ভালোবাসা, সহানুভূতি- এগুলো সবাই ডিজার্ভ করে না...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
তিন হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য বানানো হয়েছে সুদৃশ্য ঘরবাড়ি, অথচ তারা সেখানে যেতে ইচ্ছুক নয়! উল্টো যারা ভাসানচর ঘুরে এসেছেন, তাদের হুমকি দিচ্ছে রোহিঙ্গারাই, বলা হচ্ছে, 'ক্যাম্পে ভাসানচর নিয়ে প্রচারণা চালালে তোর খবর আছে!'
খুব আদরযত্ন করে, মোটামুটি ভিআইপি মর্যাদা দিয়ে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের নিয়ে যাওয়া হলো ভাসানচর দেখানোর জন্য, যেখানে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচায় সরকার সেখানে তাদের জন্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে, কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তরের পরিকল্পনা ছিল। কিন্ত ঘুরে এসে, ভাসানচরের ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করেও রোহিঙ্গারা এখন সেখানে যেতে অনিচ্ছুক! শুধু তাই নয়, যেসব নেতারা ভাসানচর দেখে এসেছেন, তাদেরকে কিছু রোহিঙ্গাই ফোনে হুমকি দিচ্ছে, যাতে ভাসানচরের ব্যাপারে কোন প্রচারণা তারা না চালায়। কক্সবাজার ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা এদের নেই, এই জায়গাটাকেই মিনি রাখাইন বানিয়ে রাখতে চায় তারা। বানরকে লাই দিলে সেই বানর মাথায় উঠে কি পরিমাণ যন্ত্রণার কারণ হতে পারে, সেটা রোহিঙ্গারাই আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে হাড়ে হাড়ে।
মিয়ানমার থেকে নির্যাতন আর গণহত্যার শিকার হয়ে সীমান্তে এসে আশ্রয় চাওয়া অসহায় লোকগুলোকে আমরা বুকে টেনে নিয়েছিলাম, লাখ লাখ শরণার্থীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। আগেও নানা সময়ে আসা রোহিঙ্গারা তো ছিলই, তার ওপরে প্রতিনিয়তই নবজাতকের জন্ম হচ্ছে। সব মিলিয়ে কক্সবাজারেই সরকারী হিসেবে রোহিঙ্গা আছে এগারো লাখের বেশি, তবে বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা প্রায় বিশ লাখ বলে অনেকে দাবী করেন।
কক্সবাজারে এখন রোহিঙ্গারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ছিঁচকে চুরি, জমি দখল থেকে খুন-ডাকাতি কিংবা অপহরণ- সব ধরণের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গাদের অনেকে। কয়েকটা দলে বিভক্ত হয়ে এরা প্রভাব বিস্তারের জন্য নিজেরাও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কক্সবাজারের ড্রাগ কার্টেল টিকে আছে রোহিঙ্গাদের কারণেই, দেশ ইয়াবায় সয়লাব হয়ে যাওয়ারও বড় কারণ এরা। পাহাড়-জঙ্গল-সংরক্ষিত বনাঞ্চল কেটে তো উজাড় করেছেই, মানুষের ব্যক্তিগত গাছও কেটে নিয়ে আসছে, কেউ বাধা দিলে তার ওপর আক্রমণ করছে। এদের যন্ত্রণায় কক্সবাজারের মানুষই অতিষ্ট হয়ে গেছে আরও অনেক আগে, খাল কেটে কুমির আনার মাশুল এখন গুণছে স্থানীয় জনগন।
রোহিঙ্গা ঘনবসতি কমানোর জন্যেই এদের মধ্যে একটা অংশকে অন্য কোথাও স্থানান্তরের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল।সরকার। মিয়ানমার এদের ফিরিয়ে নিচ্ছে না, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা চলছে, সেটার রায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এদিকে শরণার্থী শিবিরে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর এই অশিক্ষিত অসামাজিক লোকগুলো পরিবার পরিকল্পনায় মোটেও ইচ্ছুক নয়, জীবন নিয়ে টানাটানি তবু বংশবৃদ্ধিতে থামাথামি নেই, প্রতিদিনই ক্যাম্পে জন্ম হচ্ছে নতুন শিশুর, জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি গ্রহণেও এরা ইচ্ছুক নয়।
তাই বাংলাদেশ সরকার নিজেদের খরচে নোয়াখালির ভাসানচরে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নিয়েছিল। প্রথমে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বাজেট থাকলেও, পরে সেই বাজেট বেড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। জোয়ার–জলোচ্ছ্বাস থেকে ভাসানচরের ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ তৈরি করেছে। এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য সেখানে ১২০টি গুচ্ছ গ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় বাজেট বাড়িয়ে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো, আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা, জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হয়েছে।
চার তলা বিশিষ্ট ১২০টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে ভাসানচরে। এখানে মাটি ভরাটের পর মাটি থেকে ৪ ফুট উঁচুতে তৈরি হয়েছে ১৪৪০টি টিনশেড পাকা ঘর। প্রতিটি শেড এ ১৮টি কক্ষ আছে। শেডের দুই পাশে বানানো হয়েছে বাথরুম ও রান্নাঘর। প্রতি চার সদস্য বিশিষ্ট পরিবারকে ১টি করে রুম বরাদ্দ দেয়া হবে। প্রতিটি রুমে থাকছে দোতলা বিশিষ্ট ২টি বেড। প্রতি চারটি শেডের জন্য আলাদা খেলার মাঠ ও পুকুর থাকছে, প্রার্থনার জন্য একাধিক মসজিদও বানানো হয়েছে ভাসানচরে। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব যাতে না হয় সেজন্য গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। মাত্র এক বছরের মধ্যে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষ করা হয়েছে।
কিন্ত রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে রাজী নয়। তারা বলছে, হয় তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে, নইলে কক্সবাজারেই থাকবে। ভাসানচরে না যাওয়ার ব্যাপারে তাদের যুক্তি হচ্ছে, এই দ্বীপটা সাগরের মাঝখানে, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়, সেখানে জোয়ারে বা জলোচ্ছ্বাসে পানি ওঠে, এলাকা নিচু- ইত্যাদি ইত্যাদি। বার্মিজ সেনাদের বুলেটের হাত থেকে বেঁচে, মাসের পর মাস নৌকায় করে সাগরে ঘুরে বেড়িয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এমন অদ্ভুত আবদার শুনলে মনে হয়, এরা কি আমাদের দেশটাকে বাপ-দাদার সম্পত্তি ভেবে বসছে নাকি? নইলে এত রঙ-বেরঙের আবদার কোত্থেকে আসে?
শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের তরফ থেকে যে কয়জন ভাসানচর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, তাদেরকেও ফোন করে হুমকি দেয়া হচ্ছে, যাতে ভাসানচরের প্রশংসা করে তারা ক্যাম্পে কোন প্রচারণা না চালান। শামলাপুর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের হেড মাঝি নুর মোহাম্মদ বলছিলেন, “ফোনে আবদুর শুক্কুর ওরফে হুজুর পরিচয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তুই কে? ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়াদের তালিকা সরকারকে দেওয়ার দায়িত্ব তোকে কে দিয়েছে? ক্যাম্পে প্রচারণা চালালে তোর খবর আছে, এই দুনিয়ায় বেশি দিন ঠাঁই হবে না। আবার কথা হবে।’ এভাবেই হুমকি পেয়েছি।” ওই শুক্কুর মাঝির পরিচয়ে আরও কয়েকজনকে হুমকি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নুর মোহাম্মদ, যারা হুমকি পেয়েছেন তারা সবাই ভাসানচর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।
সরকারও আপাতত আন্তর্জাতিক ফোরামে সমালোচনা এড়ানোর জন্য রোহিঙ্গাদের সেখানে নেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে খানিকটা পিছিয়ে এসেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভাসানচরে জাতিসংঘের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সাহায্য সংস্থার জন্য দপ্তর নির্মাণের কথাও বলেছে উন্নয়ন সহযোগীরা। ভাসানচরকে নিরাপদ ও বাসোপযোগী করতে যে ৫৫টি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত সরকার তার ৪৫টি নিশ্চিত করতে পেরেছে। এই অবস্থায় সব কাজ শেষ না করে রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানো ঠিক হবে না। পরিকল্পনা মন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নেবেন।
এই যে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করে রোহিঙ্গাদের আরাম-আয়েশের জন্য স্থাপনা নির্মাণ করা হলো, এটা কিন্ত জাতিসংঘের টাকায় বা অনুদানের টাকায় বানানো হয়নি। এই টাকা আমার-আপনার ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকা, প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত পানি করা রেমিট্যান্সের টাকা। সেই টাকায় রোহিঙ্গাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করার পরও এদের বাহারি আবদার আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে, সেই আবদারের লিস্টে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন আইটেম! রাষ্টের কাছে নাগরিক হিসেবে আমাদের আবেদন থাকবে, শক্ত কূটনৈতিক অবস্থান নিতে এদের বিদায় করার ব্যবস্থা করুন, নইলে ব্যারিকেডের মধ্যে বন্দী করুন। এরা যাতে এদেশের কোন নাগরিকের ক্ষতি করার মতো সুযোগ না পায়, এদের জন্য যেন একজন বাংলাদেশীকেও নিজ ভূমে পরবাসী হতে না হয়। মানবতা বা ভালোবাসা জিনিসটা যে সবাই ডিজার্ভ করে না, সেটা অজস্র রোহিঙ্গাদের কার্যক্রমই গত তিন বছরে প্রমাণ করে দিয়েছে...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন