সেদিনই ধর্ষণ বন্ধ হবে, যেদিন ধর্ষণে দায়ে অভিযুক্ত পুরুষকে তার মা, স্ত্রী বা মেয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে আসবেন এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধর্ষিতাকে বাধা না দেবেন, টাকা অফার না করবেন, আপোষ করার প্রস্তাব না দেবেন...
আচ্ছা ভাবুন তো, সংবাদপত্র , টিভি চ্যানেল আর সোশ্যাল মিডিয়াতে নিউজগুলো যদি এমন হতো, 'নোয়াখালীর এক গ্রামে তরুণীকে ধর্ষন করার চেষ্টা করতে গিয়ে আহত দুই তরুণ' অথবা 'ধর্ষনের চেষ্টা করাতে গৃ্হশিক্ষকের লিঙ্গ কর্তন করলো এক কিশোরী!'
কী, চমকে গেলেন? আমাদের সমস্যা টা কোথায় জানেন? এই কথাটা শোনার সাথে সাথে আমাদের মেয়েদেরই মনে হবে, 'এটা আবার সম্ভব নাকি!' ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা শারিরিকভাবে দূর্বল, এটা আমাদের জন্ম থেকেই মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আসলে, আমাদের দূর্বলতা শরীরে নয়, মনে ও মগজে!
ধর্ষণের জন্য নারীর চাল চলন পোষাক, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব, বিজ্ঞাপন, পর্ণোগ্রাফি সবকিছুকে ব্লেম দেয়া হয়ে গেছে! এবার একটা সহজ ক্যালকুলেশন এ আসি। যুগের পর যুগ যেগুলো চলে আসছে, সেগুলো এক দিন কেনো, এক যুগেও পরিবর্তন করা সম্ভব না। আমরা যুগের পর যুগ নারীকে ভোগ্যপণ্যের সিম্বোলিক হিসেবে ব্যাবহার করে আসছি। হিউমার মানেই এখন থার্ড ক্লাশ, নোংরা জোকস! সবই ঠিক আছে। কিন্তু, এগুলো মিনিমাইজ করে কি আসলে পরিস্থিতি পার্মানেন্টলি কন্ট্রোলে আনা সম্ভব?? বা এই যে বাড়াবাড়ি এটা দমানো সম্ভব?
আমরা সবাই মিলে বারবার ধর্ষণের জন্য দায়ী সমস্যা গুলোকে এড্রেস করে যাচ্ছি, কয়েকটা গ্রুপ হয়ে গেছে, এ ওকে ব্লেম দিয়ে যাচ্ছে। হুজুররা ব্লেম দিচ্ছে নারীর পোষাককে, আধুনিক নারীবাদী রা ব্লেম দিচ্ছে পুরুষের মানসিকতাকে। ঘরে বসে থাকা আমরা সাধারণ মানুষরা দোষ দিচ্ছি টেকনোলজি, সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি কমার্শিয়াল, সিনেমা আরো না জানি কত কি!
আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কথা বলছেন? আমাদের বাংলা ছায়াছবি গুলোর কথা মনে আছে? 'ছেড়ে দে শয়তান', 'আজ তোর ইজ্জত আমি লুটে নেবো', এ ধরণের ডায়লগ কোনো ইংরেজী ছবিতে আছে বলে আমার মনে পরেনা। আর যত রগরগে রেপ সিন বাংলা আর হিন্দি সিনেমায় থাকে তা ইংরেজী সিনেমায় নাই।
মন মানসিকতা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞাপন, সিনেমা এসবের পরিবর্তন খুব লেংদি প্রসেস। পর্ণ ইন্ডাষ্ট্রি বন্ধ করে দেয়া চাইলেই সম্ভব না, হাজার কোটি টাকার ব্যাবসা! আমি আপনি চাইলেই আজ থেকে ক্যাটরিনা কাইফ বা সানি লিওন বোরখা পরে ক্যামেরার সামনে আসবে না, কনডমের বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে না, তেল সাবানের এড ও পরিবর্তন হবে না। আর আসলে সেটা কতটা যৌক্তিক ভাবুন তো? সিনেমা বা বিজ্ঞাপনে আপনার মা বোনদের চেহারা দেখলেও কি আপনি উত্তেজনা অনুভব করবেন? রাস্তায় তাদের দেখলে কি শীস বাজান আপনি? তাহলে অন্য একটা মেয়ের বেলায় কেন?
এতসব মতামত আর আলোচনার ভীড়ে, আমরা বছরের পর ধরে যে আমাদের জীবনের মধ্যেই একটা ভুল প্র্যাক্টিস, যেটা কিনা নারীর আজকের অবস্থানের জন্য দায়ী, সেটা আমাদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে!
বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আপনার মেয়ে সন্তানটিকে আপনি গায়ের কাপড় ঠিক করতে বলেন বারবার, ছেলেটিকে কয়দিন বলেছেন, 'কোনো মেয়ের বুকের দিকে তাকাবিনা।' জন্ম থেকেই মেয়েদের মন ও মগজে ঢুকিয়ে দেইয়া হয় যে 'তোমরা ছেলেদের থেকে দুর্বল', এটা ছেলেদের ও কলিজা বড় করে দেয়, মেয়েদের ও দুর্বল করে দেয়। আসলে 'আই এম সুপিরিয়র দেন হার' এই থিংকিং এর সাথে ধর্ষণের পুরো বিষয়গুলো জড়িয়ে আছে। সেটা হতে পারে শারিরিকভাবে, সামাজিক অবস্থানে বা আরো অনেক কিছু হতে পারে। ধর্ষণের জন্য শিশু বা বৃদ্ধা বেছে নেয়ার কারণ কি জানেন? তারা শারীরিক ভাবে দূর্বল এবং বাধা প্রদানে অক্ষম।
আর ডেথ পেনাল্টি? ধর্ষণের শাস্তি ডেথ পেনাল্টি দেয়া ছাড়া এখন কোনো উপায় না থাকলেও, এর ফলে কারো মানসিকতা চেঞ্জ হবে, এটা ভাবা যাচ্ছে না, আমেরিকার ইতিহাস অন্তত তা বলে না। আমেরিকায় রেপ এর শাস্তি প্রাইম পানিশমেন্ট করে দেয়ার পরে রেপ আরো বেড়ে গিয়েছিলো। জনগনের চাপে পরে সরকারের এ সিদ্ধান্ত কতটুকু ফলপ্রসু হবে বা আদৌ কার্যকর হবে কিনা, সেটা একটা ভাবার বিষয়, ফাঁসির আদেশ হওয়া আসামীদের এদেশে রাস্তার ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। বরং অনেক ফলস রেপ কেস ফাইল হবে। অন্যায় করলে শাস্তি হয়, তবু কি কোনো অন্যায় থেমে আছে? আপনি আপনার ছেলের, স্বামীর বা বাবার ফাঁসির আদেশ হয়েছে শুনলে কি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন না? আপিল করবেন না? এটা থেকেই বেরিয়ে আসুন। আর কিছু না পারেন, অন্যায়ের বিচার টা হতে দিন।
কিন্তু আমরা ধর্ষন নিয়ে যত প্রতিবাদের কথা বলে যাচ্ছি, ছি ছি করছি, নিজের ঘরের পুরুষটির বেলায় কি ততটা সচেতন বা কঠোর হতে পারছি? পেরেছি কখনো? পারা উচিত। আসলেই পারা উচিত। এটাকে বলে পরিবর্তন। সেদিন ধর্ষণ বন্ধ হবে যেদিন ধর্ষণে দায়ে একজন পুরুষকে তার মা, বৌ বা মেয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে আসবেন এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধর্ষিতাকে বাধা না দিবেন, টাকা অফার না করবেন, আপোষ করার প্রস্তাব না দিবেন। সে দিন মনে হয় অনেক দূরে!
তাহলে এখন সমাধান কী? শুধুমাত্র প্রতিবাদই নয় প্রতিরোধ ও জরুরি। এখন কথা হলো কে করবে প্রতিবাদ? যারা ধর্ষণের প্রতিবাদে মিটিং মিছিল করছে বা আন্দোলন করছেন তারা ও একসময় ক্লান্ত হয়ে যাবেন, তারপর? আপনার কি সত্যিই মনেহয় এতে কোনো ধর্ষকের ধর্ষণ প্রবৃত্তি কমবে? আর সব মেয়েদের সাথে সাথে গার্ডিয়ান নিয়ে ঘুরতে হবে, এটাও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। প্রতিবাদ করতে হবে একজন মেয়েকে। আর এখানেই একটা পরিবার এর কন্ট্রিবিউশন, বাবা মায়ের অনেক বড় একটা ভূমিকা থেকে যায়।
ঘরে বাইরে যে কোনো ধরণের হ্যারাসমেন্ট এর স্বীকার হওয়া মেয়েটাকে দয়া করে চুপ করে থাকতে বলবেন না। লজ্জায় বা ভয়ে আপনি আপনার মেয়েকে ধর্ষণের পথে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন যুগের পর যুগ ধরে। আপনার ছেলেটাকে শিক্ষা দিন, মেয়েটিকে বাধা দেয়ার বদলে। রাতে আসায় ফেরার সময় বেঁধে দিন। ছেলেরা চাইলেই যা খুশি করতে পারে, বা ছেলেরা তো কতো কিছুই করবে, এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন। একটা ভদ্র সভ্য ছেলে কি একদিনে ধর্ষক হয়ে ওঠে? কার সাথে মিশছে, কী করে ঘরে ফিরছে, দেখুন, খোঁজ নিন, বাধা দিন, শাসন করুন। আপনি আগে নিজের মেয়েটাকে মানুষ ভাবতে শিখুন, তারপর না বাইরের লোকে শিখবে।
কোথাও একটা জায়গায় গিয়ে ধর্ষন বলি আর ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সই বলি, এক জায়গায় এসে মিলবে। একমাত্র কারণ আমাদের চুপ থাকা। জোরে কথা বলতে শিখুন, চিৎকার করুন, চড়ের প্রতিবাদে চড় মারুন, তাহলে পরিবর্তন আসবে, ঘরে ও বাইরে। যে মেয়ে দিনের পর দিন স্বামীর মার খেয়ে প্রতিবাদ করতে পারে না, সে কিভাবে বাইরে পাঁচটা ছেলের সামনে প্রতিবাদ করবে? সেই মেন্টালিটিই তো তৈরী হয়নি! এখনো আমরা বলছি 'কন্যা সন্তানের সিকিউরিটি না দিতে পারলে জন্মের সাথেই হত্যা করা হোক' বা 'কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েও ভয়ে আছি' বা 'মেয়ে হয়ে জন্মে ভুল করেছি'। এ হলো আমাদের আক্ষেপ প্রকাশের ধরণ! কেন? আমরা নিজেরাই তো নিজেদের ছোট করে দেখি!
কোনো মেয়ের সম্মানহানি করতে হলে তাকে রেপ করার কথাই প্রথমে মাথায় আসে। এবার একটু গভীরভাবে ভাবুন।মেয়েদের সম্মান কি তার যোনীতে রাখা থাকে? তাহলে ছেলেদেরটা কই থাকে? নাকি ছেলেদের সম্মান বা ইজ্জত বলে কিছু নাই? কয়টা ছেলেকে বাবা মা এ শিক্ষাটা দেয়? ডিস্ক্রিমিনেশন এর সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো থেকে এসব অপকর্মের শুরু হয়। একটা মেয়ের বস্ত্রহরণ মেয়েটাকে যতটা ছোট করে ছেলেটাকে ঠিক ততটাই করে, তাই 'ইজ্জত সংবরণ' এর শিক্ষাটা ছেলেকে দিন। মাথা নিচু করে আপনার মেয়েকে হাটতে বলবেন না, ছেলেকে রাস্তায় চোখ নামিয়ে থাটতে বলুন।
রাত ৮ টা বাজলে মেয়েরা ভয়ে থাকে, আজ বাসায় ফিরলে মা কী বলবে। আপনার ছেলেটা অন্যায় করে বাসায় ফিরলে তার মনে ভয় থাকেনা, সে ব্যর্থতা কার? সরকারের, মেয়েদের পোষাকের, বিজ্ঞাপনের না আপনার?? ভেবে বলুন। এডাল্ট সিন দেখার সময় চ্যানেল না বদলে ছেলে মেয়েকে প্রপার সেক্স এডুকেশন আর ধর্মের শিক্ষা দিন। দেশ, সরকার, মোবাইল, টিভি কে দোষ দেবেন না।
প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কীভাবে করব?
*জিরো টলারেন্স টু ইভটিজিং অর এনি কাইন্ড অফ হ্যারাসমেন্ট! ছোট-বড় সব ঘটনাতেই প্রতিবাদ করুন। ধর্ষন এমনিতেই কমে যাবে। বিশ্বাস করুন, নারী নির্যাতন ও কমে যাবে।
*ব্যাগ এ আয়না-চিরুনি, ফেস পাউডার এর সাথে পর্যাপ্ত প্রটেকশন নেয়ার মত জিনিশ রাখুন। পিপার স্প্রে, বড় সেফটি পিন, কাঁচি ইত্যাদি। প্রত্যেকটা ছেলে যেন জানে মেয়েরা এগুলি নিয়েই বের হয়। যে মেয়ের দিকে তাকাচ্ছি, প্রয়োজনে সে এক ঘুষিতে আমার নাক ফাটিয়ে দিতে পারে। ছেলেরা যেন জানে,'আমি রেপ এটেম্পট করতে পারি, এই মেয়েটা জানে, তার সাথে যথেষ্ট প্রটেকশন আছে'। ইচ্ছা হলেও যেন ভয়ে সেটাকে দমন করে।
*সাথে মাথা ব্যাথার কড়া ক্রিম বা বাম রাখুন, চোখের মধ্যে অথবা জায়গা মত ডলে দেয়ার জন্য।
*আত্নরক্ষার কৌশল জানা মাস্ট, না জানলে আর দেরী নয়, এখনি শুরু করুন।
*আর কিছু না পারেন, কামড়ে দেন, যেখানে সেখানে, বা জায়গা মতো। মানে মনে সাহস টা দরকার আরকি। ওইটাই তো নাই, নাহলে হাত পা বাধা থাকলেও দুই চারটা কামড় দেয়া তো কোনো ব্যাপার না!
*চোখে মুখে ভয় ভয় ভাব, চোখ নামিয়ে চলা বা কোনো প্রকার দুর্বলতা প্রদর্শন করবেন না।
*আর বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আমাদের মায়েরা, মেয়েদের ভয় না দেখিয়ে মনোবল দিন, মনটা তো ঘর থেকেই ছোট করে দেন আপনারা। এই হবে, সেই হবে, এটা না বলে বলুন, অনেক কিছু হতে পারে, সাহস হারাস না। ঘরের মানুষদের কারনে মেয়েদের মনে সাহসটাই থাকে না।
*এন্টি ইভটিজিং এন্ড এন্টি রেপিং নিয়ে সেমিনার হতে পারে। ছেলেদের ট্রেনিং দেয়া যেতে পারে কিভাবে নিজের যৌন লালসা কন্ট্রোল করা যায় এবং মেয়েদের সাথে রাস্তায় কীরকম আচরণ করা উচিত। আর মেয়েদের ট্রেনিং দেয়া যেতে পারে কীভাবে ইভটিজিং আর রেপ এটেম্পট কে প্রতিহত করতে হবে। পাড়া-মহল্লা ব্যাসিস এ জনসমাবেশ করে যেমন ওয়াজ মাহফিল হয় তেমনভাবে। যদি কিছু লোক ও ভালো হয়!
*ঘরের পুরুষটিকে বুঝিয়ে দিন কোনো ধরণের অন্যায় আমি সহ্য করবোনা, পক্ষ ও নিবনা।
বদলান আপনি নিজে, তাহলে বদলাবে দেশ।
ছবি কৃতজ্ঞতা- ঢাকা ট্রিবিউন।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন