The Players Tribune পত্রিকায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নিজের লেখা একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালে। সেই কলামে রোনালদো তার জীবন সংগ্রাম, মাদ্রিদের দিনলিপি আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খেরোখাতার গল্প বলেছেন, যেগুলো পড়ন্ত বয়সে তিনি তার নাতী-নাতনীকে শোনাতে চান। ‘এগিয়ে চলো’র পাঠক আর রোনালদো ভক্তদের জন্যে বাংলায় অনুবাদ করা হলো সেই লেখাটি।

আমার যখন মাত্র সাত বছর বয়স, সে সময়কার একটা ঘটনা আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। পুরো ঘটনাটার স্মৃতি আমার কাছে এতটাই স্পষ্ট যে মনে হয় এখনও আমি যেন চোখের সামনেই সেটা ঘটতে দেখছি। এবং এই স্মৃতিচারণা আমার হৃদয়কে উষ্ণ করে তোলে। কারণ এর সাথে আমার পরিবার জড়িত। আমি তখন সবে সত্যিকারের ফুটবল খেলা আরম্ভ করেছি। এর আগে আমি স্রেফ মাদেইরার রাস্তায় বন্ধুদের সাথে খেলে বেড়াতাম। রাস্তা বলতে কিন্তু শূন্য রাস্তা বোঝাচ্ছি না। সত্যি সত্যিই ব্যস্ত সড়ক ছিল সেটা। গোলপোস্ট বা সে জাতীয় কিছুই ছিল না আমাদের। আর যখনই কোন গাড়ি আসত, আমাদেরকে খেলা থামিয়ে রাস্তার এক পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হতো।

এরপরও আমি খুবই খুশি ছিলাম। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন সিএফ অ্যান্ডোরিনহা নামের একটি ফুটবল ক্লাবের কিটম্যান, এবং তিনি আমাকে নিয়মিত উৎসাহ যোগাতেন সেখানে গিয়ে তাদের যুবদলের সাথে খেলতে। আমি জানতাম আমি যদি কাজটা করি তবে তিনি অনেক খুশি হবেন, গর্ববোধ করবেন। তাই আমি সেখানে গিয়েছিলাম। প্রথমদিন সেখানে গিয়ে দেখলাম অসংখ্য নিয়মকানুনের ছড়াছড়ি। আমি সেগুলোর কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু তারপরও আমি জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সেখানকার প্রতিটা কার্যক্রম, এবং জয়ের নেশা আমাকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আমার বাবা, তার বিশাল বড় দাঁড়ি নিয়ে, প্রতিটা ম্যাচের সময় সাইডলাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমার খেলা দেখতেন। আমাকে খেলতে দেখা তিনি উপভোগ করতেন।

অবশ্য আমার মা আর বোনের ফুটবলের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহও ছিল না। তাই প্রতি রাতে খাবারের সময় বাবার কাজ ছিল তাদেরকে আমার খেলা দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে উসকানো। ব্যাপারটা এমন ছিল যেন তিনি ছিলেন আমার এজেন্ট, আমার খেলার ব্যাপারে অন্যদের কাছে গল্প করাই যার কাজ। আমার মনে আছে, প্রতিদিন আমি তার সাথে বাড়ি ফিরতাম, আর বাড়ি ঢোকার মুখেই তিনি চিৎকার করে জানান দিতেন, 'ক্রিস্টিয়ানো আজ একটা গোল দিয়েছে!' তারা (আমার মা ও বোন) তখন বলত, 'ওহ, দারুণ।' কিন্তু ওইটুকু বলাতেই সারা। তারা আসলে কখনোই এ নিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বসিত হতো না। 

পরদিন বাবা আবার বাড়ি ফিরে বলতেন, 'ক্রিস্টিয়ানো আজ দুইটা গোল দিয়েছে!' কিন্তু এ খবরও তাদেরকে একটুও উত্তেজিত করত না। তারা উদাসীনভাবে শুধু বলত, 'ওহ, এ তো খুবই ভালো সংবাদ, ক্রিস!' তো আমার আর কি করার ছিল? তাই আমি শুধু গোল করে যেতাম। করেই যেতাম। এরপর এক রাতে বাবা বাড়ি ফিরে ঘোষনা দিলেন, 'আজ ক্রিস্টিয়ানো তিনটা গোল দিয়েছে! সে ছিল এক কথায় অবিশ্বাস্য। তোমাদেরকে তার খেলা দেখতে আসতেই হবে!' কিন্তু এ কথায়ও কোন লাভ হলো না। প্রতি ম্যাচের আগে আমি সাইডলাইনের দিকে তাকাতাম, আর দেখতাম আমার বাবা একাই দাঁড়িয়ে আছেন।

তারপর হঠাৎ একদিন - এই দিনটার কথা আমি কখনোই ভুলতে পারব না - আমি খেলা শুরুর আগে ওয়ার্ম আপ করছিলাম, আর তখন দেখতে পেলাম আমার মা আর বোন ব্লিচারের ওপর বসে আছে। তাদেরকে দেখাচ্ছিল অনেকটা... কিভাবে বলি সেটা? তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন শুধু আরাম করতে এসেছে। অন্যদের মত তারা হাততালি দিচ্ছিল না বা চিৎকার করছিল না। তারা শুধু আমার দিকে হাত নাড়ছিল। ভাবখানা এমন যেন আমি একটু পরেই প্যারেড করতে নামব। তাদের দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল এর আগে কখনোই তারা কোন ফুটবল ম্যাচ দেখতে আসেনি। কিন্তু তাতে কি। আজ তো তারা এসেছে, আমার জন্য। এবং সেটাই আমার জন্য একটা বিশাল বড় ব্যাপার ছিল। 

ওই মুহূর্তটা আমার কাছে খুবই মূল্যবান ছিল। আমার অনেক ভালো লাগছিল। আমার মনে হলো আমার ভেতরে কি যেন একটা পরিবর্তন এলো। আমার অনেক গর্ব হচ্ছিল। কারণ যখনকার কথা বলছি, ওই সময়টায় আমাদের কাছে বেশি টাকাপয়সা ছিল না। আমাদেরকে অনেক কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হতো। আমি হয়ত আমার কোন চাচাত ভাই বা অন্য কারও পুরনো বুট পরে খেলতে নামতাম। কারণ নতুন বুট কেনার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। অথচ সেই আমার খেলা দেখতেই এসেছে আমার মা আর বোন! ছেলেবেলায় আমরা কে-ই বা টাকাপয়সা নিয়ে ভাবি। ছোট ছোট কিছু অনুভূতিই তো আমাদের কাছে অনেক বেশি দামি। আর সেদিন সেরকমই একটা অনুভূতি হতে শুরু করেছিল আমার ভেতর। 

এখনো যখন এই ঘটনাগুলোর কথা মনে করি, আমি নস্টালজিক হয়ে যাই। কারণ আমার জীবনের ওই সময়টা খুব বেশি দীর্ঘায়িত হয়নি। পরবর্তী জীবনে ফুটবল আমাকে দু-হাত ভরে দিয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি আমাকে আমার পরিবারের থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। এমন একটা সময়ে যখন আমি সেটার জন্য ভালো মত প্রস্তুতও ছিলাম না। মাত্র ১১ বছর বয়সে আমি বাড়ি ছেড়ে স্পোর্টিং লিসবনের অ্যাকাডেমিতে চলে আসতে বাধ্য হই। আর ওটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের অধ্যায়।  

বান্ধবী ও সন্তানদের সঙ্গে রোনালদো

এখন আমার ব্যাপারগুলো ভাবতে বড় অদ্ভূত লাগে। কারণ এই যে আমি এই কথাগুলো লিখছি, এখন আমার ছেলে ক্রিস্টিয়ানো জুনিয়রের ৭ বছর বয়স চলছে। আমি শুধু ভাবি আমার নিজেরই বা কেমন লাগবে, যদি আর মাত্র চার বছর পরই তাকে আমি লন্ডন বা প্যারিসের মত দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিই? এ তো আমার জন্য স্রেফ অসম্ভব। এবং আমি নিশ্চিত, ওই সময়টায় আমার মা-বাবার কাছেও কাজটা অসম্ভব ছিল। 

কিন্তু ওটাই ছিল আমার জীবনের স্বপ্নকে ছুঁতে পারার সবচেয়ে বড় সুযোগ। তাই তারা আমাকে যেতে দিয়েছিলেন, এবং আমিও গিয়েছিলাম। আমি তখন প্রতিদিন কাঁদতাম। আমি হয়ত পর্তুগালেই ছিলাম, কিন্তু আমার কাছে মনে হতো পরিবার ছেড়ে আমি বুঝি অন্য কোন দেশে চলে এসেছি। ভাষাটা কেমন যেন ভিন্ন ধরণের ছিল। সংস্কৃতিও অন্য রকম। আমি কাউকেই চিনতাম না সেখানে। তাই আমি খুবই একাকীত্বে ভুগতাম। আমার পরিবারের পক্ষে কেবলমাত্র প্রতি চার মাসে একবার আমাকে দেখতে আসার মত সামর্থ্য ছিল। মাঝের সময়গুলোতে আমি তাদেরকে অনেক বেশি মিস করতাম, এবং প্রতিটা দিনই ছিল অসহ্য বেদনার। কিন্তু ফুটবল আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আমি জানতাম আমি এমন কিছু করতে পারি যা অ্যাকাডেমির অন্যরা করতে পারত না।

আমার বেশ মনে আছে যেদিন প্রথম শুনেছিলাম আমাকে দেখিয়ে একজন আরেকজনকে বলছে, 'দেখেছিস, ওই ছেলেটা কি করেছে? ও কি মানুষ!' এবং এক সময় আমি এগুলো শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। এমনকি কোচদের মুখ থেকেও। তবে মাঝেমধ্যে কিছু অন্যরকম কথাও শুনতাম। কেউ কেউ বলত, 'দুঃখের ব্যাপার, ও এত ছোট।' সত্যিই তাই। আমি ছিলাম হাড় জিরজিরে শরীরের অধিকারী। আমার কোন পেশি ছিল না। তাই মাত্র ১১ বছর বয়সেই আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি জানতাম আমার মেধা অন্য যে কারও চেয়ে বেশি, তারপরও আমি অন্যদের থেকে বেশি পরিশ্রম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি ঠিক করেছিলাম আর ছোট মানুষের মত খেলব না। ছোট মানুষের মত আচরণও করব না। এমনভাবে নিজেকে তৈরি করব যেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারি। 

আমি জানি না এমন অনুভূতির উৎস কি। কিন্তু এটা জানি যে এটা আমার মধ্যেই কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল। এটা এমন একটা ক্ষুধা যেটা কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবে না। আপনি যখন জিততে থাকবেন, তখনও মনে হবে আপনি ক্ষুধার্ত। কেবলমাত্র এভাবেই আমি বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করতে পারি। 

আমি এরপর থেকে রাতের বেলা ডরমিটরি ছেড়ে পালিয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করলাম। আমি ক্রমশ বড় হয়ে উঠতে লাগলাম। আরও ক্ষিপ্রগতির হয়ে উঠতে লাগলাম। তারপর আমি খেলার মাঠে প্রবেশ করতাম। একসময় যারা আমার শারীরিক ক্ষুদ্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলত, তারাই এখন এমন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাত যেন তারা পৃথিবীর শেষ দেখে ফেলেছে। আমি যখন ১৫, তখনকার একটা ঘটনাও একদম পরিষ্কার মনে আছে আমার। একদিন আমি আমার সতীর্থদের কাছে গিয়ে বলেছিলাম, 'একদিন আমি বিশ্বসেরা হব।' তারা আমার কথায় হাসতে শুরু করেছিল। কারণ আমি তখনও স্পোর্টিং এর মূল দলেই জায়গা পাইনি। কিন্তু তখন থেকেই আমার মধ্যে এই মানসিকতাটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এবং আমি যা বলেছিলাম তা আমি নিজেও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। 

যখন আমি পেশাদারি ফুটবলে খেলা শুরু করলাম ১৭ বছর বয়সে, আমার মা আমার খেলা দেখতে আসতেন। কিন্তু তিনি মানসিক উত্তেজনাটা একদমই নিতে পারতেন না। তিনি খুবই নার্ভাস হয়ে পড়তেন। এমনকি কয়েকবার তিনি মাঠেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। হ্যাঁ, সত্যি বলছি, খেলা দেখতে গিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। তাকে ডাক্তারের কাছে নেয়া হলে ডাক্তার তাকে সিডেটিভ দেন। শুধুমাত্র যাতে তিনি আমার খেলা দেখতে পারেন! আমি তখন মজা করে তাকে জিজ্ঞেস করতাম, 'মনে আছে একসময় ফুটবলের প্রতি তোমার এতটুকুও আকর্ষণ ছিল না?' এই ছোট ছোট ঘটনাই আমাকে আরও বড় বড় স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল। আমি তখন জাতীয় দলের হয়ে খেলতে চাইতাম। এবং আমি চাইতাম ম্যানচেস্টারের হয়ে খেলতে। কারণ তখন আমি টিভিতে সারাক্ষণই প্রিমিয়ার লিগ দেখতে থাকতাম। সেখানকার দ্রুতগতির খেলা আমাকে খুব টানত। এমনকি খেলা চলাকালীন দর্শকদের গান গাওয়াও আমাকে বিমোহিত করত।

এরপর যখন আমি একদিন সত্যি সত্যিই ম্যানচেস্টারের খেলোয়াড় হয়ে গেলাম, সেটা ছিল আমার জন্য খুবই বিশেষ একটা মুহূর্ত। কিন্তু আমার বিশ্বাস সেটা আমার পরিবারের কাছে আরও বেশি আনন্দের ছিল। প্রথম প্রথম ট্রফি জেতা আমার কাছে খুব বড় একটা আবেগের ব্যাপার ছিল। আমার মনে আছে প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর আমার মধ্যে কি এক স্বর্গীয় অনুভূতি জন্ম নিয়েছিল। প্রথম ব্যালন ডি'অর জেতার পরও একই রকম অনুভূতি হয়েছিল। কিন্তু আমার স্বপ্নও আগের থেকে বড় হচ্ছিল। স্বপ্নগুলো আকাশ ছুঁতে চাইছিল। মাদ্রিদকে আমার বরাবরই পছন্দ ছিল, এবং আমি নতুন কোন চ্যালেঞ্জের জন্যও অপেক্ষা করছিলাম। আমি চাইছিলাম মাদ্রিদের হয়েও ট্রফি জিততে, সব রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিতে, আর ক্লাবের হয়ে একজন সত্যিকারের কিংবদন্তী খেলোয়াড়ে পরিণত হতে। 

আট-নয় বছর ধরে মাদ্রিদে আমি অসাধারণ সব অর্জনের অংশীদার হয়েছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ট্রফি জয়ের আবেগ এখন একদমই পাল্টে গেছে। মাদ্রিদে যেটা হয়, আপনাকে সবকিছুই জিততে হবে, নয়ত সেটা ব্যর্থতা হিসেবে পরিগণিত হবে। সেরাদের কাছে তো এটাই সাধারণের চাওয়া। আর সেই চাওয়া পূরণ করাই এখন আমার কাজ।  কিন্তু যখন আপনি একজন বাবা, তখন কিন্তু অনুভূতির জায়গাটা আবার একদমই ভিন্ন রকম। এটা এমন একটা অনুভূতি যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এজন্যেই মাদ্রিদে আমার সময়গুলো খুব মূল্যবান। কারণ এখানে আমি একজন ফুটবলারই শুধু না, হয়েছি একজন বাবাও। আমার ছেলের সাথে একটা ঘটনার কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। যখনই আমি এই ঘটনার কথা ভাবি, আমার মন এক অনাবিল আনন্দ আর উষ্ণতায় ভরে ওঠে।   

ঘটনাটা কার্ডিফে গত চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল জেতার পরের। সে রাতে আমরা ইতিহাস গড়েছিলাম। ম্যাচ শেষে যখন হুইসল বাজল, মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার কেবল মনে হচ্ছিল, আমি বিশ্ববাসীকে একটা বার্তা দিতে পেরেছি। তারপর আমার ছেলে আমার কাছে আসল জয় উদযাপন করতে। তখনই যেন গোটা প্রেক্ষাপট পাল্টে গেল। সেই মুহূর্তে আমার যে অনুভূতিটা হচ্ছিল, তা সম্পূর্ণই আলাদা। সে মার্সেলোর ছেলের সাথে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। এরপর আমরা দুজন একসাথে ট্রফিটা স্পর্শ করলাম। এবং হাত ধরাধরি করে মাঠ ত্যাগ করলাম। এটা এমন একটা ভালো লাগা যা আমি বাবা হওয়ার আগে কখনো টের পাইনি। তখন একইসাথে এত এত অনুভূতি কাজ করতে থাকল যে সেগুলোকে ঠিকমত ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।

এই অনুভূতিগুলোকে স্রেফ অন্য আর একটা অনুভূতির সাথেই আমি তুলনা করতে পারি। সেই যে যেদিন আমি মাদেইরাতে ম্যাচ শুরুর আগে ওয়ার্ম আপ করছিলাম, এবং হঠাৎ করেই দেখতে পেয়েছিলাম আমার মা আর বোন বসে আছে আমার খেলা দেখবে বলে। যখন আমরা জয় উদযাপন করতে বার্নাব্যুতে ফিরে এসেছিলাম, মাঠে হাজার হাজার দর্শকের সামনে মার্সেলিতো আর আমার ছেলে খেলছিল। এ দৃশ্যের সাথে আমার মাদেইরার রাস্তায় খেলতে থাকার দৃশ্যের হয়ত কোন মিল নেই। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার তখন যেরকম অনুভূতি হতো, ক্রিস্টিয়ানো জুনিয়রেরও সেদিন একই রকম অনুভূতিই হচ্ছিল। 

মাদ্রিদে ৪০০ ম্যাচ খেলে ফেলার পরও, জয়ই আমার প্রধানতম লক্ষ্য ছিল। আমার মনে হয় আমি জন্মেছিই এভাবে। কিন্তু হ্যাঁ, জয়ের পরের অনুভূতিতে অবশ্যই পরিবর্তন এসেছে। এখন এটা আমার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়। আমার নতুন বুটের ওপর একটা খুবই মূল্যবান বার্তা লেখা, ঠিক ডানদিকের হিলের ওপর। এবং সেই বার্তার শেষ কয়েকটা শব্দ পড়ে তবেই আমি প্রতি ম্যাচের শুরুতে টানেলের দিকে পা বাড়াই। ওটা যেন আমার কাছে একটা অনুস্মারকের মত, একটা অনুপ্রেরণার মত। ওখানে লেখা, 'এল সুয়েনো দেল নিনো। 'একটা শিশুর স্বপ্ন। 

হয়তো এখন আপনারা ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারছেন। পরিশেষে, অবশ্যই - আমার লক্ষ্য আগে যা ছিল এখনও ঠিক তাই-ই আছে। আমি চাই ক্লাবের হয়ে একের পর এক রেকর্ড গড়তে, একের পর এক ট্রফি জিততে। আমি চাই যতগুলো সম্ভব ট্রফি জিততে। এটাই আসলে আমি। এটাই আমার প্রকৃতি। কিন্তু ফুুটবল ক্যারিয়ারে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ঘটনাটা, যেটার কথা ৯৫ বছর বয়সে আমি আমার নাতি-নাতনিদেরকে শোনাবো তা হলো, চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর ছেলের সাথে হাত ধরাধরি করে মাঠ ছাড়ার সেই অপার্থিব অনুভূতি। আশা করি আমরা আবারও এটা করব।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা