আমরা “কিভাবে বুঝবেন আপনি প্রেমে পড়েছেন কিনা? জেনে নিন এই ৫ টি লক্ষণ থেকে” অথবা “পছন্দের মানুষকে বশে আনতে ৭টি কৌশল” পড়ি মনোযোগ সহকারে, আর আশা করি কাজ হয়ে যাবে! আমরা আমাদের ফেসবুক কিংবা টুইটার আইডির পেছনে বেশি সময় দেই নিজের ব্যক্তিত্বের চাইতেও। তবুও, আমরা একটা সম্পর্ক চাই না!

ইফফাত ফারিয়া রঙ আমাদের ইন্সট্রাগ্রামে কাটানো অলস শুক্রবারের সকালের জন্য দরকার আরেকটি কফির কাপ। ফেসবুকের কাভার ফটোতে আরেক জোড়া জুতো লাগবে পা-সহ। আমরা চাই একটা অফিসিয়াল রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস, যাতে সবাই লাইক কমেন্ট দিতে পারে। আমরা স্বপ্ন দেখি ওই স্ট্যাটাস দিতে, যেটা ভাইরাল হবে #Relationship_goals সহকারে।

শনিবারের সকালে নাশতার জন্য কাউকে চাই, রোববারের সন্ধ্যার বার্গার একা জমেনা, অথবা মঙ্গলবার রাতের বিরিয়ানি। আমরা চাই কেউ একজন থাকুক, যে ঘুম ভাঙতেই একটা শুভ সকাল লিখে ম্যাসেজ দিবে। দাওয়াত পাওয়া সমস্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে আমাদের কাউকে দরকার। অন্ততপক্ষে এটুকু বোঝার চেষ্টা করার জন্য যে তারা কিভাবে পারলো বিয়ের মতো পদক্ষেপ নিতে! কীভাবে পারে সবাই আজীবন এক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকতে!?

কিন্তু, আমরা হচ্ছি সেই প্রজন্ম, যারা সম্পর্ক চায় না।

আমরা আশায় দিন অতিবাহিত করি সবদিক থেকে পারফেক্ট কাউকে পাবার জন্য। স্পেশাল চাহিদা দিয়ে পোস্ট করা অর্ডারের মতো। আমরা “কিভাবে বুঝবেন আপনি প্রেমে পড়েছেন কিনা? জেনে নিন এই ৫ টি লক্ষণ থেকে” অথবা “পছন্দের মানুষকে বশে আনতে ৭টি কৌশল” পড়ি মনোযোগ সহকারে, আর আশা করি কাজ হয়ে যাবে! আমরা আমাদের ফেসবুক কিংবা টুইটার আইডির পেছনে বেশি সময় দেই নিজের ব্যক্তিত্বের চাইতেও। তবুও, আমরা একটা সম্পর্ক চাই না।

আমরা কথা বলি, ক্ষুদেবার্তা পাঠাই, সেল্ফি তুলি বা ভিডিও কল দেই। ঘুরে বেড়াই বা সন্ধ্যাকালীন কফি খাই একত্রে; কখনো বা, পলাশীর শরবত। সব কিছু করি,বাস্তব একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া ছাড়া। আমরা দ্বিপাক্ষিক খেলা খেলতে থাকি, কেউ কাউকে জিততে দেই না। আমরা লোক দেখানো অভিমান, আত্মসম্মানবোধ আর অনুভূতিশূন্যতায় সিদ্ধহস্ত। অথচ আমরা একলা, আপনজনহীন, হতাশ আর ক্লান্ত।

আমরা সম্পর্কের আদরটুকু নিতে রাজি, কিন্তু সেটা নিতে যেটুকু সময় দিতে হবে, কষ্ট দিতে হবে তাতে আমাদের অনীহা। আমরা চাই হাত ধরতে। চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি আমাদের অজানা। হাসি ঠাট্টা আমাদের প্রিয়, দরকারি কথায় আমরা নেই। আমরা আবেগে চুবানো কথার ছলে ডুবে থাকতে চাই, দায়িত্ববোধের সময় আসলেই দে ছুট!

বছরঘুরে প্রথম দেখার দিন উদযাপন করতে চাই আমরা, কিন্তু বাকি ৩৬৪ দিনের কঠিন সময়টা পার করতে ইচ্ছে হয় না আমাদের। রূপকথার গল্পের “হ্যাপিলি এভার আফটার” সবাই মনে মনে চাই, তবে সাথে থাকার জন্য যে কাজগুলো করতে হবে তা পারি না, করতে ইচ্ছেও হয় না। আমরা ভাঙচুর করে ভালোভাসা চাই, তবে ধরি মাছ না ছুঁই পানি টাইপের চিন্তা মাথায় থাকে আমাদের। ছবির মতো সুন্দর একটা ছবি আমাদের মস্তিষ্ক চিন্তা করে, কিন্তু আঁকতে যে রঙ তুলির প্রয়োজন, নিদেনপক্ষে একটা পেন্সিল বা কালির কলম, তা আমাদের নেই!

আমরা চাই, কেউ এসে হাতটা ধরুক। তবে তার হাতে কখনোই আমাকে আঘাত করার জন্য একটা ছুরি তুলে দেবার সাহস আমাদের নেই! আমাদের হৃদপিন্ড কাঁচের, সে যেন চাইলেই ভেঙে টুকরো করে ফেলতে না পারে।

আমরা স্বপ্ন দেখি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে, যেটা ভাইরাল হবে #Relationship_goals সহকারে

আমাদের কাব্যিক কথাবার্তা খুব পছন্দসই, কেউ আমাদের নিয়ে কবিতা লেখুক, তবে উপন্যাস লিখে ফেললে আমরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। আমরা পড়ে যাই হোঁচট খেয়ে হুড়মুড় করে, উঠতে চাই না সহজে। আর কেউ যদি আমাদের টেনে তুলতে চায়, আমাদের আত্মসম্মানে খুব লাগে। আমরা চাই কারো পুরোপুরিভাবে হয়ে যেতে, একই সময়ে আবার স্বাধীনচেতা, নিরাপদ এবং আত্ননির্ভরশীল হতে চাই। আমাদের “ভালোবাসা” নামের বস্তুর প্রতি প্রবল টান। আফসোস, আমরা এর মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ে যেতে ভয় পাই!

আমাদের সম্পর্ক প্রয়োজন নেই- আমরা চাই প্রয়োজনের বন্ধুত্ব, শরীরী মেলামেশা, নেটফ্লিক্স আর হ্যাংআউট। কখনোবা অন্তঃরঙ্গ ছবি। আমাদের সম্পর্কের মায়া মায়া ব্যপারটার মোহে থাকতে ভালো লাগে। কিন্তু আসল সম্পর্কে জড়াতে আমরা ভয় পাই।

আমরা সব পুরষ্কার চাই, কিন্তু রিস্ক নিয়ে হেরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারিনা। উপহার নিতে চাই, খরচ করতে মন টানে না। আমরা যোগাযোগ রাখতে চাই। যথেষ্ট পরিমাণে, মাসে দুইটা যুগল সেলফি তুলে গভীর ভালোবাসাময় ক্যাপশনসহ চেকইন দেয়া যাবে, এর বেশি না। অনুভূতির বশে কিছুটা পাগলামি করতে চাই, সবটা না। আমরা ধীরেসুস্থে আগাই, দেখি পানি কতদূরে গড়ায়। সম্পর্ককে নাম দিতে আমাদের ঢের আপত্তি। 

আমরা এক পা দরজার বাইরে দিয়ে রাখি, এক চোখ রাখি খোলা। আমরা একটা মানুষকে এক হাত দূরত্বে রাখি, যেনো চাইলেই ধরা যায়। তার অনুভূতি নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত হয়ে যাই, তবে নিজের গুলো নিয়ে বেশি।

যখনই সম্পর্ক বাস্তবে রূপ নিতে যায়, আমরা দৌড়ে পালাই। আমরা লুকাই। সরে যাই। পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। একমাত্র প্রেম বলেও কিছু নেই। অনুভূতির স্টক আসলে অসীম। কিন্তু, সেই ভালোবাসাটা ধরে রাখার চেষ্টা অনেক কম।

আমরা চাই ভালোলাগার ভেতর হুটহাট করে পড়ে যেতে। আমরা চাই অসাধারণ একটা ফোনের এপ্লিকেশন এর মতো কিছু, যেটা প্রতিবার আপডেট করা যায়। মেমোরী চিপের একটা ফোল্ডারে সেভ করে রাখা যায়। প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে আস্তে করে ডিলিট করে দেয়া যায়।

আমাদের গল্পে বলা সেই সত্যিকারের ভালোবাসাটা কোথায়?

আমরা চাইনা আমাদের ছোট্ট অনুভূতির বস্তাটা খুলতে। আরো খারাপ ব্যাপার, অন্য কাউকেও দেই না। আমরা কুৎসিত জিনিসটাকে সুন্দর একটি খোলসে আটকে উপস্থাপন করি। কোন একটা অসামঞ্জস্যতা আমরা ইন্সট্রাগ্রামের ফিল্টারে ঢেকে দেই। পাশে বসে কথা বলার চেয়ে কোনো দুই বছরের পুরোনো টিভি সিরিজ দেখতে আমাদের আগ্রহ বেশি।

ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করে ভালোবাসার ব্যাপারটা চিন্তা করতে আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু আমরা আমাদের এই ইচ্ছেগুলোকে আলমারিতে আটকে রাখি। দিনের আলোয় তাদের কখনো বের করা হয়না। বছরঘুরে কোনো এক ঝড়বৃষ্টির রাতে সেসব মনে তোলপাড় করে।

আমরা একটা কর্তব্য অনুভব করি ভালোবাসার প্রতি, যেমনটা করি পড়ালেখা শেষে পাওয়া প্রথম চাকুরীর সময়। যৌবন আমাদের শিখিয়েছে, কিছু যদি পুরো মন দিয়ে চাওয়া হয়, সেটা পাওয়া যায়। ডিজনীর সব ছবিতে সত্যিকারের ভালোবাসা, অর্ধাঙ্গিনী, আজীবন সুখ এসব ব্যাপার সবার থাকে বলে ভেবে নেই আমরা। এজন্য আমরা কিছুই করিনা, বসে অপেক্ষা করি আর ভাবি আমাদের রাজপুত্র এখনো আসে না কেনো! আমরা হতাশ হয়ে যাই, আমাদের পাতালপুরের রাজকুমারীকে পাওয়া যাচ্ছেনা কেনো ভেবে!

আমাদের সান্ত্বনা পুরষ্কার কোথায়? আমরা তো এসেছি, আমাদের সম্পর্কগুলো কোথায়? আমাদের গল্পে বলা সেই সত্যিকারের ভালোবাসাটা কোথায়?

আমরা শূন্যস্থান চাইনা, আবার চাই না কোনো মানুষও। আমরা শীতের রাতে হাল্কা ওম চাই শরীরের উষ্ণতার, কিন্তু কোন দুঃখ ভাগ করার সাথী আমরা চাইনা। ক্লান্ত বিকেলে বারান্দায় বসার জন্য আমাদের পাশে কাউকে চাই। অথচ যখন উদ্দেশ্যহীনভাবে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াই, পাশের মানুষটার সাথে কোনো কথা বলি কি?

আমরা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করি। ভাব ধরি, আমরা অনুভূতিহীন। অথচ আমরা আমাদের হৃদয় হাতে নিয়ে ঘুরি, কেউ তো বলুক! ১০৮ টা নীলপদ্ম দিয়ে দেব! কিন্তু মনে মনে আবার দিতে বাঁধেও। আমরা খেলি, নানান রকম খেলা। নিজেরাও অনেক সময়ে বুঝি না। বন্ধুরা বসে খেলার নিয়মনীতি আলোচনা করি, কিন্তু কেউই জানি না কি খেলা খেলতে চলেছি।

কারণ, আমাদের প্রজন্মের সমস্যা হচ্ছে, না চাইতে চাইতে দিনের শেষে এসেও আমরা চাই একটা সম্পর্ককেই!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা