রিনা বেগম যৌনকর্মী হওয়ায় স্থানীয় কোনো ইমাম তার জানাজা পড়া‌তে রা‌জি হন‌নি। কিন্ত তাতে দমে যাননি পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, গোয়ালন্দ ঘাট থানা মস‌জি‌দের ইমাম‌কে সঙ্গে নি‌য়ে রিনা বেগমের জানাজা নামাজ পড়া‌নোর ব্যবস্থা ক‌রেছেন তিনি।

আরও একবার জানাজার নামাজ পড়ানো হলো দৌলতদিয়ায়, আরও একজন যৌনকর্মীকে শেষ বিদায় দেয়া হলো ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে, যথাযথ নিয়মের সাথে। 'পতিতাদের জানাজা পড়ানো যাবে না' টাইপের ফতোয়া যারা জারী করে, সেসব বকধার্মিকদের গালে চপেটাঘাত করেই এবার রিনা বেগম নামের এক মৃত যৌনকর্মীর জানাজার আয়োজন করেছেন রাজবাড়ী জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। স্থানীয় কোন ইমাম জানাজার নামাজ পড়াতে রাজী না হওয়ায় গোয়ালন্দ ঘাট থানা মসজিদের ইমাম সাহেবকে নিয়ে জানাজা পড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন মিজানুর রহমান। 

দৌলতদিয়ার পতিতাপল্লীতে যেসব যৌনকর্মীরা মারা যান, তাদের জানাজা পড়ানো হয় না, ইসলামিক রীতি মেনে কবরও দেয়া হয় না। ‘খারাপ পাড়ার মেয়ে’ বা ‘বেশ্যা’ বলে পরিচিত এই মানুষগুলো জীবিত অবস্থায় তো বিন্দুমাত্র সম্মান কোথাও পান না, মৃত্যুর পরেও মেলে না স্বীকৃতি। মারা গেলে এদের দেহটা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো, নইলে পুঁতে ফেলা হতো কোন ধর্মীয় রীতিনীতি না মেনেই।

বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই ভ্রান্ত নিয়মটা ভেঙেছিলেন গোয়ালন্দ থানার ওসি আশিকুর রহমান। একজন ইমামকে নিয়ে এসে তিনি হামিদা বেগম নামের এক যৌনকর্মীর জানাজার নামাজ পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্ত অসাধারণ এই উদ্যোগটার পেছনে লেগেছিল কিছু মানুষ, ধর্মের নাম করে উল্টোপাল্টা ফতোয়া জারী করেছে তারা, যে ইমাম সাহেব হামিদা বেগমের জানাজা পড়িয়েছিলেন, সেই মোস্তফা মাওলানাকে ক্রমাগত হুমকি দিয়েছে, তাকে একঘরে করে রেখেছে। বিরক্ত হয়ে মোস্তফা মাওলানা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর কখনও যৌনকর্মীদের জানাজা তিনি পড়াবেন না।

হামিদা বেগমের জানাজার ঘটনা নিয়ে এমনিতেই দৌলতদিয়া এবং গোয়ালন্দ ঘাটে কয়েকদিন ধরে গুঞ্জন চলছে, এলাকাবাসীর বেশিরভাগই এই জানাজার বিপক্ষে ছিল। তাদের কথা হচ্ছে, ইসলামে যেহেতু পতিতাবৃত্তি হারাম, সুতরাং পতিতাদের জানাজার নামাজ পড়ানোটাও হারাম। কিন্ত কেউ হারাম কাজ করলেই তার মৃত্যুর পরে জানাজা পড়ানো যাবে না- এরকম বিধান ইসলামের কোথায় আছে সেটা তারা দেখাতে পারেনি, কিন্ত নিজেদের বখাট্য যুক্তিতে অটল থেকেছে ঠিকই। 

এর আগে যৌনকর্মী হামিদা বেগমের জানাজা পড়ানো হয়েছিল দৌলতদিয়ায়

গতকাল বিকেলে মারা গিয়েছিলেন দৌলতদিয়ার যৌনকর্মী রিনা বেগম। জানাজার আয়োজন করতে ভয় পাচ্ছিলেন পতিতাপল্লীর লোকজন, এই খবর রাজবাড়ীর পু‌লিশ সুপা‌রের কানে যাওয়ার পরে তাৎক্ষ‌ণিক তি‌নি ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী ওই যৌনকর্মীর জানাজা নামা‌জ পড়ানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু রিনা বেগম যৌনকর্মী হওয়ায় স্থানীয় কোনো ইমাম তার জানাজা পড়া‌তে রা‌জি হন‌নি। মোস্তফা মাওলানার ঘটনায় তাদের শিক্ষা হয়েছে, যেচে পড়ে ঝামেলা কাঁধে নেয়ার শখ তাদের হয়নি। কিন্ত তাতে দমে যাননি পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, গোয়ালন্দ ঘাট থানা মস‌জি‌দের ইমাম‌কে সঙ্গে নি‌য়ে রিনা বেগমের জানাজা নামাজ পড়া‌নোর ব্যবস্থা ক‌রেছেন তিনি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, দৌলতদিয়ার এই জায়গাটাতে মসজিদ-মাদ্রাসার জন্যে কিন্ত ঠিকই পতিতাদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়া হয়। এখন যারা পতিতার জানাজা নিয়ে বিরোধিতা করছে, এরাই কিন্ত দুই ঈদ কিংবা অন্যান্য উপলক্ষ্যে, রমজান মাসে খতম তারাবীর নামে নিয়মিতই টাকা তোলে পতিতাপল্লী থেকে। তখন যৌনকর্মীদের দেহব্যবসার টাকাগুলো হালাল হয়ে যায়, কারো কোন সমস্যা হয় না। শুধু যৌনকর্মী মারা গেলে তার জানাজার বেলায় ধর্ম এসে পড়ে, ফতোয়া জারী হয়, হালাল-হারামের আজগুবি হিসেব চলে আসে সামনে। অনেক বছর আগে লালন লিখেছিলেন- “গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়…” লালনের সেই কথাটা ২০২০ সালের বাংলাদেশেও নির্জলা সত্য।

পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানকে ধন্যবাদ, ধন্যবাদ গোয়ালন্দের ওসি আশিকুর রহমানকে। এই মানুষগুলো হামিদা বেগম বা রিনা বেগমকে 'যৌনকর্মী' বা 'পতিতা' হিসেবে ট্রিট করেননি, করেছেন দশজন সাধারণ মানুষের মতোই। আমার আপনার যেমন শেষ বিদায়টা পাওয়ার অফহিকার আছে, তেমনই আছি হামিদা বেগমের, আছে রিনা বেগমের। সেই অধিকারটা নিশ্চিত করেছেন ওসি এবং পুলিশ সুপার। যে মানুষগুলো জীবনভর কোথাও স্বীকৃতি পায় না, লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা সয়ে যাদের জীবন কাটে, মৃত্যুর পরে তারা জানাজা আর ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাফন পেয়েছেন- এটুকুও হয়তো ধর্মান্ধতে ভরা বাংলাদেশে কম কিছু নয়! পরিবর্তনটা আশিকুর রহমান বা মিজানুর রহমানদের হাত ধরেই আসবে, এটা বিশ্বাস করতে আমাদের খুব ইচ্ছে হয়...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা