রেড বুল: লোকাল, সস্তা সিরাপ থেকে বিশ্বখ্যাত ব্রান্ড!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
থাইল্যান্ডে স্থানীয়ভাবে চালু হওয়া এ এনার্জি ড্রিংক নিয়ে উদ্যোক্তা চালাও এর কোনো বড় স্বপ্নও ছিলো না। কিন্তু হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা যেভাবে পুরো গল্পটাকেই পাল্টে দিলো, সেটা একইসাথে চমকের, অনুপ্রেরণার ও সাফল্যের!
মানুষটির নাম চালেও ইউভিদিয়া। চাইনিজ গরিব পরিবারের সন্তান চালেও তার পরিবার সহ খুব অল্পবয়সেই চলে আসেন থাইল্যান্ডে, নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনে। যদিও থাইল্যান্ডে এসে খুব যে লাভ হচ্ছিলো, এরকম কিছু না। হাঁসপালন আর সামান্য কিছু কৃষিকাজ করে দিনযাপন করছিলেন। দৈন্যদশা কাটছিলো না তবুও। চালেও'র বয়স তখন বিশ। ওষুধ কোম্পানিতে চাকরী পেলেন একটা। কয়েক বছর সেখানেই চাকরী করলেন। খুব গভীরভাবে দেখতে শুরু করলেন ওষুধ বানানোর ও বিক্রির প্রক্রিয়াগুলো, এরপর সাহস করে নিজেই ওষুধের ব্যবসা শুরু করলেন। এন্টিবায়োটিকস বানিয়ে বিক্রি করা শুরু করলেন স্থানীয় বাজারগুলোতে।
সেই ব্যবসা চলছিলো। থাইল্যান্ডে এনার্জি ড্রিংকের তখন রমরমা ব্যবসা। দেশ বিদেশের নানারকম এনার্জি ড্রিংকস পাওয়া যাচ্ছিলো এখানে। তবে এরমধ্যে জাপানি এক কোম্পানির এনার্জি ড্রিংক বেশ ভালো ব্যবসা করছিলো। থাইল্যান্ডের মানুষজনও নিয়মিত খেতো এগুলো। তবে জাপানি সহ বাকি এনার্জি ড্রিংকগুলোর একটু সমস্যা হলো, দাম একটু চড়া ছিলো তাদের। সবাই কিনতে পারতোনা এগুলো। বিশেষ করে সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকতো এই ড্রিংকগুলো।
চালেও ভাবলেন এটা একটা ভালো জায়গা, ব্যবসা করার। তিনি যদি স্বল্পখরচে এনার্জি ড্রিঙ্ক বানিয়ে বাজারে ছাড়তে পারেন, এবং মানুষ যদি অল্প দামে কিনতে পারে, তাহলে এনার্জি ড্রিঙ্কের এই ব্যবসায় লাভ হলেও হতে পারে। তাছাড়া তৃণমূল মানুষ, যারা কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের লাভও হতে পারে এই এনার্জি ড্রিঙ্ক কম দাম পেলে।
চালেও, ক্যাফেইন, টরিন, গ্লুকোজ, বি ভিটামিন আর অন্যান্য কিছু জিনিসপত্র মিলিয়ে এনার্জি ড্রিংক বানালেন, যার নাম দিলেন ক্রেটিং ডায়েং। যেটার স্বাদ অনেকটাই মেডিসিন টাইপের আর হালকা মিষ্টি। জাপানের সেই এনার্জি ড্রিংকের স্টাইলেই বানিয়েছিলেন তিনি ক্রেটিং ডায়েং। তবে এটির স্বাদ ও ঘ্রাণ ছিলো আরেকটু সুন্দর। এটাই পার্থক্য। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাতে ভুলে গিয়েছি। 'ক্রেটিং ডায়েং' এর ইংরেজি কী শুনবেন? 'রেড বুল।' কী চমকে গেলেন? চমকে গেলেও এটাই সত্যি। বিশ্বসেরা এনার্জি ড্রিংক 'রেড বুল' এর শুরুটা ঠিক এভাবেই।
যাই হোক, চালেও'র এই 'ক্রেটিং ডায়েং' থাইল্যান্ডে খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়। মানুষজনও বেশ পছন্দ করা শুরু করে স্বল্পমূল্যের এই এনার্জি ড্রিংককে। দামটাও নাগালের মধ্যে হওয়ায় পুরো বিষয়টা হয়ে যায় একেবারে 'মণিকাঞ্চনযোগ'। তবে এক্ষেত্রে চালেও'র প্রমোশন স্টাইল ও বিজনেস সেন্সের প্রশংসা করতেই হবে। ক্রেটিং ডায়েং এর বোতলের ছবিটাই ছিলো বেশ আকর্ষণীয়। দুটি বাইসন মুখোমুখি লড়াইয়ে লিপ্ত। যে ছবি বা ডিজাইনটি এখনো রয়েছে 'রেড বুল' এর সাথে। এই ডিজাইনের মেটাফোরিক্যাল মানেও ছিলো। মানুষ ভাবতো, এই ড্রিংক খেলে গায়ে ষাঁড়ের মতন শক্তি হবে। তাছাড়া কেউ কেউ এটাও ভাবতো, ষাঁড়ের সিমেন ব্যবহৃত হয় এই ড্রিংকসে। তবে এগুলো নিতান্তই মানুষের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। তবে এই মিথগুলো 'ক্রেটিং ডায়েং' এর বিজনেসে বেশ সাহায্য করে।
চালেও'র হয়তো প্ল্যান ছিলোনা থাইল্যান্ডের বাইরে যাওয়ার। স্থানীয়ভাবে শুরু করলেও আস্তে আস্তে তার ড্রিংক জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে জাতীয়ভাবে। বিভিন্ন স্পোর্টস কম্পিটিশনে স্পন্সর হওয়া শুরু করে চালেও'র 'ক্রেটিং ডায়েং'। জাতীয়ভাবে সবার প্রিয় এনার্জিং ড্রিংক হয়ে যায় এটি।
এরমধ্যেই ঘটে আরেকটি ঘটনা। ডিটরিখ মাটেসচিটজ নামের একজন অস্ট্রিয়ান ব্যক্তি থাইল্যান্ডে ঘুরতে আসেন। পেশায় তিনি ছিলেন টুথপেস্ট ব্যবসায়ী। তো, থাইল্যান্ডে এসে তিনি জেট ল্যাগে পড়েন। সেটা কাটাতে এনার্জিং ড্রিংকের খোঁজে তিনি দোকানে যান। সেখানে পান ক্রেটিং ডায়েং'কে। পান করেন এবং অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। খুঁজে বের করেন চালেও ইউভিদিয়া কে। চালেও কে অফার দেন তিনি, এই এনার্জিং ড্রিংকের জন্যে তিনি অস্ট্রিয়ায় কোম্পানি স্থাপন করবেন এবং সারা পৃথিবীতে এটা ছড়িয়ে দেবেন। চালেও প্রস্তাবে রাজি হন।
ডিটরিখ 'ক্রেটিং ডায়েং' নাম পরিবর্তন করেন, রাখেন 'রেড বুল'। তাছাড়া স্বাদটাও খানিকটা পরিবর্তন করেন। যাতে করে বিদেশি লোকজনের জিভে খুব বেশি অপরিচিত না লাগে স্বাদটা। আগের চেয়ে খানিকটা বেশি কার্বোনেটেডও করে দেন পানীয়টিকে। সিলভার আর নীল রঙা ক্যানে বাজারজাত করা হয় রেড বুল'কে। এরপর ছড়ানো শুরু হয় সারা পৃথিবীতে।
বাকিটা অবশ্যই ইতিহাস। প্রথমদিকে রেড বুল এর জন্যে অতটা হাইপ তৈরী না হলেও আস্তে আস্তে রেড বুল শুরু করে বাজার দখল। তরুণ প্রজন্ম, যারা খেলাধুলা করছেন অর্থাৎ স্পোর্টসম্যান, তাদের টার্গেট অডিয়েন্স করে রেড বুলের বিজনেস প্ল্যান শুরু হয়। এমনভাবে তারা মার্কেট আঁকড়ে ধরেন, যে স্থান থেকে তাদের সরানো যায়নি আজও।
রেড বুলের আরেকটা অসাধারণ স্ট্রাটেজি ছিলো, আশেপাশে, দেশে-বিদেশে যতগুলো স্পোর্টস কম্পিটিশন প্রায় সবগুলোতেই তারা স্পন্সর হতো বা হওয়ার চেষ্টা করতো। অবস্থাদৃষ্টে একটা সময়ে এমন দাঁড়ালো যে, রেড বুল হয়ে গেলো স্পোর্টসের সমার্থক। স্পোর্টসম্যান, অডিয়েন্স, টীম ক্রু... সবার সবথেকে প্রিয় এনার্জি ড্রিংক এর নাম হয়ে গেলো একটাই- রেড বুল। তাছাড়া সব কম্পিটিশনেই নিজেদের নাম থাকার কারণে ব্রান্ডিংটাও হলো বেশ জোরেসোরেই। এরপরই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হলোনা কখনোই।
বর্তমানে বিশ্বের ১৭১ এরও বেশি দেশে প্রায় ১৬ ধরনের রেড বুলের ফ্লেভার ব্যবসা করছে। ২০১৯ সালে এক বছরেই তারা প্রায় ৭.৫ বিলিয়ন রেড বুল বিক্রি করেছে! রেড বুলের বর্তমান ব্র্যান্ড ভ্যালু এক মিলিয়ন বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মার্কেট রেভিনিউ ৬.৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার। রেড বুল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এনার্জিং ড্রিংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বেশ অনেকদিন ধরেই এবং একচেটিয়াভাবেই শীর্ষস্থানটি ধরে রেখেছে তারা। ফর্মুলা রেসিং এ তাদের স্পন্সর করা কার আছে, ফুটবল টীমও আছে তাদের নিজস্ব। অন্যান্য স্পোর্টসের দিকেও তারা ছুটছে নিয়মিত।
অস্ট্রিয়া'তে যখন রেড বুল যাত্রা শুরু করে, তখন এর স্লোগান ছিলো- 'রেড বুল গিভস ইউ উইংস'। মানুষকে ডানা মেলতে সাহায্য করেছিলো কী না, জানা নেই। তবে 'রেড বুল কোম্পানি' ডানা মেলে চলে গিয়েছে সবারই ধরাছোঁয়ার বাইরে। চালেও হয়তো নিজেও আশা করেননি, তার বানানো লোকাল একটি এনার্জি ড্রিংক এভাবে দুনিয়া কাঁপাবে। টুথপেস্ট ব্যবসায়ী ডিটরিখও হয়তো ভাবেননি, থাইল্যান্ডের একটা স্থানীয় এনার্জি ড্রিংক তাকে এমন মাত করবে আর তিনি সেটিকে নিয়ে ছড়িয়ে দেবেন সারা দুনিয়ায়। সবকিছু সবসময়ে কঠোর পরিশ্রম দিয়ে হয় না। মাঝেমধ্যে ভাগ্যই যে সবকিছুর উপরে ছড়ি ঘোরায়, সেটার উদাহরণ হিসেবে এই ঘটনাই তো সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল!
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন