বাঙালি মুসলমান এক অদ্ভুত ডাইলেমা'র মধ্যে দিয়ে তাঁদের দিন চালিয়ে যায়। হয়ত সে ব্যাক্তি হিন্দি ছবিতে নিয়মিত ড্যান্স মারে, ভারতের পেঁয়াজ কিংবা গরু ছাড়া তার রোচে না, কিন্তু সেই তিনি-ই চান রণেশ ঠাকুরদের মত সবাই সব কিছু নিয়ে ভারতে চলে যাক...

আব্দুল করিম বয়াতির শিষ্য রণেশ ঠাকুরের গান গাইবার ঘরখানি কে বা কারা পুড়িয়ে দিয়েছে যেটা খোদ রণেশ ঠাকুরের-ই জানা নেই। সুতরাং আমাদেরও জানবার কথা নয়। তিনি আমাদের জানাচ্ছেন যে, তাঁর সাথে কারও শত্রুতা নেই এবং এমন কেন হয়েছে, তিনি তা বুঝতে পারছেন না। 

তবে ধারনা করা যায় এটা এই বাংলাদেশেরই এক শ্রেণীর উগ্র মুসলমানের কাজ। অনেকটা আনসার আল ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম, জামাতুল মুজাহেদীন, হিজবুত তাহরীর বা এই টাইপের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীকে সমর্থন করে এমন মুসলমানের কাজ।

আবার এমনও হতে পারে উপরে উল্লেখিত কোনো গোষ্ঠী-ই না। আশে পাশের মুসলমান প্রতিবেশীদের কেউ, যিনি গান বাজনাকে হারাম কাজ মনে করেন, তারা সংঘবদ্ধ হয়ে এই কাজটি করে গেছেন রাতের অন্ধকারে। 

ছাই এর স্তুপে দাঁড়িয়ে রণেশ ঠাকুরের হতাশাগ্রস্থ মলিন মুখটা দেখে কষ্ট হয়। নিউজ ফিডে ভেসে বেড়াচ্ছে তাঁর মুখটা। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে ছোট করে বের হয়ে আসে, "বেচারা"

এই ঘটনার সূত্র ধরে প্রথমেই চট করে মনে পড়ে যায় আহমদ ছফার বিখ্যাত বই "বাঙালি মুসলমানের মন"। আসলে ছফা বাঙালি মুসলমানকে যেভাবে তীক্ষ্ণভাবে দেখতে পেয়েছেন বা দেখেছেন, আমরা অনেকেই এত গভীর করে ভেবে দেখিনি। ভেবে দেখলে বুঝতে পারতাম বাঙালি মুসলমানের মনের ভেতর ঠিক কতটা কন্ট্রাডিকশন রয়েছে।

ছফার বইটিতে কারবাল পুঁথি সম্পর্কিত বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং অবজার্ভেশন রয়েছে। যেমন কারবাল যুদ্ধে নিহত মহানবীর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেনের কর্তিত মস্তক নিয়ে সীমার দামেস্কে রওয়ানা দিলো তৎকালীন বাদশাহ এজিদের কাছে। এই মস্তক জমা দিতে পারলেই এজিদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ পাওয়া যাবে।

দামেস্ক যাবার পথে সন্ধ্যে নামলে সীমার পথিমধ্যে আজর নাম্নী এক গৃহস্থের বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন। গৃহকর্তা আজর আবার ছিলেন হিন্দু ব্রাক্ষণ। সীমারের হাতে ইমাম হোসেনের কর্তিত মস্তক দেখে, হিন্দু ব্রাক্ষণ তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে মুসলমান হয়ে গেলো।

ছফা আমাদের জানাচ্ছেন,দামেস্কে যাবার পথে হিন্দু ব্রাক্ষণের বাড়ী, তাদের মুসলমান হয়ে ওঠা এসব হচ্ছে এক ধরনের আশ্চর্য রূপকথা। দামেস্কে যাবার পথে হিন্দু ব্রাক্ষণের বাড়ী ব্যাপারটাই হাস্যকর। বরং সেখানে ইরানী, তুরানী, ইহুদি কোনো পরিবার থাকাটাই ছিলো স্বাভাবিক। এই দামেস্কের পথের মধ্যে বাঙালি ব্রাক্ষণ হিন্দু আসবে কোথা থেকে?

ছফা খুঁজে বের করতে চেয়েছেন যে, কেন সেখানে সেসব ইরানি, তুরানি, তুর্কির বদলে হিন্দু ব্রাক্ষণকে আনতে হোলো এই পুঁথি রচয়িতার? 

ছফা খুঁজে বের করলেন আসলে এই কারবালার করুন কাহিনীতে ইমাম হোসেন হেরে গেলেও কিংবা তার কাটা মস্তক সীমারের হাতে শোভা পেলেও, এই কাটা মস্তককে মহিমান্বিত করবার মধ্যে দিয়ে ইসলাম ধর্ম যে একটি ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম, সেটি সাধারণ জনতার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়াই হচ্ছে এই আজগুবি পুঁথির মূল উদ্দেশ্য।

ইমাম হোসেনের কর্তিত মস্তকে ঘটনায় বাঙালি মুসলমান যখন কষ্টে জর্জরিত, ঠিক সেই দুঃখের মধ্যে এক পশলা উচ্ছাস এনে দেয় সেই হিন্দু ব্রাক্ষণের মুসলমান হয়ে ওঠা। এতে করে বাঙালি মুসলমান সান্তনা খুঁজে পায় যে, ইমাম হোসেনের কাটা মাথার-ই কত ক্ষমতা। আসলে সীমার যে মাথা কেটে নিয়ে যাচ্ছে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা পরীক্ষা। ঠিক এইভাবে এই পরাজয়ের মধ্যেও বাঙালি মুসলমান এক ধরনের আনন্দ ও শক্তি খুঁজে পায়।

ছফার এই অবজার্ভেশনের সাথে সাথে সমান্তরাল ভাবে আমি আরো কিছু অবজার্ভেশনের গল্প বলতে পারি। যেগুলো আমাদের জীবনে ঘটে গেছে।

পোড়া বাড়ির ধ্বংসস্তুপে রণেশ ঠাকুর

যেমন আমরা আমাদের কৈশোরে স্কুলে হয়ত প্রথম পিরিয়ডে পড়েছি সামাজিক বিজ্ঞান কিংবা ভূগোল কিংবা পদার্থবিজ্ঞান কিংবা রসায়ন। যেখানে লেখা থাকতো আদিম মানুষের কথা, ভূমিকম্প কি করে হয় সেটি, কিংবা প্যাস্কেলের চাপের সূত্র, আলোর প্রতিফলন বা প্রতিসরণের সূত্র কিংবা রসায়নে পোলোয়েড কনার গতি।

ঠিক আমরা ঐ একই দিনে ইসলাম শিক্ষা ক্লাসে জেনেছি আদম (আঃ) হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম মানব আর হাওয়া হচ্ছেন প্রথম মানবী। কিংবা আমরা প্যাস্কেলের চাপ, ভূমি কম্পের কারন, পোলোয়েড কনার গতি টতি এসব ছাপিয়ে এক বাক্যে ইসলামিক শিক্ষায় পড়েছিলাম "কুন ফায়া কুন"। মানে দাঁড়াচ্ছে, "আল্লাহ বলেন হও, তখুনি হয়ে যায়"। 

ফলে লক্ষ্য করুন, আমরা আমাদের পড়ালেখায় নিজেদের কি পরিমাণ বিভ্রান্ত করেছি। আমরা সামাজিক বিজ্ঞানে যখন পড়ি বাঁদর সদৃশ আদি মানব আবার ইসলামিক শিক্ষায় পড়ি আদম, তখন আমরা মেলাতে পারিনা আসলে কোনটা সত্য। 

সুতরাং এমন প্রেগ্রেসিভ পাঠের সাথে বিশ্বাসমূলক ধর্মীয় শিক্ষার একটা জগা খিচুড়ী আমাদের শৈশব থেকে পাঠ করানো হয়। আমরা একদিকে হই প্রেগ্রেসিভ আবার অন্যদিকে হই ভয়ানক ধর্ম ভীরু। শৈশবেই আমাদের ভেতরে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ভাবনার বীজ রোপিত করা হয় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।

আমাদের এইসব জগা খিচুড়ী পাঠদানের প্রভাব সারা জীবন আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়। যেমন এই ধরেন না মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক জাহানারার কথা। একদিকে বেপর্দা (ইসলামের চোখে) হয়ে ক্রিকেট খেলছে আবার অন্যদিকে তার প্রাপ্ত সব ক্রেস্ট, ছবি এসব ঘরে লুকিয়ে রাখছে অন্য কামরায় যাতে বাকি কামরা দিয়ে ফেরেশতা গন হুড়মুড় করে ঢুকতে পারে।

আবার দেখেন আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছি, রোজা রাখছি কিন্তু এই আমরাই আবার অফিস আদালতে চুরি করছি, ঘুষ খাচ্ছি কিংবা ইসলাম যেসব বিধি আর নিষেধ আরোপ করছে সেটি আমাদের পছন্দ ও সুবিধা অনুযায়ী করছি আর তার নিজস্ব সুবিধা অনুযায়ী ব্যখ্যা সাজাচ্ছি।

আপনারা কি লক্ষ্য করে দেখেছেন পুরো ব্যপারাটা? এক ক্লাসে শিখছি প্যাস্কেলের চাপ বা আলোর প্রতিফলন আবার অন্য ক্লাসে শিখছি সব কিছু হচ্ছে আল্লাহর হুকুমে।

ফলে রণেশ ঠাকুরের পুরো ঘটনাও হয়তবা এমনই। পাশের বাড়ির কোনো প্রতিবেশী মনে করলেন গান বাজনা হারাম ফলে এই ঘরটি পুড়িয়ে দিলে চ্যালচ্যালাইয়া বেহেশতে চলে যাওয়া যাবে। 

আবার হয়ত সেই ব্যাক্তিকে খুঁজে বের করলে দেখা যাবে লোকটি অত্যন্ত বদ প্রকৃতির। হয়ত দেখা যাবে ওই গ্রামেরই এক চাল চোর চেয়ারম্যানের কাজ।

ফলে বাঙালি মুসলমান এক অদ্ভুত ডাইলেমা'র মধ্যে দিয়ে তাঁদের দিন চালিয়ে যায়। হয়ত সে ব্যাক্তি হিন্দি ছবিতে নিয়মিত ডেন্স মারে, ভারতের পেঁয়াজ কিংবা গরু ছাড়া সেই ব্যাক্তির রোচে না কিন্তু সেই তিনি-ই চান রণেশ ঠাকুরদের মত সবাই সব কিছু নিয়ে ভারতে চলে যাক। এই দেশ তাদের নয়।

বাঙালি মুসলমানদের এইসব ডাইলেমা খুব ইন্টারেস্টিং। আপনি মন দিয়ে যদি দেখেন, আমি নিশ্চিত আপনি মজা পাবেন।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা