
অসুস্থ ভাইকে ফেলে গেছে বোন, অচেতন হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ভয়-আতঙ্ক সব ভুলে এগিয়ে এসেছেন ফটো সাংবাদিক রুবেল রশিদ, প্রমাণ করেছেন, আপনার-আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য কেউ না কেউ আছে...
ছবিতে অচেতন অবস্থায় যে যুবকটিকে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে, তার নাম আল আমিন। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে এসেছিলেন করোনা পরীক্ষা করাতে, সঙ্গে এসেছিলেন তার বড় বোন। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার এক পর্যায়ে বোন তাকে অপেক্ষা করতে বলে গায়েব হয়ে গেলেন, করোনার উপসর্গ থাকা ভাইকে একা রেখেই! দুর্বল শরীর নিয়ে বসে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লেন আল আমিন। ছবিগুলো তখন তোলা। কি অমানবিক একটা চিত্র, তাই না? করোনা আমাদের অনেকের মুখ থেকে হিংস্রতার মুখোশটা উপড়ে ফেলেছে, নির্মমতাগুলোকে টেনে বের করেছে মনের ভেতর থেকে।
একটু দাঁড়ান। গল্পের মন খারাপ করা অংশটা তো শুনলেন, মন ভালো করা অংশটুকু শুনবেন না? ঘটনাটা গতকাল দুপুরের। আল আমিন যখন অচেতন হয়ে পড়ে আছেন মুগদা হাসপাতালের সামনে, তখন সেখানে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলেন দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার ফটো সাংবাদিক রুবেল রশিদ এবং ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের ফটো সাংবাদিক সৌরভ লস্কর। তারা এসেছিলেন মূলত করোনা টেস্টের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ছবি তুলতে। কিন্তু এসে যা দেখলেন, তাতে হতবাক হয়ে গেলেন তারা। হাসপাতালের সামনে প্রখর রোদের মধ্যে একটি ছেলে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে, অথচ একটা মানুষও এগিয়ে যাচ্ছে না তাকে সাহায্য করার জন্যে, কারণ করোনা নিয়ে আতঙ্ক।

রুবেল রশিদ বা সৌরভ লস্কর, কেউই পিপিই বা ভালো কোন প্রটেকশন নিয়ে আসেননি। মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস- এটুকুই সম্বল তাদের। কিন্ত বাকীদের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে তামাশা দেখার পথে হাঁটলেন না তারা। দ্রুত কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে রুবেল রশিদ এগিয়ে গেলেন ছেলেটার দিকে। কাছে গিয়ে দেখলেন, শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে, বেঁচে আছে সেই তরুণ। পানির বোতল কিনে তার মুখে ঢাললেন রুবেল, জ্ঞান ফিরলো ছেলেটার। তাকে ধরে বসানো হলো, পানি খেয়ে খানিকটা স্বাভাবিক হতেই সে খুলে বললো তার গল্পটা।
কথোপকথনে জানা গেল, যুবকের নাম আল আমিন। রাজধানীর পুরান ঢাকার নয়াবাজার এলাকায় তার চায়ের দোকান আছে। কয়েকদিন থেকে সর্দি-জ্বরে ভুগছেন। তাই বোনকে নিয়ে মুগদা হাসপাতালে করোনার নমুনা দিতে এসেছিলেন। পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়লে বোন তাকে ওভাবেই রেখে চলে যায়। সেই বোনকে আর ফিরে আসতে দেখা যায়নি।
এই ঘটনাটার ভালো এবং মন্দ দুটো দিকই আছে। একদিকে পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ রোগীকে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে একদম অচেনা-অজানা কিছু মানুষ এসে সাহায্যের হাত বাড়িতে দিচ্ছে, দিচ্ছে মনুষ্যত্বের পরিচয়। করোনায় মারা যাওয়া স্বজনের মৃতদেহ যখন কেউ স্পর্শও করছে না, তখনই নারায়ণগঞ্জের খোরশেদ কমিশনারের মতো মানুষ এগিয়ে আসছেন, ধর্মীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় জানাচ্ছেন।

আবার বোন ফেলে যাওয়ার পর আল আমিনরা যখন অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকছেন, তখন এগিয়ে আসছেন একজন রুবেল রশিদ। নিজের দায়িত্ব মনে করে তিনি অসুস্থ মানুষটার সেবা করেছেন, তার জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছেন। ঝুঁকি নিতে ভয় পাননি, সংক্রমণের আতঙ্ককে তিনি অগ্রাহ্য করেছেন অসীম সাহস আর মমত্ববোধ থেকে। রুবেল রশিদরাই সাংবাদিকতা পেশাটার গর্বিত প্রতিনিধি, ক্লিকবেট শিরোনাম দিয়ে বা বিতর্কিত সংবাদ পরিবেশন করে আলোচনায় থাকতে চাওয়া হিটখোরেরা নয়।
নির্মমতার অজস্র গল্প লেখা হচ্ছে সত্যি, কিন্ত বিশ্বাস করুন, রুবেল রশিদের মতো মানুষেরাই কিন্ত আমাদের সমাজে সংখ্যায় বেশি। কারো বিপদ দেখলে যারা ছুটে যান, সব আতঙ্ককে অগ্রাহ্য করে সেবা-শুশ্রুষায় মত্ত হন। তারা বুঝিয়ে দেন, পৃথিবী যতোই অমানবিক হোক না কেন, কিছু মানুষ থাকেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। আপনারা যারা আল আমিনের অজ্ঞান হয়ে থাকার ছবি শেয়ার করেছেন ফেসবুকে, তারা ফটো সাংবাদিক রুবেল রশিদের ছবিটাও শেয়ার করবেন, যেখানে তিনি পানি খাইয়ে দিচ্ছেন অসুস্থ আল আমিনকে। কারণ এই ছবিটাই আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাবে, আমাদের ভাঙা মনে সাহস এনে দেবে...