ঘটনার সাথে জড়িতদের কোনো বিচারই হয়নি আর। আরেকটু অবাক হবেন, এরিয়েল শ্যারন নামের এই লোকটিই পরবর্তীতে হয়েছিলেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী। এই ঘটনার পরে পেরিয়ে গিয়েছে ৩৮টি বছর। এখনো পর্যন্ত ঘটনাটির কুশীলবেরা রয়ে গিয়েছেন ধরাছোঁয়ারই বাইরে।
প্রত্যেক বছর ক্যালেন্ডারে ১৬ই সেপ্টেম্বর এলে হয়তো সাবরা ও শাতিলার মাটি একটু হলেও কেঁপে ওঠে ভয়ে ও আশঙ্কায়, বিগত ইতিহাসের নষ্টালজিয়ায়। অতটুকুই। ইতিহাস এই ঘটনার সাথে জড়িত নৃশংস পশুদের মনে রাখলেও আর কেউ মনে রাখেনি কেন যেন। বহাল তবিয়তেই তারা জীবনযাপন করে গিয়েছে। অপরাধের শাস্তি আর ভোগ করতে হয় নি তাদের কোনোদিনই। কে ঠিক কে ভুল সে আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু পাঁচ হাজার মানুষের লাশের কোনো ক্ষতিপূরণ পেলো না কেউ কোনোদিন, আফসোস ঠিক এখানেই।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন