রেহনুমা ইনসান, ৩৫ টি দেশ, ৪০টি শহরে ভ্রমণ করেছেন। হিজাব তার বিশেষ ট্রেডমার্ক, মুসলিম নারী হিসেবে নিজের সংস্কৃতিকে রক্ষা করেই তিনি ঘরের বাইরের জগতটাকে উপভোগ করছেন। তার ভ্রমণ-গল্প দেখে মুসলিম নারী এবং হিজাব সংস্কৃতি সম্পর্কেও অনেকের ধারণা বদলাচ্ছে...

“A traveler enters the world into which he travels, but a tourist brings his own world with him and never sees the one he’s in.”

— Thomas H. Cook

একজন ট্রাভেলার এবং একজন ট্যুরিস্টের মধ্যে খুব সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। একজন ট্যুরিস্ট সেটাই দেখেন, যা তিনি দেখতে চান। কিন্তু একজন ট্রাভেলার অদেখা গল্প খুঁজে বেড়ান। ট্রাভেলারের জার্নিটা স্বতঃস্ফূর্ত, তিনি নিজের স্বাতন্ত্র্যকে যেমন বজায় রাখতে জানেন, তেমনি অন্যের বৈচিত্র্যকেও গ্রহণ করেন মুক্ত মনে। 

রেহনুমা ইনসান তেমনই একজন, ট্যুরিস্ট থেকে ট্রাভেলার হওয়ার পথে যিনি নিজের যে স্বতন্ত্র পরিচয় সৃষ্টি করেছেন! পৃথিবীর ভুখন্ডে ৩৫টি দেশের মাটি স্পর্শ করা এই ট্রাভেলার নিজের সাথে সাথে নিজস্ব সংস্কৃতিকেও প্রতিনিধিত্ব করছেন ভীনদেশে। একজন মুসলিম নারী হিসেবে তিনি গর্বিত, এই পরিচয়কে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনি লালন করেন। তিনি নিজ ধর্ম-চর্চার পাশাপাশি তার জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে মানুষ হিসেবে একজন মুসলিমের জীবনবোধ যেমন হয় সে সম্পর্কেও অন্যদের ইতিবাচক ধারণা দিতে চান। ইসলামিক সংস্কৃতিতে হিজাব খুব সিগনিফিকেন্ট একটি ট্রেডমার্ক। রেহনুমা ইনসান হিজাব পরিধান করে সাবলীলভাবে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নিজের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট দ্য ট্রাভেলেট ব্লগে তিনি লিখেছেন, 

"হিজাব আমার ব্যক্তিস্বত্তারই একটি অংশ। এটি আমার ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করছে, আমি যেমন তেমনটা হতে হিজাব আমাকে সাহায্য করেছে। এটিকে কেবল মাথায় পরিধানের এক টুকরো কাপড় বলে আমি মনে করি না। বরং এটি আমার জীবনযাপনের ধারা প্রকাশ করে, আমার দর্শনকে অর্থপূর্ণ করে..."

রেহনুমা ইনসান, ট্রাভেল স্টোরি, হালাল ট্যুরিজম
স্কটল্যান্ডের ভূমিতে  

যেমন তার ব্যক্তিজীবন 

আইন পেশায় যুক্ত মানুষটি গত তিন বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরছেন। ভ্রমণকে তিনি নিয়েছেন প্যাশন হিসেবে। এছাড়া তিনি কন্টেন্টও লিখেন। thetravellete. net ঠিকানায় তার লেখার খোঁজ পাওয়া যাবে। এছাড়া ফটোগ্রাফিতেও তার দারুণ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ফেসবুকে ও ইনস্টাগ্রামে তার তোলা ট্রাভেল ফটোগ্রাফির একটি দারুণ ফলোয়ার কমিউনিটিও তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে। অধিকাংশ ছবিই অবশ্য স্মার্টফোনেই তোলা, তবে প্রকৃতির রঙ এবং কোনো শহরের ইউনিক ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে তার এক্সপেরিমেন্ট বেশ চোখ জুড়ানোই বটে। 

রেহনুমা ইনসান
মরক্কোর নীল শহর | এল আইয়ুন 

বর্তমান সময়ে একজন মুসলিম নারী হিসেবে তার বিদেশ ভ্রমণের গল্প দক্ষিণ এশিয়ার ট্রাভেলার কমিউনিটিতে বেশ সাড়া ফেলেছে। ইউটিউব কিংবা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা যেসব নারীদের ভ্রমণের চিত্র দেখতে পাই, সেখানে কদাচিৎ মুসলিম নারীদের দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে খানিকটা রিজার্ভড সংস্কৃতি বলয়ে বেড়ে উঠার কারণে বাংলাদেশ কিংবা মুসলিম বিশ্বের নারীদের ভ্রমণে কিছুটা কম দেখা যায়। তার চেয়ে দুঃখজনক হলো, কোথাও কোথাও মুসলিম ফোবিয়ার কারণে অনেকেই ইসলামিক সংস্কৃতি বজায় রেখে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিধায় ভোগেন। আবার কেউ কেউ অন্যদের লাইফস্টাইলের সাথে তাল মেলাতে নিজের সংস্কৃতিকে চাপা দিয়ে ফেলেন, হয়ত হীনমন্যতায় কিংবা মানসিক দ্বিধায়। 

রেহনুমা ইনসান এই গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে নিজের কালচারকে অতি সাবলীলতা ও আত্মবিশ্বাসের সাথেই বহন করে চলেছেন। সম্ভবত একারণেই রেহনুমা ইনসানের ভ্রমণ গল্প শুনবার ও দেখবার জন্যে অগণিত মানুষের কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। 

শৈশবের ভ্রমণ

শুরুর দিকের কথা। শৈশবের দিনগুলোতে বছরের কোনো একটা সময় নিয়ম করে ফ্যামিলি ট্রিপে যেতেন রেহনুমা ইনসান। তিনি মনে করেন, ভ্রমণের আগ্রহ আকাঙ্খা তার রক্তেই মিশে আছে কারণ তার বাবা-মা ঘুরে বেড়াতে ভীষণ পছন্দ করেন। 

রেহনুমা ইনসান
ফ্যামিলি টাইম!

যদিও শৈশবের সেসব ট্রিপগুলো ছিল সাজানো গুছানো, কোনো সুন্দর রিসোর্টে ছুটির দিন কাটানোর মতো ব্যাপার, ট্যুরিস্টদের মতো। রেহনুমা ইনসানের দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে ভ্রমণ নিয়ে তার চিন্তাভাবনাও বদলালো। গত তিন বছর ধরে তিনি ট্যুরিস্ট নয়, ট্রাভেলার হওয়ার পথে হেঁটেছেন। তিনি বিশাল এই পৃথিবীর ভুখন্ড থেকে যতটুকু মুগ্ধতা কুড়ানো যায়, সেই লক্ষ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। 

ট্রাভেলার রেহনুমা ইনসানের দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বড় প্রেরণাই হলো নতুনকে জানার আকাঙ্খা, পৃথিবীর উন্মুক্ত পাঠশালা থেকে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করা যায়। তাছাড়া দিনশেষে আমাদের যা কিছু অবশিষ্ট থাকে তা আসলে কোনো ম্যাটেরিয়াল না, তার নাম গল্প। যখন আমাদের পরের প্রজন্ম বড় হবে, একদিন সবচেয়ে সুন্দর ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটা গল্প হয়ে আমাদের মধ্যে ভাল লাগা তৈরি করবে। আজকের মুহুর্তে যে অভিজ্ঞতা আমরা তৈরি করি, জীবনের এক পর্যায়ে এসে তা আমাদের সবচাইতে অমূল্য সম্পদ হয়ে যায়। 

রেহনুমা ইনসান
নতুনকে জানার আকাঙ্ক্ষাই রেহনুমাকে ট্রাভেলার বানিয়েছে

স্মল টাউন মেন্টালিটি

"স্মল টাউন মেন্টালিটি" বলে একটা ব্যাপার আছে। রেহনুমা ইনসান এই মানসিকতাকে ব্যাখ্যা করেছেন সহজ করে। 

আমাদের চারধারে এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যারা সারা জনম ধরে একটা নির্দিষ্ট আবদ্ধ জায়গাতেই জীবনটা পার করে দেন। প্রতিদিনকার রুটিনে কোনো বড় পরিবর্তন নেই, একই মানুষদের পরিমন্ডলের বাইরে তারা যান না। নিজের চেনা জগত ছেড়ে অন্য কোথাও তাদের এক্সপ্লোর করা হয় না। একটা নির্দিষ্ট ধ্যান ধারণার বাইরে তারা জীবনের বিচিত্রতকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন না। তাই সমাজ, জীবন, মানুষ সম্পর্কে তাদের ধারণা অতি সীমাবদ্ধ গন্ডির ভেতরেই থেকে যায়৷ কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল, ছোট শহরে জন্ম নেয়া কারো হাতে নেই কিন্তু এই চেনা জীবনের বাইরে কখনোই যেতে না চাওয়ার মানসিকতাই 'স্মল টাউন মেন্টালিটি'। 

 রেহনুমা ইনসান
ভ্রমণের জন্য স্মলটাউন মেন্টালিটিতে পরিবর্তন আনা জরুরী

তার মানে এই নয়, ট্রাভেলিংয়ের জন্যে আপনাকে দেশের বাইরেই যেতে হবে, বড় শহরে ঘুরতে হবে, ইউরো ট্রিপ না দিতে পারলে আপনি ট্রাভেলার হতে পারবেন না- এমনটা কখনোই নয়। রেহনুমা ইনসান তার একটি লেখায় লিখেছেন, "ট্রাভেলিং মানেই ইউরো ট্রিপ নয়, আপনি যেভাবে এটাকে দেখবেন ট্রাভেলিং ঠিক তা-ই। হতে পারে এটা একদিনের একটা ভ্রমণ কাছে কোথাও কিংবা পরিবারকে সাথে নিয়ে এক বিকেলে সমুদ্র দেখা। যতক্ষণ আপনি নিজে আনন্দ খুঁজে পান, নতুন একটা জায়গা আপনি দেখতে পারছেন, হয়ত নতুন কিছু শিখতে পারছেন - এই অভিজ্ঞতার জন্যই আপনি ট্রাভেলার।"

রেহনুমা ইনসান মনে করেন 'স্মল টাউন মেন্টালিটি'কে পরিবর্তন করতে পারে ট্রাভেলিং। আপনি নিজেকে আরো ভাল করে তখনই চিনতে পারেন যখন আপনি অন্যদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, তাদের জগতটাকেও পর্যবেক্ষণ করতে শেখেন। ট্রাভেলিং আপনাকে কম্ফোর্ট জোনের বাইরে গিয়ে ভাবতে শেখায়। আপনি মানুষের মধ্যে খুঁত খোঁজার পরিবর্তে তাদের বৈচিত্র্য জীবনকে শ্রদ্ধা করতে শেখেন, তাদের মানসিকতাও ধারণ করতে জানেন। ফলে দিনশেষে আপনার নিজের মানসিকতা হৃদ্ধ হয়, আপনি আত্মবিশ্বাসী হন।

ব্রেক দ্য স্টেরিওটাইপ

তবে আত্মবিশ্বাস রাতারাতি তৈরি হওয়ার ব্যাপার নয়। বিশেষত মুসলিম নারীদের জন্যে এখনো ঘরের বাইরের জগত এক্সপ্লোর করার পরিকল্পনা করা একটু কঠিনই। লোকে কি বলবে, কি ভাববে, মানুষ কি তাচ্ছিল্য করবে কিনা, হিজাব পড়ার কারণে একটু অন্য চোখে দেখবে কিনা, কোনো রকম বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়ার ঝুঁকি আছে কিনা - এমন অনেক প্রশ্ন আপনার মাথার ভেতর ঘুরতেই পারে। কিন্তু, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনি কখনোই পাবেন না, যদি না কখনো নিজে উত্তর খুঁজতে চেষ্টাই না করেন। 

সুইজারল্যান্ডের একজন নারী ট্রাভেলার, রাইটার এবং একই সাথে ফটোগ্রাফারও যিনি- এলা মেইলার্ট যেমনটা বলেছেন, 

“You do not travel if you are afraid of the unknown, you travel for the unknown, that reveals you with yourself.” 

নিজের প্যাশন উপলব্ধি করবার পর রেহনুমা ইনসান গত তিন বছরে পৃথিবীর ৪০+ ভিন্ন ভিন্ন শহরে গেছেন। ফেসবুকে এবং ইনস্ট্রাগ্রামে তিনি নিয়মিত একটা প্রশ্ন শুনতে পান, হিজাবের কারণে কি তাকে কখনো বিরুপ আচরণের মুখে পড়তে হয়েছে কিনা? কেউ বাঁকা চোখে তাচ্ছিল্যের ভাব দেখানোর চেষ্টা করেছে কিনা? 

রেহনুমা ইনসান
ক্যাপাডোসিয়া, আনাতোলিয়া | তুরস্ক 

এই প্রসঙ্গে রেহনুমা ইনসান নিজের অভিজ্ঞতার বিবৃতি দিয়েছেন এই বলে, "রেহনুমা ইনসান বলেন, "আপনাকে কখনোই নিজের ধর্ম কিংবা বিশ্বাস ত্যাগ করতে হবে না ভ্রমণ করার জন্যে, আপনি বরং আরো বেশি ভ্রমণে বের হবেন যেন আপনার আচরণের ভাল গুণাবলি অন্যরা দেখে তাদের ভুল ধারণা ভেঙ্গে যায়। যেন অন্যরা উপলব্ধি করতে পারে আপনি হিজাব কিংবা জাতীয়তা অন্যের জন্য কোনোভাবেই হুমকিস্বরুপ নয়।"

নরওয়ের ঝড়ো হাওয়ার দিনে

প্রাসঙ্গিক একটা গল্প বলা যাক। রেহনুমা ইনসান ভ্রমণে বেরিয়েছেন নরওয়ে নামক দেশটিতে৷ এক ঝড়ো হাওয়ার দিন। তীব্র বেগে বাতাস ছুটছে। রেহনুমা ইনসান খেয়াল করলেন বাতাসের গতি এতোটাই বেশি যে, এই বাতাস তার হিজাব উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। তিনি এক প্রকার হিমশিম খাচ্ছিলেন স্কার্ফ সামলাতে গিয়ে। হেয়ার ক্লিপটাও খুব শক্তিশালী ছিল না যে এরকম বাতাসে স্কার্ফ উড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারে। তিনি এক্সট্রা সেফটি পিনও সাথে নিয়ে যান নি। ফলত, একটু বিব্রত ও চিন্তিত হবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। 

তিনি সেখান থেকে দ্রুতই দোকান খুঁজতে শুরু করলেন যেখানে সেফটি পিন পাওয়া যাবে। কিন্তু এই শহরে তিনি সবেমাত্র এসেছেন, জানাশোনা নেই। দোকান খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। 

রেহনুমা ইনসান
সানতোরিনি | গ্রীস

স্কার্ফ সামলানোর যুদ্ধ কর‍তে করতেই বিশ মিনিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে দোকান খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ঠিক তখুনি হঠাৎ খেয়াল করলেন একটি জুয়েলারি দোকান থেকে এক ভদ্রমহিলা প্রায় দৌড়ে এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। তিনি রেহনুমা ইনসানের হাতে তুলে দিলেন সেফটি পিনের এক আস্ত সেট! এবং বললেন, 

"আমি তোমাকে কয়েকমিনিট ধরে দেখছিলাম। মনে হলো স্কার্ফের জন্যে সেফটি পিনগুলো কাজে লাগবে তোমার.."

ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভীয় অঞ্চলের দেশ নরওয়ের এক অচেনা শহরে এক অচেনা নারীর এই উদারতায় রেহনুমা ইনসান মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না। তিনি বললেন, 

"আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ...আমি খুবই চিন্তায় ছিলাম যে হয়ত স্কার্ফটা উড়ে যেতে পারত। নরওয়েতে আমার আজই প্রথম দিন, আমি বুঝতে পারছিলাম না কোথায় সেফটি পিন খুঁজব.."

ভদ্রমহিলা তা শুনে বললেন, ওহ! আমিও তোমার স্কার্ফ নিয়ে চিন্তা করছিলাম। আমি বুঝতে পারছি এই কাপড়ের টুকরো নিশ্চয়ই তোমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এনিওয়ে, ওয়েলকাম টু নরওয়ে!"

এই গল্পের একটা খুব দারুণ মেসেজ আছে। আমরা খুব সামান্য মানুষের মতামতের ভিত্তিতে পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করি। কিন্তু, যখন আমাদের সুযোগ হবে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষকে জানার, তখন অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করবো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের ভেতর অদ্ভুত কোমল এক সত্ত্বা আছে, সেখানে মানুষ উদারতা পুষে রাখে, ভালবাসা জমিয়ে রাখে, অন্যের বিপদে চিন্তিত হয়। 

রেহনুমা ইনসান
হিজাব কখনোই সমস্যা নয়

সমস্যা কখনোই হিজাবে নয়!

হিজাব, বোরকা পরিধান করে চলাফেরা করা, পশ্চিমের দেশে ঘুরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে রেসিজমের শিকার হওয়ার আশঙ্কা তবুও যে একেবারেই নেই তা নয়। বিশেষ করে বিশ্বের কিছু কিছু দেশে ইসলামফোবিয়া যে বিদ্যমান তা আমাদের কাছে অপরিচিত ঘটনা নয়। এমেরিকার মতো দেশে এখনো বর্ণবাদ অতি পরিচিত ঘটনা। আমরা নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দেখেছি এক মুসলিম বিদ্বেষীর ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড। আবার ভিন্ন ঘটনাও আছে। আমরা আবার এমেরিকাতেই দেখেছি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন। দেখেছি নিউজিল্যান্ডের খৃষ্টানরাই মুসলিমদের মসজিদ পাহাড়া দিচ্ছে। সব মানুষ একরকম নয়। আপনি এই সাতশো কোটি মানুষের পৃথিবীতে ভাল মন্দ মিলিয়ে সব রকম মানুষের দেখাই পাবেন। পৃথিবী আসলে আমাদেরই প্রতিচ্ছবি।

এই যেমন একবার রেহনুমা ইনসানকে একজন বললেন, কোনো কোনো দেশের মিডিয়াতে মুসলিম সম্পর্কে যে নেগেটিভ একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, হিজাবি নারীদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তার সাথে রেহনুমা ইনসানের কোনো মিল নেই৷ রেহনুমা ইনসানকে দেখে মুসলিম নারীর প্রতি তাদের ধারণা পাল্টে যাচ্ছে! এর চেয়ে দারুণ ব্যাপার আর কি হতে পারে? একজন ট্রাভেলার সিম্পলি শুধু তার ট্রাভেল স্টোরি শেয়ার করে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছেন, মুসলিম নারীদেরকেও উৎসাহিত করছেন - এটা নিছক তুচ্ছ কনট্রিবিউশন নয়। কারো মনোভাবে প্রভাব ফেলা এটা বরং পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি। রেহনুমা ইনসান সেই কাজটিই অবলীলায় করছেন।

রেহনুমা ইনসান
মুসলিম নারীর ধারণা পাল্টে দিচ্ছেন রেহনুমা ইনসান

স্বপ্ন ছড়ানোর পালা

আজকাল অনেকেই স্বপ্ন দেখে তারাও রেহনুমা ইনসানের মতো দেশে দেশে ঘুরবেন, প্রাণ খুলে জীবনকে উপভোগ করবেন একই সাথে নিজের স্বকীয়তাও রক্ষা করে চলবেন। রেহনুমা ইনসান ব্যতিক্রমী এক ট্রাভেলার যিনি শুধু ট্রাভেলিংয়ের অ্যাম্বাসেডর নন, তিনি দেখিয়েছেন নিজস্ব লাইফস্টাইলকেও কিভাবে রক্ষা করে পৃথিবীর সাথে ঐক্য রক্ষা করে চলা যায়। 

তার স্বপ্নও তাই একটু অন্যরকম। তিনি শুধু ট্রাভেল স্টোরি শেয়ার করতে চান না বরং তিনি চান তাকে দেখে দক্ষিণ এশিয়ান নারীরাও যেন আত্মনির্ভরশীল, আত্মবিশ্বাসের পারদকে সর্বোচ্চ মাত্রায় উপভোগ কর‍তে পারে। তিনি বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে চান কারো ব্যতিক্রমী জীবন, তার ধর্ম, গাত্রবর্ণ, জেন্ডার কোনো কিছুই বাঁধা হতে পারবে না যদি আমরা একটু আত্মবিশ্বাস রাখি। 

রোমানিয়াতে একবার একটা ঘটনা ঘটেছে। রেহনুমা ইনসান শহরে ঘুরছেন, ছবি তুলছেন। তাকে দেখে একজন কৌতুহলী হয়ে উঠলেন। সেই ভীনদেশি নারী রেহনুমা ইনসানের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তোমাকে কিছুক্ষণ ধরেই খেয়াল করছিলাম। তুমি যেভাবে দীর্ঘ গাউন এবং হিজাব পড়লে তা আমার কাছে খুবই চমৎকার মনে হচ্ছে।" সেই ভদ্রমহিলা হিজাব সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাইলেন, কিছুক্ষণ কথা বলে স্মৃতি ধরে রাখতে ছবিও তুললেন। 

এই নারীর সাথে পরবর্তীতে রেহনুমা ইনসানের ইনস্টাগ্রামেও যোগাযোগ হয়। তারা বন্ধু হয়ে উঠেন। কখনো কখনো আমাদের কালচার, আমাদের ধর্ম, আমাদের ভিন্নতাই অন্যের সাথে সম্পর্ক সূত্র তৈরি করে দেয়। উদারতা, খোলা মন, কৌতুহল, শ্রদ্ধা, সহনশীলতাই মানুষে মানুষে দূরত্ব কমিয়ে বন্ধুত্বের সৃষ্টি করতে পারে। ট্রাভেলিং আমাদের অপূর্ব অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা দেয়ার সাথে সাথে অসাধারণ মানুষদেরকেও জানবার সুযোগ করে দেয়।

শান্তির যাত্রা চলুক...

রেহনুমা ইনসান মনে করেন, মানুষজন আমাদের সাথে অধিকাংশ সময় তেমন ব্যবহারই করে, যেমনটা আমরা তাদের সাথে করি। 

রেহনুমা ইনসান
শান্তির বার্তা ছড়িয়ে চলেছেন রেহনুমা ইনসান

এটা আসলে হিউম্যান নেচারেরও একটা অংশ। একজন মানব শিশু জন্মের পর সেভাবে কথা বলতে শিখে, আচরণ করতে শেখে যা সে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে দেখে, শুনে। এই ব্যাপারটি সারাজীবন ধরেই চলতে থাকে। যদি আমরা কাউকে ঘৃণা করি, বিনিময়ে ভালবাসা আশা কিভাবে করব! কেউ আমাদের দিকে তখনই হাসি ফিরিয়ে দিবে যখন আমরা তাদেরকে উদার মনে হাসি উপহার দিব। 

মানুষে মানুষে আজকাল এতো বৈপরীত্য, এতো ঘৃণার চর্চা - এর মধ্যে একজন ট্রাভেলার শান্তির বার্তা ছড়াচ্ছেন। রেহনুমা ইনসানের এই শান্তির যাত্রা চলতে থাকুক, পৃথিবী জানুক আমাদের জাতি, বর্ণে, ধর্মের ভিন্নতা কখনোই আমাদের বন্ধুত্বের পথে বাঁধা নয়!

​​​*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা