রুদালি: মরা বাড়িতে কান্না করাটাই যাদের একমাত্র পেশা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

অদ্ভুত হলেও সত্যি, মরা বাড়িতে কান্নাকাটি করাই এই মহিলাদের কাজ। কেউ মারা গেলে এই মানুষগুলোকে ভাড়া করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় কান্নাকাটি করার জন্য। কিন্তু এই অদ্ভুতুড়ে পেশা কেন বেছে নিলেন তারা?
জেমসের বিখ্যাত 'এক নদী যমুনা' গানটির একটি লাইন আছে এরকম- 'কান্নায় লাভ নেই।' কথাটা সত্যি। কান্নার সাথে কখনো কী লাভের সম্পর্ক দেখানো সম্ভব? কান্নায় বরাবরই ক্ষতি, দুঃখ, বিষাদ। এটাই জেনে এসেছি আমরা সবসময়ে। তবে তারপরেও একটা প্রশ্ন। কখনো কী ভেবেছেন, কান্নায় হতে পারে লাভ? চোখের অশ্রু, যেটাকে আপনি-আমি ভাবি অমূল্য জিনিস, যাকে টাকা দিয়ে পরিমাপ করার চেষ্টাও করি না আমরা...কখনো কী ভেবেছেন, সে অশ্রু দিয়েও হতে পারে ব্যবসা? যদি না ভেবে থাকেন, তাহলে এই লেখার পরবর্তী অংশ আপনার জন্যে। রাজস্থানের রুদালিদের গল্পের আপনিই উপযুক্ত পাঠক।
রাজস্থানের রুদালিদের পেশা খুব অদ্ভুত৷ এরা কেঁদে টাকা রোজগার করেন৷ না, ভুল পড়েননি। এটাই লিখেছি। তারা ভাড়ায় কান্না করেন। আমাদের দেশে যেমন টাকার বিনিময়ে অনেকে মিছিলে, সমাবেশে যায়, এও অনেকটা তেমনি। ধরা যাক, কোনো গ্রামের কেউ একজন মারা গিয়েছেন। এদেরকে একটা খবর দিলেই হবে। চুক্তি পাকা হয়ে গেলে এরা মরাবাড়িতে এসে মাটিতে বসে, মাথা কুটে, কপাল চাপড়ে, বুক থাপড়ে যে কান্না করবে... আপনি নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে যাবেন আসলেই এরা কান্না করছে নাকি অভিনয়, তা ভেবে। কেউ মারা গেলে যখন তাদের ডাকা হয়, তারা সবসময়ে কালো শাড়ি পড়ে আসে। এটাই তাদের ড্রেসকোড। মৃত্যুর দেবতা যমরাজের পছন্দের রঙ কালো। এ কারণেই এই মহিলারা কালো রঙের ড্রেস পড়ে থাকেন। কালো রঙ এর শাড়ি পড়ে একত্রে এসে সমবেত-স্বরে কান্নার এই কাজটি করে থাকেন তারা।

রাজস্থানের নীচুশ্রেনির এই মহিলাদের পেশাকে আপনি অদ্ভুতুড়ে, উদ্ভট ভাবতেই পারেন। তবে এই পেশার উদ্ভবের পেছনে রয়েছে শ্রেনিবৈষম্যের এক করুণ আখ্যান। সাধারণত রাজস্থানের উচ্চশ্রেণির কেউ মারা গেলে কান্নার লোকের অভাব পড়ে। কারণ, নিয়ম অনুসারে বড় পরিবারের নারীদের ঘরের বাইরে মুখ দেখানো মানা। তারা মহলের মধ্যে বসে শোকসন্তপ্ত হয়ে বসে থাকবে। বাইরে আসতে পারবেন না। পরিবারের পুরুষেরা অন্তেষ্টিক্রিয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। কান্নার তো কেউ নেই। ঠিক তখনই ডাক পড়ে এই রুদেলি'দের। টাকার বিনিময়ে তাদের চোখের জল কিনে নেয়া হয়। এবং একনাগাড়ে টানা তাদেরকে কেঁদে যেতে হয় বেশ ক'দিন। রাজস্থানের উচ্চপরিবারগুলো ধরেই নেয়, তাদের পরিবারের প্রয়াত মানুষের জন্যে যতদিন বেশি কান্না হবে, ততই তাদের বংশগরিমা প্রকাশিত হবে। অর্থাৎ পাতানো শোকের স্থায়িত্বের পেছনেও কাজ করে বংশগরিমার দাপট।
টানা এভাবে যে এতদিন কেঁদে যায় রুদেলিরা, তাদেরকে কী অনেক টাকা দেয়া হয়? মোটেও না। মাথাপিছু পনেরো অথবা বিশ রূপি পায় তারা। সাথে বাসি কিছু খাবার ও পুরোনো কিছু পোশাক। এগুলো নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। কিছু তো করারও নেই। রুদেলিরা এমনিতেই সমাজের সবচেয়ে নীচের প্রকোষ্ঠের মানুষ। এদের উপরে উচ্চশ্রেণীর পরিবারগুলোর ক্রমাগত শোষণ তো আছেই, তার পাশাপাশি এইসব পরিবারের পুরুষেরা মাঝেমধ্যেই রুদেলি নারীদের জোর করে শারিরীকভাবে ভোগ করে গর্ভবতী করে দিয়ে যেতো। এসব নারীদের সন্তানেরা বড় হতে থাকতো অবৈধ সন্তান হিসেবে। এই রুদেলিদের না আছে সামাজিক নিরাপত্তা, না আছে সামাজিক মর্যাদা, না আছে সম্মান বা অন্যকিছু। শুধুমাত্র অর্থের জন্যেই তাদেরকে এই পেশায় আসতে হয়েছে তাই। এবং এই পেশাটাই একমাত্র সম্মানজনক পেশা তাদের জন্যে।
এবার প্রশ্ন আসতে পারে, দুঃখবোধ না আসলে এভাবে একনাগাড়ে অনর্গল কান্না কিভাবে সম্ভব? এটা তো আর বাংলা সিনেমা না যে, চোখে গ্লিসারিন ডলে অশ্রুজলে সিক্ত করা যাবে সব। হ্যাঁ, কথা সত্যি। এভাবে কৃত্রিমভাবে কান্না করা আসলে কষ্টসাধ্যও বেশ। সাধারণত রুদালিরা তাই চোখে জল আনার জন্যে তাদের কষ্টময় জীবনের কথা ভাবেন, সে সাথে একধরণের লতাও চিবোন যাতে চোখে জল আসে, চোখে ঝাঁঝালো কিছু পদার্থও দেন। এভাবেই টানা কান্না করা সম্ভব হয় তাদের জন্যে।

রুদালিদের এই পেশা নিয়ে আমরা চাইলে হাসাহাসি করতে পারি, বিদ্রুপ করতে পারি। কিন্তু যদি পেছনের গল্প বুঝতে চেষ্টা করি, তাহলে হাসি মুখে আসার আগেই মিলিয়ে যাবে কোথাও। জীবন এই প্রান্তিক মানুষদের এমনই নীচে নামিয়েছে, যেখানে অত্যাচারীর মৃত্যুতে গিয়েই অল্পক'টা টাকার জন্যে কান্নার ভান করতে হয় তাদের। সমাজ তাদের এতটাই 'ছিবড়ে' বানিয়েছে, নিজেদের চোখের জলও হয়ে গিয়েছে তাদের ব্যবসার পণ্য। তবে যাই হোক, এই পেশা যেরকমই বিদঘুটে লাগুক না কেন, এই কান্নার বদৌলতেই কিছু টাকা তাদের ঘরে আসতো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের একমাত্র পেশাটিও এখন ক্রমশ বিলীন হওয়ার মুখে। মানুষ এখন ক্রমশ শহরকেন্দ্রিক হয়েছে, কারো মৃত্যুতে কান্নার এই বিশাল দক্ষযজ্ঞকে 'ওল্ড ফ্যাশন' ভাবে তারা। এসব কারণে কমে এসেছে রুদালি'দের পেশার গণ্ডি।
এভাবে আর ক'দিন তারা এই পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে পারবেন, সেটাই বিষয়।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন