রোনালদো মানে ’৯০ দশকের শৈশবের সেই ফুটবল না বোঝা শিশুটির অবাক বিস্মিত দৃষ্টি! সব বন্ধন ছিঁড়ে মাথার চুল ফেলে দিয়ে তাঁর মতো করে মাঠে নেমে ড্রিবল করে, আগুনের মতো শটে গোলের পর গোল করার স্বপ্ন এবং অনুপ্রেরণা!

তাওসিফ তান:

সাও পাওলো, ৭ জুন, ২০১১ ব্রাজিল বনাম রোমানিয়া প্রীতি ম্যাচে ৩০ মিনিটের সময় ব্রাজিলের স্ট্রাইকার ফ্রেডের বদলি হিসেবে ভদ্রলোক মাঠে নামলেন। ফুটবল মাঠের সাথে একেবারেই বেমানান বিশাল-বপু শরীর! খেললেনও অল্প সময়, তাতে সরাসরি গোলের সুযোগ মিস করলেন তিনটা, যার একটা আবার উড়িয়ে মারলেন বারের উপর! 

এই লোকটি একজন বিশেষ ব্যক্তি না হয়ে অন্য যে কেউ হলে দর্শক অবশ্যই যারপরনাই বিরক্ত হতেন এই ভেবে, এটা কাকে খেলাচ্ছে! কিন্তু এই ভদ্রলোকটিকে নিয়ে তা হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগই যে নেই! কারণ এই ম্যাচটি কেবল তারই জন্য আয়োজিত! এই রাত, এই সময়ও শুধুই তাঁর! এই প্রীতি ম্যাচটি দেখতে যদি একজন মানুষও টিভির সামনে বা স্টেডিয়ামে এসে বসে থাকেন, তা শুধুমাত্রই এই মানুষটিকে শেষবারের মতো খেলতে দেখার জন্য, অশ্রুসজল চোখে বিদায় জানাবার জন্য! 

সেলেসাওদের হলুদ জার্সি গায়ে এই ভদ্রলোক গত দেড় যুগ ধরে বিশ্বকে যে অবিশ্বাস্য রুপকথার রাজ্যে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন, ফুটবলের পাঁড় ভক্তদের কথা বাদ দিলাম, নিতান্ত ফুটবলের সাথে ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত কোন মানুষেরও এই ব্যক্তিটিকে মাঠে দেখলেই লোম উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে যায়, মুখে খেলে যায় হাসি! এই মানুষটির নাম রোনালদো লুইস নাজারিওস দা লিমা। গত দেড়যুগে বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল রোম্যান্টিকদের শুধু না, তৃতীয় বিশ্বের গরীব খেটে খাওয়া মানুষদের জন্যও ফুটবলের “প্রতিশব্দ”দের একজন! 

রোনালদো দ্য ফেনোমেনন

“ফেনোমেনন”- এই একটি বিশেষণের বাইরে তাঁকে বর্ণনা করার জন্য আর কোনকিছুরই প্রয়োজন নেই! প্রায় দুই দশকের ক্যারিয়ারে চার শতাধিক গোল, ব্রাজিলের হয়ে দুইটি বিশ্বকাপ, ২ টি কোপা, একটি কনফেডারেশন্স কাপ, বিশ্বকাপ গোল্ডেন বল, বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা, ব্রাজিলের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা, ৩ বার ফিফা বর্ষসেরা, ২ বার ব্যালন ডি অর, পেশাদার ক্যারিয়ারের ৭টি ক্লাবের হয়ে অসংখ্য অসংখ্য দলীয় ও ব্যক্তিগত অর্জন- তবে এসব কিছুও রোনালদোকে পুরোপুরি তুলে ধরতে পারে না! 

রোনালদোকে পুরোপুরি বুঝতে হলে সাক্ষী থাকতে হবে ফুটবল মাঠে তাঁর প্রদীপ্ত সূর্যের মতো উপস্থিতির, সাক্ষী হতে হবে টেকো মাথার নিরীহদর্শন হাস্যজ্জ্বল লোকটি বল পায়ে পেলেই কীভাবে হয়ে যেতেন একই সাথে চিতার মতো ক্ষিপ্র, ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো অপ্রতিরোধ্য আবার শৃগালের মতো চতুর! কীভাবে অবলীলায় পাশ কাটাতেন, বোকা বানাতেন, ছিটকে ফেলতেন, মাটিতে শুইয়ে ফেলে এগিয়ে যেতেন তাঁকে আটকাতে আসা প্রতিপক্ষের একের পর এক ডিফেন্ডারকে। 

ডিবক্সের মধ্যে কীভাবে বাচ্চাদের হাতসাফাইয়ের খেল দেখিয়ে বোকা বানাবার মতো করে বোকা বানাতেন, নিষ্ঠুর ছেলেখেলা করতেন গোলকিপারদের নিয়ে! দুর্দান্ত নিখুঁত ফিনিশিংয়ে কিভাবে গোলের পর গোল করে যেতেন মেশিনের মতো। গোল করার নেশা কিভাবে ছিল তাঁর স্বভাবে, তাঁর রক্তে! সাক্ষী হতে হবে কিভাবে বিশ্বের নানাপ্রান্তের খেটে খাওয়া, ক্লাব ফুটবলের খোঁজ না রেখে চার বছর পর পর জাস্ট বিশ্বকাপ দেখা মানুষদেরও তিনি “ফুটবল” চিনিয়েছিলেন ১৯৯৮ বিশ্বকাপ, ২০০২ বিশ্বকাপ দিগ্বিজয়ী আলেক্সান্ডারের মতো প্রায় একাই করায়ত্ত করার মাধ্যমে! 

মেসি বনাম ক্রিস্টিয়ানো প্রসঙ্গে ফ্যানদের যে সমর্থন কিংবা বিতর্ক, তা রোনালদোকে ছোঁয়নি কখনো। তাঁর সময়ের অবিসংবাদিত সেরাই ছিলেন রোনালদো- পারফর্মেন্স দিয়েও, অর্জন দিয়েও! ইনজুরিতে কাতর শরীর হলেও তাঁর মতো হিমশীতল ভয়ানক স্ট্রাইকার আর একজনও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল! বিশ্বের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে পেশাদার ক্যারিয়ারে খেলেছেন বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান এবং এসি মিলানের হয়ে। কিন্তু একটি প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্যানবেইজেরও ঘৃণা পাননি! সর্বকালের সেরা তিনি হতে পারতেন কিনা? শুনুন সর্বকাল সেরা একজন গোলকিপারের কাছে থেকেই-

“ইনজুরী বাধা না হলে পেলে ম্যারাডোনার সাথে একই সাথে উচ্চারিত হতো রোনালদো লিমার নাম!” - জিয়ানলুইজি বুফন

সর্বকালের তিনজন ফুটবলারের একজন এবং তাঁর একই সাথে প্রবল প্রতিপক্ষ ও সতীর্থ জিনেদিন জিদান তাঁর সম্পর্কে বলেছেন,

“রোনালদোকে আটকানোর কোন প্রক্রিয়া ছিল না, কোন কৌশল জানতাম না! বল ছাড়া একজন মানুষ যত জোরে দৌড়ায়, বল পায়ে নিয়ে সে তত জোরে দৌড়াতো!”

সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইন তিনি

সর্বকালের অবিসংবাদিত সেরা ফুটবলার তিনি হতে পারেননি! কিন্তু সর্বকালের অবিসংবাদিত সেরা “নাম্বার নাইন” তিনিই! রোনালদো মানেই গোল, রোনালদো মানেই ব্রাজিলের নাম্বার নাইন হলুদ জার্সি, রোনালদো মানেই ম্যাচের পর ম্যাচ একাই জিতিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন “ওয়ান ম্যান” ফুটবল টিম! রোনালদো মানেই ফুটবল ইতিহাসের একজন পারফেক্ট স্ট্রাইকারের উদাহরণ! 

সবচে বড় কথা রোনালদো হচ্ছে একটা ফুটবলীয় অনুভুতি, এমন একটি নাম যা শুনলে বিশ্বের কোটি কোটি ‘৮০র দশকের কিশোরের রক্তের নাচন হয়। রোনালদো মানে ’৯০ দশকের শৈশবের সেই ফুটবল না বোঝা শিশুটির অবাক বিস্মিত দৃষ্টি! সব বন্ধন ছিঁড়ে মাথার চুল ফেলে দিয়ে তাঁর মতো করে মাঠে নেমে ড্রিবল করে, আগুনের মতো শটে গোলের পর গোল করার স্বপ্ন এবং অনুপ্রেরণা! শুভ জন্মদিন ফেনোমেনন! আপনি সেরা ছিলেন, সেরাই থাকবেন!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা