রতন টাটা: দ্য ইনক্রেডিবল জার্নি অফ এ বিলিওনিয়ার!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ দেখেছেন, যেতে হয়েছিল এতিমখানায়। সংগ্রাম করে জীবনের একেকটা সিঁড়ি ভেঙেছেন তিনি, টাটা গ্রুপে তার চেয়ারম্যান হওয়াটাও ভালো চোখে দেখা হয়নি। জীবনে প্রেম এসেছে, কিন্ত বিয়েথা করেননি, তার পেছনেও গল্প আছে। এই ভদ্রলোকের জীবন নিয়ে একটা নয়, কয়েকটা সিনেমা বানানো যাবে...
এই কয়দিন আগে পর্যন্তও 'টাটা ন্যানো' গাড়ি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। 'টাটা গ্রুপ' তাদের একটা ইন্টারন্যাশনাল ইমেজই তৈরী করেছে কালের ব্যবধানে। তবে যেকোনো বিশাল অর্জনই হাতছোঁয়া দূরত্বে আসে কিছু মানুষের ঐকান্তিক শ্রমে আসে। যেরকমটা আমরা দেখি, টাটা গ্রুপের সিইও রতন টাটার ক্ষেত্রে। যার জীবনের উত্থান ও সাফল্যের গল্প অনেকটা শাহরুখ খানের সিনেমার মতন, তীব্র সিনেম্যাটিক। আজ জানবো সেই মানুষটির গল্পই।
ছোটবেলা খুব ভালো কাটেনি রতন টাটার। 'টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা' জামশেদজি টাটার ছোট ছেলে স্যার রতনজি টাটা নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি দত্তক নেন নাভাল টাটাকে। এই নাভাল টাটার প্রথম স্ত্রী'র সন্তান ছিলেন রতন টাটা। রতনের বয়স যখন দশ, তখন বাবা-মা'র মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর রতনের মা এতটাই অসহায় হয়ে পড়েন যে, রতন টাটাকে তখন অবস্থান নিতে হয় 'জে.এন, প্রিতিত পার্সি' নামের এক অনাথ আশ্রমে। দাদী নবতাজবাই টাটা এটা জানতে পেরে সঙ্গেসঙ্গে অনাথ আশ্রমে আসেন এবং দুই নাতি ও পুত্রবধুর দায়িত্ব নেন। দাদীর কাছেই শৈশবের দিনগুলো কাটান রতন।
এরপর পড়াশোনা শুরু করেন চ্যাম্পিয়ন স্কুলে। এখানে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ার পর মুম্বাই এর ক্যাথেড্রাল এ্যান্ড জন ক্যানন স্কুলে পড়তে যান তিনি। পড়াশোনা করেছেন সিমলার বিশপ কটন স্কুলেও। পরবর্তীতে নিউ ইয়র্কের রিভারডেল কান্ট্রি স্কুলে ও ইউনিভার্সিটিতেও পড়াশোনা করেন। পড়াশোনায় বেশ প্রখর ছিলেন তিনি বরাবরেই। নিউ ইয়র্কের পড়াশোনা শেষ করে তিনি যান হার্ভাড ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুলে। সেখানে পড়াশোনা শেষ করে লেখাপড়ায় ইস্তফা টানেন তিনি।
লেখাপড়া শেষের পরপরেই চাকরীতে ঢুকে পড়েন আমেরিকার 'জোনস এ্যান্ড ইমনস ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম' এ। এখানে কাজ করেন বেশ কিছুদিন। পরবর্তীতে তিনি টাটা স্টিলে চাকরি শুরু করেন। নিজের প্রবল ইচ্ছে ও অদম্য মনোবলে, খুব অল্পসময়েই তিনি কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট এ চলে আসেন। বিভিন্ন বিষয়ে অসাধারণ সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ততদিনে নিজের দক্ষতাকে প্রমাণ করেও ফেলেছেন সবার সামনে।
১৯৯১ সাল তখন। 'টাটা গ্রুপ' এর তৎকালীন চেয়ারম্যান জে.আর.ডি টাটা অবসরে যাওয়ার সময়ে রতন টাটাকে পরবর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করেন। রতন টাটা যখন টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হয়ে বসলেন, অনেকেরই তা পছন্দ হলো না। কোম্পানির প্রশাসক যারা ছিলেন, তারা কেউই রতন টাটাকে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চাচ্ছিলেন না। এর পেছনে কারনও আছে। আগের প্রেসিডেন্ট জে.আর.ডি টাটার আমলে টাটা গ্রুপের প্রশাসকদের জন্যে অবাধ ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ ছিলো। এ কারনেই অনেক প্রশাসক এরকম আগ্রাসী হয়ে উঠেছিলেন রতন টাটার বিরুদ্ধে। রতন টাটাও খুব সুন্দরভাবেই দমন করলেন বিক্ষোভকারীদের। টাটা গ্রুপের কর্মীদের চাকরীর বয়সসীমা বেঁধে দিলেন। অধিকাংশ প্রশাসক এই এক নিয়মেই ছাঁটাই হয়ে গেলেন রাতারাতি। কারন, যারা বিক্ষোভ করছিলেন, তাদের অনেকেরই বয়স হয়ে গিয়েছে এবং তাদের অনেকেরই স্বপ্ন ছিলো টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হয়ে বসবার। তাদের বাড়া ভাতে ছাই পড়াতেই ক্ষেপে গিয়েছিলেন তারা। তাদেরকে বাতিল করে রতন টাটা মন দিলেন 'টাটা গ্রুপ' এর দিকে।
তিনি টাটা গ্রুপের অধীনস্থ কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার জন্যে কাজ শুরু করলেন। সব কোম্পানিকে গ্রুপের হেড অফিসে এসে রিপোর্ট করতে হতো নিয়মিত। টাটা গ্রুপের সব কোম্পানি থেকে যে লাভ হতো, তার একটা অংশ টাটা ব্রান্ডকে বড় করার জন্যে ব্যয় করার পদ্ধতিও শুরু হয় রতন টাটার আমলে এসে। এছাড়াও টেটলি টি, বিশ্বখ্যাত ব্রান্ড জাগুয়ার এ্যান্ড রোভার কে কিনে নেয় টাটা। দেশি-বিদেশি আরো সংস্থাকে কিনে নেয় তারা। এভাবেই রতন টাটার নেতৃত্বে ২১ বছরে টাটা গ্রুপের আয় ৪০ গুণ বাড়ে। সে সাথে লাভ বাড়ে প্রায় ৫০ গুণ!
রতন টাটাই প্রথমবার 'টাটা গ্রুপ'কে বিদেশে জনপ্রিয় করান। টাটা গ্রুপের আয়ের ৬৫% বিশ্বের ১০০টি দেশে পন্য বিক্রয়ের মাধ্যমে আসা শুরু হয় তখন থেকে। ভারতের সবচেয়ে বড় আউটসোর্সিং ফার্ম তৈরী করে টাটা। টাটার বাস ও ট্রাক দাপিয়ে বেড়ানো শুরু করে সারাবিশ্বেই। শুধু তাই না, মোবাইল ব্র্যান্ড শাওমির বেশ বড় অংশের শেয়ারের মালিকানাও টাটা গ্রুপের। ভাবলে অবাক লাগতেই পারে আপনার, মাত্র ত্রিশ হাজার রুপির পুঁজিতে শুরু করেছে যে কোম্পানি, সে কোম্পানীকে রতন টাটা ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানী বানিয়েছেন খুব অল্পসময়েই!
রতন টাটা যুক্ত আছেন ভারতের অন্যতম ই-কমার্স ওয়েবসাইট স্ন্যাপডিল এর সাথে। অনলাইনে চা বিক্রির প্লাটফর্ম ‘টিবক্স’ এও বিনিয়োগ করেছেন তিনি। ক্যাশ ব্যাক ওয়েবসাইট 'ক্যাশকারো ডট কম' এর সাথেও যুক্ত তিনি। আমেরিকান এক্সপ্রেসেও রয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত বিনিয়োগ।
রতন টাটা শুধু যে ব্যবসাই বোঝেন, তা না। শিক্ষার প্রসারের জন্যেও তিনি কম টাকা ঢালেননি। তিনি হার্ভার্ডে পড়াশোনা করেছেন, আগেই বলেছি। সেখানেই টাটা গ্রুপ একটি এক্সিকিউটিভ সেন্টার নির্মানের জন্য ৫ কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করে। হলটির নামও দেয়া হয় টাটা হল। এছাড়াও তিনি ডোনেশন দিয়েছেন কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটি ও ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতেও।
রতন টাটা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বানিজ্য ও শিল্প বিষয়ক একজন প্রধান উপদেষ্টা। ভারতের ‘ন্যাশনাল ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পিটিটিভনেস কাউন্সিল’ এর সদস্যও তিনি। স্থাপত্য শিল্পে বিশ্বের অন্যতম সম্মানজন পুরস্কার 'প্রিজকার আর্কিটেকচারাল প্রাইজ' এর একজন জুরিও তিনি। তিনি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ণ ক্যালিফোর্নিয়ার একজন ট্রাস্টিও। এই মানুষটি তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এ্যাওয়ার্ড ও সম্মানও পেয়েছেন অজস্র। ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মভূষণ পেয়েছেন৷ দুইবার। বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রীর পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকেও পেয়েছেন পুরস্কার। পেয়েছেন বিজনেস ফর পিস এবং এশিয়ান বিজনেস এ্যাওয়ার্ডও।

তবে এতসব করার ভীড়ে বিয়েটিই আর করা হলোনা মানুষটির। আমেরিকায় থাকার পরে একবার প্রেম করেছিলেন। ভারতে ফেরার তাড়াহুড়োয় সে প্রেম পূর্নতা পায়নি। এরপরে প্রেম করেছেন আরো তিনবার, কিন্তু করা হয়নি জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ; বিয়ে। এ নিয়ে হয়তো খানিকটা হতাশও তিনি। তবে কখনোই প্রকাশ করেন নি তিনি তা। রতন টাটা বরং বলেন উলটো কথাই-
ডোন্ট বি সো সিরিয়াস। এনজয় লাইফ অ্যাজ ইট কামস
ভাবলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়, যে ছেলেকে মাত্র দশ বছরেই যেতে হয়েছিলো অনাথ আশ্রমে, যেই মানুষটিকে 'চেয়ারম্যান' করানোয় ক্ষেপে গিয়েছিলো গ্রুপের অনেক সদস্য, সেই মানুষটিই 'টাটা গ্রুপ'কে দিয়েছে এরকম এক প্রভাব, প্রতিপত্তি, অবয়ব। মানুষ যে চাইলে সবই পারে, কোনোকিছুই যে অসাধ্য নেই তার, সেটারই এক জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ রতন টাটা।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন