ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা: সাইকোলজি কী বলে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এমন একটা দিন নেই যেদিন সোশ্যাল মিডিয়া বা পত্রিকা খুললে একটা ধর্ষণের খবর পাওয়া যায় না। ক্রমবর্ধমান হারের এই অপরাধ সম্পর্কে অনেকের অনেক মত- কেউ বলেন সামাজিক অবক্ষয়, কেউ বলেন ক্ষমতার অপব্যবহার। কিন্তু নিকৃষ্টতম এই আচরণের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী? একটু বোঝার চেষ্টা করি চলুন।
“I just want to sleep. A coma would be nice. Or amnesia. Anything, just to get rid of this, these thoughts, whispers in my mind. Did he rape my head, too? "
Laurie Halse Anderson (2011). “Speak”, p.165, Macmillan.
নারীর প্রতি সহিংসতা বিশ্ব ইতিহাসে নতুন কিছু নয়৷ উনিশ শতকের সতীদাহ প্রথা থেকে শুরু করে একবিংশ সমাজের ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, যুগে যুগে এভাবেই সহিংসতার রূপ বদলেছে। তবে সকল যুগের সকল সহিংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বর্তমান যুগের ধর্ষণ। হ্যাঁ, ধর্ষণ শব্দটি নতুন কিছু নয়, তারপরও ‘বর্তমান যুগের ধর্ষণ’ বলার কারণ এখন প্রতিনিয়ত যেসকল ধর্ষণের খবর পাচ্ছি, এতটা বিকৃত, এতটা পাশবিক যৌনাচারের খবর কি আগে কখনো শুনেছেন?
আগে কয়টা ধর্ষণের খবর এমন শুনতেন যেখানে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়? দুলাভাই তার নিজের আপন ভাইদের নিয়ে শালীকে গণধর্ষণ করে? ৭২ বছরের বৃদ্ধা গোসল করতে গিয়ে ধর্ষিত হয়? সন্তানের বয়সী ছেলেরা মায়ের বয়সী নারীকে সম্পূর্ন উলঙ্গ করে, উল্লাস করে যৌনাঙ্গে আঘাত করতে করতে ধর্ষণ করে?
এমন একটা দিন নেই যেদিন সোশ্যাল মিডিয়া বা পত্রিকা খুললে একটা ধর্ষণের খবর পাওয়া যায় না। ক্রমবর্ধমান হারের এই অপরাধ সম্পর্কে অনেকের অনেক মত- কেউ বলেন সামাজিক অবক্ষয়, কেউ বলেন ক্ষমতার অপব্যবহার।
কিন্তু নিকৃষ্টতম এই আচরণের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী? একটু বোঝার চেষ্টা করি চলুন।
নারীর প্রতি সহিংসতার সাইকোলজি বুঝতে হলে আমাদেরকে প্রথমে বুঝতে হবে ‘সহিংসতা’ বা সাইকোলজিতে আমরা যেটা পড়ে থাকি, Aggression, তার পেছনের তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা। সাইকো এনালাইসিসের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড একটা সময় পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন মানবচরিত্রে জন্মগতভাবে একটি গুণ (Human drive) বিদ্যমান- Eros, যার অর্থ ভালবাসা। এই Eros আছে বলেই মানুষে মানুষে প্রেম হয়, তারা একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, একসাথে থাকে, বংশবৃদ্ধি করে। মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে যার ভূমিকা অপরিহার্য।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে ফ্রয়েডের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে। তিনি তখন দ্বিতীয় আরেকটি drive এর অবতারনা করেন, যার নাম দেন- Thanatos. Thanatos শব্দের অর্থ self destruction বা আত্মধ্বংসী মনোভাব। ফ্রয়েডের মতে, প্রতিটি মানুষের মাঝে জন্মগতভাবেই এই দুইটি drive পাশাপাশি বিদ্যমান। মানবজাতি একই সাথে ভীষণ রকমের সৃষ্টিশীল এবং বিধ্বংসী। তার মতে, সময়ে-অসময়ে মানুষের এই বিধ্বংসী মনোভাব প্রকাশ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে ঠিক যেমনিভাবে প্রয়োজন পড়ে তার ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং যৌন চাহিদার প্রকাশের।
পরবর্তীতে অনেক সাইকোলজিস্ট এবং সোশিওলজিস্ট Aggression নিয়ে কিছু থিওরী দেন। উল্লেখযোগ্য থিওরীগুলো নিয়ে আমি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি-
Instinct Theory
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, জন্মগতভাবে মানুষের মাঝে যে agggression থাকে, সেটাই instinct theoryর আলোচ্য বিষয়। সে হিসেবে ফ্রয়েডের থিওরীটি এর অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে, ইথিওলজিস্ট কোনার্ড লরেঞ্জ তার বই On Aggression-এও instinct theory আলোচনা করেন৷
Frustration-Aggression Hypothesis
ফ্রয়েডীয় instinct theory দিয়ে প্রভাবিত সাইকোলজিস্ট জন ডলার্ড এবং তার কয়েকজন কলিগের সমন্বয়ে প্রকাশিত বই Frustration and Aggression এ সর্বপ্রথম এই থিওরীটির প্রকাশ হয়৷ এই থিওরী অনুযায়ী, জন্মগতভাবে মানুষ যে aggression নিয়ে আসে, সেই aggression এর প্রকাশ ঘটে কিছু নির্দিষ্ট পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে। তেমনই এক পরিস্থিতি হল frustration বা হতাশা। জন ডলার্ডের মতে, ফ্রাস্টেশন সবসময়ই এগ্রেশনে রূপ নেয়, মতান্তরে এগ্রেশন হল ফ্রাস্টেশনের একটি ফলাফল।
এই হতাশা বা ফ্রাস্টেশনের উৎস হতে পারে জীবনের মৌলিক চাহিদার অভাব কিংবা অন্য যেকোন কিছু। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টি হচ্ছে, ফ্রাস্টেশন থেকে উদ্ভূত এই এগ্রেশন সবসময় ফ্রাস্টেশনের মূল উৎসের প্রতি না হয়ে হতে পারে অন্য কোন বস্তুর প্রতি। একে বলে, displaced aggression. এবং সমাজে এই displaced aggressionই বরং অহরহ দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ- অন্যান্য দিনের মত সকালে অফিসে যাওয়ার পর আপনি জানতে পারলেন আগামী মাস থেকে আপনার চাকরিটা আর থাকছে না। আকস্মিক এই চাকরিচ্যুতির ঘোষনা আপনাকে ভয়াবহ রকমের ফ্রাস্টেশনে ফেলে দিল। মনে মনে তৈরি হল বসের প্রতি তীব্র ক্ষোভ৷ কিন্তু আপনার পক্ষে তো আর সম্ভব না বসের প্রতি ক্ষোভ দেখানো। তাই ক্ষোভটা displace করলেন বাসায় ফিরে আপনার স্ত্রী বা সন্তানের উপর৷ অর্থাৎ, ফ্রাস্টেশন থেকে সৃষ্ট এগ্রেশনটি আপনি দেখালেন আপনার জন্য মোটামুটিভাবে নিরাপদ এবং আপনার চেয়ে কম ক্ষমতার অধিকারী একটি জায়গায়৷
আরেকটি উদাহরণ দেই।
প্রায়ই আমরা শুনি বা অনেকসময় নাটক সিনেমায়ও দেখি যে গ্রামের প্রতাপশালী চেয়ারম্যানের কুলাংগার ছেলে অমুক বাড়ীর দরিদ্র বাবার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এই ছেলে তার বাবার কাছে উঠতে বসতে অপমানিত হয় এবং এইরকম একটি ছেলে কখনো তার থেকে মোটামুটি ক্ষমতাবান কোন পরিবারের মেয়েকে অত্যাচার করার সাহস দেখাবে না৷ তাহলে আপনারাই এখন ভাবুন, ফ্রাস্টেশন-এগ্রেশন থিওরী অনুযায়ী এই ঘটনাটাকে ব্যাখ্যা দেয়া যায় কিনা। শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতাকেও আমি এটার অন্তর্ভুক্ত করব।
Arousal and Aggression
ডলফ জিলম্যানের এ থিওরীটি বেশ ইন্টারেস্টিং। এর মূল বক্তব্য হলো- একটি উৎস থেকে সৃষ্ট উদ্দীপনা অন্য একটি বস্তুতে প্রবাহিত করা (arousal from one source is channeled into and energizes some other response)।
উদাহরণস্বরূপ- রাস্তাঘাটে আসতে যেতে দেখবেন চলন্ত অবস্থায় এক রিকশার সাথে আরেক রিকশার সামান্য একটু ধাক্কা লাগতেই রিকশাওয়ালা দুজনের মধ্যে গালাগালের ধুম পড়ে যায়। পারলে একজন আরেকজনকে মেরেই ফেলেন এমন অবস্থা আরকি। অথচ ঘটনা খুবই সামান্য। এর কারণ হল, অলরেডি শারীরিক পরিশ্রমের দরুণ উনারা physically aroused/ excited হয়ে আছেন, এমতাবস্থায় “ধাক্কা লাগা” বিষয়টা তাদেরকে একটা সুযোগ এনে দিল নিজের physical arousal কে আরেকজনের উপর channelize করার।
অন্যভাবে আরেকটি উদাহরণ দেই।
ধরুন, আপনি রেস্টুরেন্টে বসে আপনার প্রিয় মানুষের জন্য অপেক্ষা করছেন। এই অপেক্ষাটা আপনার জন্য বিরক্তিকর না, আনন্দের। অর্থাৎ আপনি অলরেডি খুব রোমান্টিক মুডে আছেন। এমতাবস্থায়, রেস্টুরেন্টে বাজতে থাকা একটি রোমান্টিক গান আপনার মাঝে এত বেশি ভাল লাগা তৈরী করবে যেটা হয়ত এর আগে হাজারবার শুনেও আপনার মধ্যে তৈরী হয়নি। এখানে আপনার রোমান্টিক মুডটা channelized হয়ে গেল গানের প্রতি। ধর্ষণের সাথেও এগ্রেশনের এই থিওরীকে খুব চমৎকারভাবে রিলেট করা যায়। যেমন ধরুন যে ছেলেটি ইতিমধ্যে মাদক সেবন করে অথবা পর্নোগ্রাফিক মুভি দেখে physically aroused হয়ে আছে, সেই ছেলেটি সুযোগ পাওয়া মাত্রই তার এই physical arousal টা channelized করে দিবে একজন নারীর উপর।
সেক্ষেত্রে সেই নারীর সাথে তার পূর্বপরিচয়, ভাললাগা, নারীর বয়স, নারীর কাপড় (যেহেতু সমাজের একটা বড় অংশ ধর্ষণ প্রসঙ্গ আসতেই নারীর কাপড় টেনে আনেন) এসবের কিছুরই প্রয়োজন নেই।
Social learning and Aggression
এগ্রেশনের সবগুলো হাইপোথিসিসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রহনযোগ্য হাইপোথিসিস এটি। Learning সাইকোলজির একেবারেই বেসিক একটা বিষয়৷ একটা শিশু বড় হয়ে কেমন মানুষ হবে, তার ব্যক্তিত্ব কেমন হবে, আচরণ কেমন হবে সেই সবকিছু যতটা তার জেনেটিক মেকাপের উপর নির্ভর করে, ততটাই নির্ভর করে লার্নিং এর উপর৷ social learning থিওরী অনুযায়ী, এগ্রেসিভ আচরণ গড়ে ওঠে রিইনফোর্সমেন্ট এবং এগ্রেসিভ মডেলদের অনুকরনের মাধ্যমে।
এখানে আলোচ্য বিষয় তাহলে দুটি-
1. Learning through reinforcement
রিইনফোর্সমেন্ট মানে সোজা বাংলায় যেই জিনিস আপনার একটা আচরণকে বৃদ্ধি করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু কিছু বাচ্চা আপনি দেখবেন যেকোন কিছু চাইতে হলে চিৎকার চেঁচামেচি করে চায়। এর কারণ হল সে স্বাভাবিকভাবে হয়ত কখনো একটা জিনিস চেয়েছে, পায় নাই। কিন্তু যখন সে চিৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি করেছে, তখন বাবা বা মা তাড়াতাড়ি তাকে থামানোর জন্য তাকে ওই জিনিসটা কিনে দিয়েছে। এখানে তার অভিভাবক যে তাকে ওই জিনিসটা কিনে দিল এটা হল reinforcement, বাচ্চা যে চিৎকার করছিল এটা বাচ্চার আচরণ এবং বাচ্চার learningটা হল এরপর থেকে কিছু পেতে হলে অবশ্যই চিৎকার করতে হবে৷
এবার আসি ধর্ষণের ক্ষেত্রে learning through reinforcement ব্যাপারটি কীভাবে কাজ করে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেই বলি। প্রথমত, আমাদের দেশে বেশিরভাগ মেয়েরা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের কথা প্রকাশ করে না, ধর্ষণও না। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের কেসটার কথাই ধরুন। ধর্ষণের ৩২ দিন পর ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। তাও প্রকাশিত হয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, কয়েকজনের লেখালেখির মাধ্যমে।
তার আগ পর্যন্ত কিন্তু ধর্ষিতা বা ধর্ষিতার পরিবার কোন মামলা করেনি। এখানে ধর্ষিতাকে আমি দোষ দিব না। আমাদের সমাজব্যবস্থাটাই এমন। এখানে মেয়েরা ধর্ষিতা হলে তাদের সম্মানহানি (!) হয়, মামলা করতে গেলে থাকে ক্ষমতাশীলদের হাতে প্রাণ হারানোর ভয়৷ সে যাই হোক, আমি আমার সাইকোলজিতে ফিরে আসি। এই যে চুপ থাকা, এই ব্যাপারটা ধর্ষকদের ক্ষেত্রে reinforcement হিসেবে কাজ করে৷
তাদের learning হয় যে এরকম কাজ বারবার করাই যায়, কেউ তো আর মুখ খুলবে না। দ্বিতীয়ত, বিচারহীনতা বা বিচার হলেও সুষ্ঠু বিচার না হওয়া এটাও ধর্ষকদের জন্য reinforcement. এতেও তাদের বারেবারে ধর্ষন করার learning হচ্ছে।
2. Learning through the imitation of aggressive models
এটি আরেকটি ভয়ানক এবং আমি মনে করে ধর্ষণের প্রথমসারির কারণগুলোর একটা৷ আমাদের দেশে ছোটবেলা থেকে একটা ছেলে এটা দেখে দেখে বড় হয় যে তার বাবা তার মাকে উঠতে বসতে গায়ে হাত তোলে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পাড়ার সো কল্ড বড়ভাই পাড়ার মেয়েদের দেখলেই শিষ দেয়, ওড়না ধরে টান দেয়, অশালীন অংগভংগি করে। এখানে যে ফাদার ফিগারের কথা বললাম তিনি এবং এলাকার সেই বড়ভাই হচ্ছেন মূলত aggressive models.
যাদেরকে ছোটবেলা থেকেই দেখে দেখে ছেলেটি শিখে নেয় সমাজে মেয়েদের সাথে যা ইচ্ছা করা যায়, চাইলেই তার বুকে হাত দেয়া যায় কিংবা তার সাথে যৌনক্রিয়া সম্পাদন করা যায়৷ এতে কোন অসুবিধা নেই। এটাই নিয়ম।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ aggressive model হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। পর্নোগ্রাফিতে যে রোলগুলো দেখানো হয়, সেখানে কী হয়? মেইল রোলগুলো থাকে প্রচন্ড রকমের ডমিনেটিং এবং ভায়োলেন্ট যারা তাদের ফিমেল পার্টনারের সাথে ইচ্ছামত বিকৃত যৌনাচার চালিয়ে যায়, আর ফিমেল পার্টনারটিও যেন সেসব বিকৃতি বেশ উপভোগ করছে এমনটিই দেখানো হয়৷ বয়ঃসন্ধিকাল থেকে একজন ছেলে যখন তার জীবনের প্রথম সেক্স এডুকেশনই পায় এইরধরনের পর্ন ফিল্ম দেখে, তখন তার এটাই লার্নিং হয় যে এইখানে এই মডেলরা যা করছে, এটাই স্বাভাবিক। যৌনসংগম ব্যাপারটা এমনই। মেয়েদের সাথে এটাই করতে হয়। এমনকি একটা শিশুর সাথেও এগুলো করা যায়৷ এতে মেয়েদের কোন কষ্ট হয় না বরং তারাও ব্যাপারটা এঞ্জয় করে (যেটা একদমই সঠিক না। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেক্স ব্যাপারটা যতটা না ফিজিকাল, তার থেকে অনেক অনেক বেশি মেন্টাল)৷
আমি যে শুরুতে বলেছিলাম 'বর্তমান যুগের ধর্ষণ' যেখানে বিকৃত যৌনাচারের হার অনেকগুন বেশি, তার পেছনে পর্নোগ্রাফি বা চটি বইয়ের বিকৃত যৌনাচারই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী বলে আমি মনে করি।
এতক্ষন তো বললাম শুধু Aggression hypoyhesis এর কথা৷ কিন্তু শুধুমাত্র Aggression দিয়েই ধর্ষণকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। যেকোন অপরাধের পিছনে একজন মানুষের পার্সোনালিটির বিরাট গুরুত্ব বহন করে। আর পার্সোনালিটি বা ব্যক্তিত্বের কথা বলতে গেলেই চলে আসে mental structure নিয়ে ফ্রয়েডের সেই চমৎকার কনফিগারেশনের কথা- Id, Ego, Superego
Id (ইড)
Id হচ্ছে সোজা বাংলায় মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। যাকে বলা হয় ‘unconscious drive for pleasure and destruction’. যেখানে কোন সামাজিক মূল্যবোধ, বিবেকবোধ এসবের বালাই নেই। যেমন আপনার প্রচন্ড খিদা পেয়েছে, এবং আপনার কাছে কোন খাবার নেই, খাবার কেনার মত টাকাও নেই। কিন্তু আপনি দেখলেন একটু সামনেই একটা খাবারের দোকান। আপনি সেই দোকানে ঢুকলেন, দোকানীকে কিছু না বলেই একটা খাবারের প্যাকেট তুলে নিয়ে হাঁটা দিলেন। কাজটা ঠিক না বেঠিক সেসব চিন্তা আপনার মাথায় আসবে না। আপনার খিদা পেয়েছে, সেটা নিবারন করাই এখন আপনার কাছে মূখ্য।
Superego (সুপার ইগো)
Superego হচ্ছে আমাদের নীতিবোধ বা বিবেকবোধ। এই বিবেকবোধ সামাজিক অথবা ধর্মীয় মূল্যবোধ যেকোনটি থেকেই আসতে পারে৷ Superego আমাদের শিখায় খিদা পেলেই একটা দোকানে ঢুকে নিজের ইচ্ছামত খাবার তুলে নিয়ে চলে যাওয়া যায়না। এটা নীতিগতভাবে সঠিক নয়।
Ego (ইগো)
Ego হচ্ছে Id এবং Superego এ দুয়ের মধ্যে ব্যালেন্স৷ Ego আমাদের বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়৷ বস্তুত, যে মানুষের Ego যত ভাল সে সামাজিকভাবে ততবেশী খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। Ego আমাদের শেখায় খিদা পেলে যদি আমার খাবার কেনার সামর্থ্য না থাকে সেক্ষেত্রে আমরা কী কী করতে পারি। আমরা কোন বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে খাবার কিনতে পারি, কিংবা দোকানী পরিচিত হলে অনুরোধ করতে পারি আমাকে এক প্যাকেট খাবার আপাতত বাকিতে দিতে, আমি পরে পরিশোধ করে দিব।
ধর্ষকদের মাঝে এই ego বা superego কোনটিই কাজ করে না। তাদের সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় তাদের Id. একজন নারীর শারিরীক ও মানসিক যন্ত্রনার চেয়ে তার নিজের সেক্সুয়াল প্লেজার পাওয়ার বিষয়টাই তার কাছে মূখ্য। সবশেষ আরেকটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে একটু বলি। Human sexual response cycle এর অনেকগুলো সেক্সুয়াল মডেলের মধ্যে একটি হল জন ব্যানক্রফটের Dual control model. মডেলের বিস্তারিত আলোচনায় আমি যাব না।
এখানে যেটি মূলকথা সেটি হচ্ছে- সেক্সুয়াল এক্টিভিটি আমাদের Nervous system এর excitatory এবং inhibitory দুই মেকানিজমের ব্যালেন্সের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়৷ এখন যাদের ক্ষেত্রে ‘Low excitation’ এবং ‘High inhibition’ থাকে তাদের ক্ষেত্রে sexual dysfunction হওয়ার একটি সম্ভাবনা থাকে আর অন্যদিকে যাদের ‘High excitation’ এবং ‘low inhibition’ থাকে তাদের ক্ষেত্রে “Risky sexual behaviour” (উদাহরণস্বরূপ, ধর্ষণ) হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর৷
পরিশেষে একটা কথা না বললেই না। ধর্ষণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষন নিয়ে আমার এই লেখাটি লেখার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্ষণ প্রতিরোধে ঠিক কোন কোন জায়গায় কাজ করা উচিত, কেন করা উচিত সে বিষয়ে একটা বিজ্ঞানসম্মত ধারণা দেয়া, ধর্ষণকে নরমালাইজ করা না। কারণ আমি জানি আমাদের আশেপাশেই অনেক রেপিস্ট বা পটেনশিয়াল রেপিস্ট ভালমানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
তারা কেউ কেউ হয়ত এটা বলবে, সবই যখন সাইকোলজিকাল কারণে হয়, তাহলে মানুষের কী দোষ! দোষ অবশ্যই আছে। আপনি চাইলেই মাদকাসক্ত না হতে পারেন, চাইলেই পর্নোগ্রাফিক মুভি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেন, চাইলেই ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক অনুশাসন মেনে আপনার ego, superegoকে উন্নত করতে পারেন। তা না করে, সব দোষ সাইকোলজি আর মেয়েদের পোশাকের এসব কথা বলে বলে নিজেকে পটেনশিয়াল রেপিস্ট থেকে রেপিস্টে উন্নীত করার দায়ভার অবশ্যই আপনার।
লেখক- ডাঃ মাহাবুবা রহমান, রেসিডেন্ট, ডিপার্ট্মেন্ট অফ চাইল্ড এন্ড এডলোসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
*
প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন