তিন মেয়ে মিলে ছুরি, হাতুড়ি, পিপার-স্প্রে ব্যবহার করে নৃশংসভাবে খুন করেছে তাদের বাবাকে। পরে পুলিশের কাছে গিয়ে তারা আত্মসমর্পণও করেছে। স্বীকারোক্তিতে তারা হত্যাকান্ডের কারন হিসেবে যা জানিয়েছে, তাতে তোলপাড় শুরু হয়েছে গোটা রাশিয়াজুড়ে...

২০১৮ সালের দিকে রাশিয়ায় একটি হত্যাকান্ড নিয়ে বেশ চাঞ্চল্য তৈরী হয়৷ মিখাইল খাচাতুরিয়ান নামের সাতাত্তর বছর বয়সী এক লোক নৃশংসভাবে খুন হন। এই ঘটনার পরপরেই উঠে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য- মিখাইলেরই তিন মেয়ে একত্রে যুক্ত হয়েই নাকি নৃশংসভাবে খুন করেছে মিখাইলকে! গা শিউরে ওঠা এই তথ্যের পরেই খুনের পুরো বিষয়টি মোড় নেয় নাটকীয়ভাবে। গল্পের যে মোড় নাটকের পান্ডুলিপির চেয়েও নাটকীয়!

মিখাইল খাচাতুরিয়ানকে হত্যার পর তার তিন মেয়ে ক্রেস্টিনা, অ্যাঞ্জেলিনা আর মারিয়া খাচাতুরিয়ান চলে যান পুলিশের কাছে। তারা আত্মসমর্পণ করেন এবং জানান- তাদের বাবা নিয়মিত যৌন নির্যাতন করতো তাদের উপরে!  ঘটনার সূত্রপাত অনেকদিন আগে থেকে। যখন তিন বোনই বয়সে ছোট ছিলো, তখন থেকেই বাবার হিংস্রতায় ক্রমশ বিপর্যস্ত হচ্ছিলো তারা। অমানুষ এই লোকটির ভয়ে সবসময়েই তটস্থ থাকতো তারা। মিখাইলের কাছে সবসময় একটি বিশেষ ঘন্টা থাকতো। যে ঘন্টা মাঝেমধ্যেই বাজাতেন তিনি। সে ঘন্টা বাজালেই তিন বোনের মধ্যে যেকোনো একজনকে যেতে হতো মিখাইলের কাছে। মিখাইল নানারকম হুকুম দিতেন তাদের৷ যেগুলো মাঝেমধ্যে সভ্যতা-ভব্যতার সীমাও ছাড়িয়ে যেতো। এভাবেই চলছিলো। এরকম অসভ্য আচরণের জন্যে মিখাইলের মধ্যে কোনো অনুশোচনাবোধও আসেনি কোনোদিন৷ তিনি মেয়েদের মাঝেমধ্যেই বলতেন, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক খারাপ। তবে তিনি যেহেতু বাবা। তিনি যা খুশি তাই করতে পারেন, তাদের সাথে।

এই তিন বোনের মা ও মিখাইলের স্ত্রীও মিখাইলের শারিরীক ও যৌন সহিংসতার শিকার হতেন নিয়মিত৷ মিখাইলের বিরুদ্ধে নালিশ করতে পুলিশের কাছেও যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে প্রথমেই তাদের কাছে যাননি তিনি। কারণ, মিখাইলের সাথে পুলিশের ভালো খাতির। গেলে খুব একটা লাভ হতো না। বরং সমস্যাই বাড়তো। তবু শেষে বাধ্য হয়েই তিনি পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু বলাবাহুল্য, কোনো লাভ হয়নি। পুলিশ কোনো বিচার করেনি। পরবর্তীতে মিখাইল তার স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মেয়ে তিনজনকে মিখাইল এরপর তাদের মা ছাড়াই রেখে দেয় বাড়িতে।

২০১৪ সালের দিকে মিখাইল তার ছোট মেয়ে ক্রেস্টিনাকে বাড়িতে একলা পেয়ে এমন কিছু করতে বলেন যা তীব্র যৌন-স্পর্শ সংক্রান্ত। বাবার ভয়ে মেয়ে বাধ্য হয়েই তার হুকুম তামিল করে। পরে এই ঘটনা সে তার অন্য বোন অ্যাঞ্জেলিনার সাথে শেয়ার করেন। অ্যাঞ্জেলিনা জানান, তাকেও এরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বেশ ক'বার। বাবার যৌন নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন অ্যাঞ্জেলিনা। 

এরপরই তিন বোন মিলে ফন্দী আঁটেন, এই পিশাচকে নিকেশ করার জন্যে। ২০১৮ সালের দিকে এক রাতে বাবা ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় বাবাকে ছুরি ও হাতুড়ি দিয়ে কুপিয়ে  খুন করে তিন বোন। এই ঘটনা জানাজানি হলে রাশিয়ায় শুরু হয় তুমুল চাঞ্চল্য। কেউ কেউ বলেন, মেয়ে তিনজন অন্য কোনো কারণে বাবাকে হত্যা করে এখন একটি সাজানো গল্প বলছে। কেউ কেউ বলেন- এরকম পিশাচের এই শাস্তিই একেবারে ঠিক হয়েছে৷ পুরো রাশিয়া দুইখণ্ডে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল, মিটিং, সভা সেমিনার, আলোচনা, কবিতাপাঠ হচ্ছে। মানুষ কথা বলছে। এই মামলাটি আলোড়িত করেছে রাশিয়ার অধিকাংশ মানুষকেই। এখন পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ মানুষ এই তিন মেয়ের মুক্তির জন্যে পিটিশনে স্বাক্ষরও করেছে!

পুলিশের কাছে সবই স্বীকার করেছেন তারা! 

কেউই আসলে জানে না, কোন ঘটনা সত্যি, কোন ঘটনা ভুল। কিন্তু তিন বোন যে সহিংসতার কথা বললেন, গৃহস্থালিতে এরকম সহিংসতার শিকার নারীদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। বাংলাদেশের কথা যদি তুলনা করি, ক্রমশই 'ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স' এ আক্রান্ত ভিক্টিমের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাচ্ছে কাছেদূরের সব দেশকে। সরকার আইন করে, বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে এই বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু নানা কারণে সহিংসতার শিকার নারীরা সামনে আসছেন না। ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। অপরাধীরা মওকা পাচ্ছে। এবং নারীরা যে তাদের পরিবারের খুব কাছের মানুষদের কাছেও নিরাপদ না, তার স্বপক্ষেও নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে ক্রমশ।

যদি এ ঘটনা সত্যি হয়, তাহলে বলতে হবে- রাশিয়ার এই তিন বোন যেভাবে এগিয়ে এসেছে অন্যায়ের বিচার করতে, নিশ্চিতভাবেই তা অনেকের জন্যেই অনুপ্রেরণার কারন হবে। এভাবে নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিবাদের সংস্কৃতি শুরু হলে মানুষ আর অমানুষের পার্থক্য ধরা পড়বে নিয়মিত, সবার চোখে। সেটাই হবে প্রাসঙ্গিক ও সুন্দর।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা