৩ তারিখে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, মামলা হয়েছে, আসামীকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ১১ তারিখে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়েছে, আর সাতদিনের মাথায় আজ সেই ধর্ষককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়েছেন বিচারক। বাগেরহাটে ঘটেছে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটা...

বাংলাদেশে ধর্ষণ না কমার সবচেয়ে বড় কারন যেটাকে ধরা হয়, সেটা হচ্ছে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা। ধর্ষণের মামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে, একেকটা মামলা বছরের পর বছর ধরে চলে। ১২/১৪ বছর ধরে চলছে, এমন মামলাও আছে। সাক্ষী মারা যায়, তদন্তকারী কর্মকর্তা আর বিচারক বদল হয়, তারিখের পর তারিখ আসে, কোর্ট-কাছারির অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে নির্যাতিতা আর তার পরিবারের দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়, শুধু বিচারটাই হয় না। 

তবে ব্যতিক্রম দেখা গেল এবার, যে ব্যতিক্রমটা দেখে আশাবাদী হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। বাগেরহাটে এক শিশুকে ধর্ষণ মামলায় মাত্র সাত কর্মদিবসে রায় প্রদান করেছেন আদালত। অভিযোগপত্র দায়েরের মাত্র সাত দিনের মধ্যে আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজায় দণ্ডিত করার এই অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছেন বাগেরহাট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মো. নূরে আলম। 

মামলার বিবরণে জানা গেছে, বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার মাকড়ঢোন আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় পিতৃহীন সাত বছর বয়সী এক শিশু তার মামাবাড়িতে থেকে বড় হচ্ছিল। গত ৩ অক্টোবর বিকেলে ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ৫৩ বছর বয়সী আবদুল মান্নান সরদার শিশুটিকে চকলেট-বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে নিজ ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে এই ঘটনা জানাজানি হলে সেদিন রাতেই মেয়েটির মামা মোংলা থানায় আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন এবং পুলিশ মান্নানকে গ্রেপ্তার করে।

ধর্ষক আবদুল মান্নান সরদার

এখানে একটা বাহবা পাবেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোংলা থানার উপপরিদর্শক বিশ্বজিৎ মুখার্জিও। চারপাশে পুলিশদের প্রচুর সমালোচনা, অনেক অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে এই বাহিনীর সদস্যরা। সেই পুলিশেরই প্রতিনিধি এই ভদ্রলোক ধর্ষণের সত্যতা পেয়ে মাত্র আট দিনের মাথায় অভিযুক্ত আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে ১১ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন, মামলাটিকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন, কালক্ষেপণ করেননি একদমই। তার জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসা। পুলিশ বাহিনীতে প্রদীপ-আকবররা যেমন আছেন, তেমনই বিশ্বজিৎরাও আছেন হাজারে হাজারে।

মামলাটি স্পর্শকাতর হওয়ায় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে পাঠানো হয়। এরপর বিচারকাজ এগিয়েছে বিদ্যুতের গতিতে। ১২ অক্টোবর মামলাটির অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৩ অক্টোবর বাদীপক্ষের মোট ১৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ১৪ অক্টোবর চিকিৎসক, বিচারিক হাকিম, নারী পুলিশ সদস্য এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ১৫ অক্টোবর আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনে সাফাই সাক্ষ্য নেওয়া হয়। 

এরপর রোববার বাদী ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে সোমবার (আজ) রায়ের দিন ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক। আজ দুপুরে একমাত্র আসামি আব্দুল মান্নান সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হয়। সেইসঙ্গে তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই রায় এবং সাত কার্যদিবসে ধর্ষিতাকে বিচার এনে দেয়ার এই ঘটনাটা বাংলাদেশের আইন ও বিচার বিভাগের ইতিহাসে ঐতিহাসিক একটা অধ্যায় হয়ে থাকবে। 

চমৎকার এই নজির স্থাপিত হয়েছে বাগেরহাটে

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে- কোনো ধর্ষণের ঘটনায় আসামি সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়লে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন করা যাবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আন্তরিক থাকলে অল্প সময়ের মধ্যে যে বিচার কাজ শেষ হতে পারে এটি তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে নিশ্চয়ই। বাগেরহাটের আদালতের এই সংক্ষিপ্ত সময়ে রায় ঘোষণার মধ্যে দিয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে, এমন আশা আমরা করতেই পারি। 

নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন রোধ এবং নারী অধিকার নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের বেশিরভাগেরই অভিমত হচ্ছে, ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ফাঁসির সআজার চেয়ে বেশি জরুরী হচ্ছে ধর্ষণের প্রতিটি অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত, এবং বিচার বিভাগে গতিশীলতা আনা। ধর্ষণের মামলাগুলোকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আনারও দাবী জানিয়েছিলেন অনেকে। অ্যাসিড হামলার বিচার যেমন ৯০ দিনের মধ্যে করতে হতো, তেমনই একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়ারও পক্ষপাতী ছিলেন তারা। বাগেরহাটের এই রায়টা যেন প্রমাণ করছে, তদন্ত প্রক্রিয়া যদি এবং আদালতের বিচারকাজে যদি দ্রুততা আনা যায়, তাহলে ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনার বিচারই অল্প সময়ের মধ্যে করা সম্ভব হবে, আবদুল মান্নান সরদাররের মতো ভদ্রলোকের বেশধারী পশুদের সংখ্যাটাও কমে আসবে অনেকটা...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা