'বড় লোকের বিটি লো' গানের পেছনের একটা গল্প শোনাই। যে গল্পটা বিষাদের কালো মেঘে ঢাকা, সেই গল্পের সঙ্গে এই গানের স্রষ্টার করুণ পরিণতিও গেঁথে আছে ওতপ্রোতভাবে।
ফেসবুক, ইউটিউব আর ইন্সটাগ্রামের নিউজফিডে এখন একটাই জিনিস চলছে, 'বড়লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল...' ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পী পায়েল দেব এবং র্যাপার বাদশা মিলে এই গানের নতুন একটা ভার্সন বের করেছেন দু'দিন আগে, ভিডিওতে বাঙালীর সাজে (পুরোটা সময় নয় অবশ্য) কোমর দুলিয়েছেন লঙ্কান সুন্দরী জ্যাকলিন ফার্নান্দেজ। সনি'র অফিসিয়াল চ্যানেলে সেটা রিলিজ পাওয়ামাত্র শুরু হয়ে গেছে আলোচনা আর সমালোচনা। একদল বিখ্যাত এই গানটাকে ধ্বংস করে দেয়ার অভিযোগ আনছে, অন্যদল প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে, টিকটকের ভিডিও বানিয়ে ফেলছে অনেকেই।
এই গান নিয়ে আজ কিছু বলব না, গান ভালো হয়েছে কি খারাপ, জ্যাকলিনের পোষাল শ্লীল ছিল নাকি অশ্লীল- এসব প্রসঙ্গে যাওয়াটা বাতুলতা, পছন্দ-অপছন্দের ভার আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি। আজ বরং আপনাদের এই গানের পেছনের একটা গল্প শোনাই। যে গল্পটা বিষাদের কালো মেঘে ঢাকা, সেই গল্পের সঙ্গে এই গানের স্রষ্টার করুণ পরিণতিও গেঁথে আছে ওতপ্রোতভাবে।
রতন কাহার- এই নামটা শোনার কথা নয় খুব বেশি মানুষের। লোকসঙ্গীত শিল্পী তিনি, গান লেখা আর সুর করা- দুটোই করেন তিনি। টাইম মেশিনে চড়ে চলুন যাওয়া যাক চার যুগ আগে, ১৯৭২ সালে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে জন্ম নেয়া রতন কাহার তখন যুবক, গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেড়ান, তাকে বায়না করে নিয়ে যায় লোকজন, দূর দূরান্ত থেকে ডাক আসে তার। এরকমই একটা গানের জলসায় যোগ দিতে যাচ্ছিলেন তিনি, পথিমধ্যে ভীষণ জলের তেষ্টা পেলো। একটা গেরস্ত বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন রতন কাহার, দেখলেন, উঠোনে বসে মেয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন এক মা। রতন পানি চাইলেন, মহিলাটি ভেতরে গেলেন পানি আনতে।
যে জায়গাটার কথা বলছি, সেখানটায় ছিল নিম্ম আয়ের লোকজনের বসবাস। চা শ্রমিকের কাজ করতো সেখানকার মানুষ। জল আনার সময়টায় বাচ্চা মেয়েটাকে ভালো করে খেয়াল করলেন রতন, এখানকার পরিবেশের সঙ্গে মেয়েটা একদম বেমানান। দেখতে ভীষণ সুন্দর, মনেই হয় না এই এলাকার কেউ, প্রথম দেখায় বরং মনে হবে, শহরের আদুরে কোন বাচ্চা বুঝি পথ ভুল করে চলে এসেছে গ্রামে!
মহিলাটি পানি নিয়ে আসার পর রতন বললেন, তোমার মেয়েটি তো ভারী সুন্দর গো! সেই মা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন- ‘এই যে এত্ত চাঁদ রূপ মেয়ের৷ হবে না কেনে? ই বড়লোকের বিটি আছে বটেক’৷ সেই বিকেলে দাওয়ায় বসে রতন শুনলেন হৃদয়ভাঙা এক গল্প। মহিলাটি এক কুমারী মা, কৈশোরে প্রেমে পড়েছিলেন কলকাতা থেকে আসা এক সাহেবের। প্রেমের ফসল হিসেবে পেটে সন্তান এসেছে, কিন্ত সাহেব বাবুটি কথা রাখেননি, প্রেমিকাকে ফেলে কেটে পড়েছেন। প্রেমিক তাকে ফেলে গেছে, তিনি তো অনাগত সন্তানকে ফেলতে পারেননি। তাই সমাজচ্যুত হয়ে, চরিত্রহীনা নারীর অপবাদ গায়ে মেখে চলে এসেছেন অন্য এলাকায়। এখানে গতর খাটিয়ে বেঁচে আছেন, মেয়েকে বড় করার চেষ্টা করছেন।
সেদিন সন্ধ্যের জলসায় গান গেয়ে তৃপ্তি পেলেন না রতন কাহার, মাথার মধ্যে গল্পটাই শুধু ঘুরছিল। ফেরার পথেই সাজিয়ে ফেললেন লাইন, গভীর রাতে বাড়ি ফিরে লিখে ফেললেন গান, জন্ম হলো ‘বড়লোকের বিটি লো/ লম্বা লম্বা চুল... এমন মাথা বিন্ধে দিব /লাল গেন্দা ফুল৷’ নিজের লেখা গানে সুরও দিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালে গানটির রেকর্ডিং করেন স্বপ্না চক্রবর্তী৷ অশোকা রেকর্ড কোম্পানির সেই গান লোকের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করে, জেতে গোল্ডেন ডিস্ক পুরস্কারও৷ কয়েকদিনের মধ্যেই গানটা চলে আসে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তৈরী হয় নতুন একটা ইতিহাস।
স্বপ্না চক্রবর্তীকে ক্যারিয়ারের প্রথম ব্রেক-থ্রু এনে দিয়েছিল এই গানটা। অশোকা রেকর্ডিংয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং সবচেয়ে বেশি শোনা গানের তালিকাতেও এখনও শীর্ষে আছে গানটা। এই গানই নতুন করে গেয়ে, ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ আর ডলার কামিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। কিন্ত রতন কাহার, রাত জেগে যিনি তৈরী করেছিলেন গানটা, লিখেছিলেন, সুর করেছিলেন, লেখা শেষ হবার আগ পর্যন্ত অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে ছটফট করেছিলেন যে মানুষটা, তার কী হয়েছিল? তিনি এখন কেমন আছেন?
রতন কাহারের বয়স এখন আশির বেশি। গানবাজনা ছেড়েছেন অনেক আগে, একসময় গানের প্রতি অনীহা চলে এসেছিল সাংসারিক কারণে৷ নিরন্তর দারিদ্রের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গান বাঁধা৷ ফসল ফলানো, দোকানদারী, অনেক কিছুই করার চেষ্টা করেছেন, কিন্ত মন বসেনি। সীমাহীন দারিদ্র্যতা কাটিয়ে উঠেছিলেন একসময়, কিন্ত খ্যাতি জোটেনি আর আগের মতো৷ বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা মানুষটা বিড়ি বেঁধে সংসার চালিয়েছেন৷
অনটন নিত্যসঙ্গী জীবনভর৷ তিন ছেলে এক মেয়ের কেউই মাধ্যমিকের গন্ডি টপকাতে পারেনি পয়সার অভাবে। মেয়েটার গানের খুব শখ ছিল, গানের গলাও ছিল ভালো। কিন্ত একটা হারমোনিয়ামও কিনে দিতে পারেননি কখনও, এতটাই সঙ্গীন অবস্থা তার। সরকারী ভাতা দিয়ে কোনমতে টিকে আছেন তিনি। মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়েন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শুনিয়ে কিছু টাকা নিয়ে আসেন, টাকা ছাড়া কেউ চাল বা সবজি দিলে সেটাও কাপড়ে মুড়িয়ে বাড়ি ফেরেন। অভাবের কাছে শিল্প, সাহিত্য, সৃজনশীলতা- এসব বড় অসহায়। পেটের ক্ষিদে তো আর শিল্প বোঝে না!
ইউটিউবে ভাইরাল হওয়া 'গেন্ধা ফুল' শিরোনামের গানটা রতন কাহারের তৈরী করা কথা আর সুরে গাওয়া হলেও, তার কাছ থেকে কোন অনুমতিই নেয়া হয়নি। মোবাইল সুবিধা না থাকায় ও ভারতজুড়ে লকডাউনের মধ্যে গানটি এখনও তিনি দেখতে পারেননি তিনি। সনি মিউজিক ইন্ডিয়ার ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড হওয়া এই গানের কোথাও রতন কাহারের নাম উল্লেখ করা হয়নি, সনি ইন্ডিয়ার কাছে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলেও তারা কোন জবাব দেয়নি। দুই হাজার গানের স্রষ্টা রতন কাহার ভিক্ষা করে বেঁচে থাকেন, আর তার লেখা, সুর করা গান গেয়ে, আবেদনময়ী মিউজিক ভিডিও বানিয়ে লক্ষ-কোটি টাকা আয় করে নেয় সুবিধাভোগীর দল। এভাবেই শিল্প আর শিল্পী হেরে যায় ব্যাবসার কাছে, জীবনযুদ্ধে হেরে যান রতন কাহাররা...