একসময় লিখতে-পড়তে না পারা লোকটিই আজ ৪২৫০ কোটি টাকার মালিক!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
যে মানুষটির কথা বলব, তাঁর জীবনের গ্রাফ ইসিজির গ্রাফের চেয়ে কোন অংশে কম বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। তিনি ইংরেজ বিজনেস ম্যাগনেট, স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন!
আমরা যদি কোন ব্যক্তির ইসিজি রেকর্ডিংয়ের দিকে তাকাই তো দেখতে পাব, রেখাগুলো কোথাও শাঁ করে উপরে উঠে যাচ্ছে, আবার কোথাও এক নিমিষে ভূপতিত হচ্ছে। কোথাও রেখাগুলো স্থির অবস্থায় থাকছে তো কিছুক্ষণ পরই ভীষণ অস্থির। মানবজীবনের সাথে সম্পর্কিত এর চেয়ে ভালো রূপক আর বুঝি হতে পারে না কিছু। এখন যে মানুষটির কথা বলব, তাঁর জীবনের গ্রাফও ইসিজির গ্রাফের চেয়ে কোন অংশে কম বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। তিনি ইংরেজ বিজনেস ম্যাগনেট, স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন।
রিচার্ডের জন্ম এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর দাদা ছিলেন উনবিংশ শতকের শেষ ভাগের এক খুবই নামজাঁদা বিচারপতি। আর তাঁর বাবাও ছিলেন একজন বড় মাপের ব্যারিস্টার। তাঁর মা ছিলেন ইংল্যান্ডে বিমানে চড়ার সৌভাগ্য লাভ করা প্রথম কয়েকজন নারীর মধ্যে অন্যতম। সবমিলিয়ে বংশমর্যাদার দিক থেকে একদমই পিছিয়ে ছিলেন না তিনি।
কিন্তু তারপরও তাঁর এমন একটি সমস্যা ছিল যা তাঁকে পিছিয়ে দিয়েছিল সমবয়সী বেশিরভাগ ছেলেদের থেকেই। ঠিকমত কথা বলতে পারতেন না রিচার্ড। মোটর কো-অর্ডিনেশনে সমস্যা থাকায় তাঁর কথাগুলো জড়িয়ে যেত। তিনি কী বলতে চাচ্ছেন তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রোতার পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হতো না। তিনি মায়োপিয়া ও ডিসলেক্সিয়া নামের মেডিকেল কন্ডিশনের শিকার ছিলেন, যার ফলে একজন ব্যক্তি সারা জীবনভর ঠিকমত লিখতে বা পড়তে পারে না। কিন্তু এরপরও রিচার্ডের বাবা-মা তাঁকে একজন স্বাভাবিক শিশুর মত করে বড় করে তুলতে চেষ্টা করেন। পরিবারের রীতি মেনে তাঁকেও পাঠানো হয় একটি বোর্ডিং স্কুলে।
কিন্তু রিচার্ডের জন্য সেই অভিজ্ঞতা ছিল খুবই পীড়াদায়ক। কেননা ক্লাসে সবসময় তাঁকে তাঁর প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বিপাকে পড়তে হতো। ৮ বছর বয়স হয়ে গেলেও তিনি লিখতে বা পড়তে পারা আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হন। পড়াশোনা তাঁর জন্য এক বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর ব্যর্থতার জন্য প্রায়ই তাঁকে মার খেতে হতো শিক্ষকদের হাতে।
তবে তাঁর বাবার মতই, রিচার্ডও খেলাধুলায় ছিলেন খুবই পারদর্শী। তিনি স্কুলের ক্রিকেট, রাগবী ও ফুটবল দলের ক্যাপটেন ছিলেন। প্রতিটা রেসেই জিততেন তিনি। আর একবার শখের বশে লং জাম্পে নাম লিখিয়েও নতুন রেকর্ড গড়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু খেলার মাঠে তাঁর এই কৃতিত্বও বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি। ফুটবল খেলতে গিয়ে তিনি পায়ের ইনজুরিতে পড়েন, এবং চিকিৎসক তাঁকে ন্সাফ জানিয়ে দেন যে আগামীতে বেশ কিছুদিন তাঁকে সবধরণের খেলাধুলা থেকে দূরে থাকতে হবে। ফলে রিচার্ডকে আবার ফিরে যেতে হয় ক্লাসরুমের দমবন্ধ করা পরিবেশে।
১৯৬৩ সালে তিনি অন্য আরেকটি স্কুলে ভর্তি হন। স্টো নামের সেই স্কুলে তিনি দেখা পান জোনাথন হল্যান্ড জেমসের। জেমস তাঁর মধ্যে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলেন। ১৯৬৬ সালে তাঁরা দুজন মিলে 'স্টুডেন্ট' নামে একটি সংবাদপত্র বের করেন। এই পত্রিকায় কিশোর-তরুণদের সব মনের কথা, তাদের অধিকারের কথা, তাদের সংগ্রামের কথা উঠে আসতে থাকে। তাই কিশোর-তরুণদের কাছে এই পত্রিকাটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পত্রিকাটি পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও অনেক বড় বড় কয়েকটি কোম্পানিকে পেয়ে যায়।
'স্টুডেন্ট' পত্রিকা বের করতে গিয়ে রিচার্ড নতুন একটি জিনিস আবিষ্কার করেন, তা হলো প্রায় সব বয়সী মানুষের কাছেই সংগীত খুবই প্রিয় একটি জিনিস। তাই এবার রিচার্ড ঠিক করেন 'স্টুডেন্ট' পত্রিকার মাধ্যমেই যদি গানের রেকর্ডিং বিক্রির চেষ্টা শুরু করা যায়। সস্তা দামের গানের রেকর্ডিং বিক্রির জন্য তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি নতুন কোম্পানি দাঁড় করান, যার নাম দেন 'ভার্জিন' - কেননা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে তাদের কারোরই কোন অতীত অভিজ্ঞতা ছিল না।
১৯৭০ সাল নাগাদ 'স্টুডেন্ট' এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু 'ভার্জিন' এর রমরমা ব্যবসা চলছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে সেটিও বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় হয়, কেননা ডাককর্মীরা ওই সময়ে ধর্মঘট ডেকেছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে রিচার্ড এবার মেইলের মাধ্যমে রেকর্ডিং পাঠানোর বদলে 'ভার্জিন' নামে একটি গানের রেকর্ডিং বিক্রির দোকানই খুলে বসেন। সেই দোকানটিও তরুণ প্রজন্মের কাছে অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেখানে বসে তারা আড্ডা দিতে পারত, গান শুনতে পারত।
এরপর রিচার্ড মনস্থির করেন যে 'ভার্জিন রেকর্ডস' নামের একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও চালু করবেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তুলনামূলক কম জনপ্রিয় বা একেবারেই অপরিচিত কিন্তু মেধাবী সংগীতশিল্পীদের গানের রেকর্ডিং বের হতে শুরু করে। এবং এই উদ্যোগও এতই সাফল্য পায় যে 'ভার্জিন রেকর্ডস' হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বাধীন রেকর্ডিং লেবেল।
রিচার্ডের আগ্রহ অবশ্য কেবল সংগীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি একে একে আরও অনেক বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকেন, এবং ১৯৮৩ সাল নাগাদ তাঁর হাতে ছিল ৫০টিরও বেশি কোম্পানি, যার মূল্যমান ছিল ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৮৪ সালে তিনি এমনকি নিজের এয়ারলাইন্স ব্যবসাও শুরু করেন, নাম দেন 'ভার্জিন অ্যাটলান্টিক'। কিন্তু ১৯৯২ সালে আবার সেই এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠানই এত মার খায় যে ব্যাংক কর্তৃক সেটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়।
একটি ব্যাংক সেটির দখলদারিত্ব নিয়ে নেয়, এবং তা ফিরে পেতে তাঁকে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করতে হতো। এই বিপুল সংখ্যক অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে রিচার্ড তাঁর অধিকাংশ ব্যবসায়ের মালিকানাই বিক্রি করে দিতে থাকেন, এমনকি 'ভার্জিন রেকর্ডস'-ও। এভাবে 'ভার্জিন অ্যাটলান্টিক' ফিরে পান তিনি। কিন্তু ভালোবাসার রেকর্ড কোম্পানি হারিয়ে মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েন। তখনই শপথ নেন, এরপর আর কখনও আয়ের চেয়ে বেশি অর্থ ঋণ নেবেন না।
১৯৯৯ সালে রিচার্ড একজন উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর অবদানের জন্য 'নাইট' উপাধি পান। ২০০২ সালে বিবিসির জরিপে তিনি ব্রিটেনের সেরা ১০০ ব্যক্তির একজন নির্বাচিত হন। এই মুহূর্তে তিনি ৩০টি দেশে ৪০০ এরও বেশি কোম্পানির মালিক। তাঁর সম্পদের পরিমাণ এখন বাংলাদেশী টাকায় ৪২৫০ কোটির কাছাকাছি।
রিচার্ডের এই কাহিনী থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই। আট বছর বয়স পর্যন্ত যিনি লিখতে পড়তেই পারতেন না, সারাজীবন ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার, সেই তিনিই কিনা নিত্য-নতুন উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে আজ বিশ্বের সেরা ধনীদের একজন। যেসব ব্যক্তি নিজেদের সক্ষমতার ব্যাপারে সন্দিহান, রিচার্ডের জীবন সংগ্রামের গল্প তাদের জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণার উৎস।
আরও পড়ুন- ভার্জিন কোলা: হারিয়ে যাওয়া এক নস্টালজিয়া
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন