কবে আমাদের মেয়েরা রাত বিরাতে এই শহরের পথে-প্রান্তরে একাকী চলাফেরা করতে পারবে? আদৌ কী পারবে? নাকি ঢাকা পরিণত হবে ভবিষ্যত রেপ ক্যাপিটাল অফ দ্য ওয়ার্ল্ডে?
ভারতকে ব্যাঙ্গ করে আমাদের দেশের অনেকে ডাকে রেপিন্ডিয়া, সেখানে ধর্ষণের পরিমাণ বেশি, এজন্যে। ব্যাপারটা এখন নিজেদের উদোম পাছা দেখিয়ে অন্যের খালি গা নিয়ে উপহাস করার মতোই হয়ে গেছে। দিনেদুপুরে এই দেশে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন নারী, চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হচ্ছে তরুণীকে, সেসব ঘটনার কোন বিচার হচ্ছে না, অনেক জায়গায় অপরাধীও ধরা পড়ছে না, সেই দেশের নাগরিক হয়ে অন্যকে ধর্ষণ নিয়ে উপহাস করার জন্যে বুকের পাটা থাকা লাগে। আমাদের সেটা আছে।
ঢাকার কুর্মিটোলায় গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন, বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়ে কুর্মিটোলায় নেমেছিলেন তিনি। সেখানেই তার পিছু নিয়েছিল কয়েকজন। সেই তরুণী তাদের কবল থেকে পালানোর চেষ্টা করায় পেছন থেকে আক্রমণ করা হয়েছে তাকে, তাকে পেটানো হয়েছে, তারপর তার ওপর চালানো হয়েছে মধ্যযুগীয় নির্যাতন। ঢাকার মতো শহরে আলো ঝলমলে সন্ধ্যেবেলায় ঘটেছে এই ঘটনা। এই ২০২০ সালে। ভাবুন একবার। তারপর অন্যকে রেপিন্ডিয়া বলার কথাটা স্মরণ করুন। নিজের গায়ে থুথু মারতে ইচ্ছে করছে?
কুর্মিটোলায় বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার জন্যে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ওঠেন ওই ছাত্রী। বাস থেকে কুর্মিটোলা এলাকায় নামার পর অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজন তার মুখ চেপে ধরে। তাকে অচেতন করে ধর্ষণ করা হয়। রাত ১০টার দিকে চেতনা ফেরার পর তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বান্ধবীর বাসায় যান। বান্ধবীকে ঘটনা জানান। এরপর সহপাঠীরা তাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। জানিয়ে রাখি, আঠারো ঘন্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও, এখনও কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
নির্মমতার শিকার ওই ছাত্রী এখন ভর্তি আছেন ঢাকা মেডিকেলের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। শারিরীকভাবে তিনি মোটামুটি সুস্থ আছেন, বিপদমুক্ত বলা চলে। কিন্ত বাংলাদেশ কি বিপদমুক্ত? আমাদের মা-বোন-কন্যারা কি রাস্তায় বিপদমুক্ত? একটাই জবাব- না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটি ভুক্তভোগী হয়ে চিরাচরিত সত্যিটাই শুধু সামনে এনেছেন। এই দেশে তনুর ঘটনা ঘটেছে, রূপার ঘটনা ঘটেছে, আদালতে জমা পড়ে আছে লাখ লাখ ধর্ষনের মামলা, সেই দেশে ধর্ষন তো খুব বড় কোন ঘটনা নয়!
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর হত্যাকান্ডের পরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কারো বেডরুমের নিরাপত্তা তো সরকার দিতে পারবে না। আমরা বেডরুমের নিরাপত্তা চাইছি না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের রাস্তার নিরাপত্তাটুকু দিন। দয়া করে এইটুকু নিশ্চিত করুন যে, আমাদের মেয়েরা যাতে নিরাপদে রাস্তায় চলাচল করতে পারে গণপরিবহনে চড়তে পারে। সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে আমাদের মায়েরা, আমাদের বোনেরা যেন কর্মস্থল থেকে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে।
সন্ধ্যা সাতটায় কুর্মিটোলার মতো ব্যস্ত জায়গায় যেন কাউকে গণধর্ষণের শিকার হতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বেডরুমের নিরাপত্তা দিতে হবে না। দয়া করে একবার শুধু মুখ ফুটে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করুন, বলুন যে কোন ধর্ষককে পার পেতে দেয়া হবে না। সবাই আপনার আদেশের অপেক্ষায় বসে থাকে, এই দেশে এখন আপনি না বললে গাছের পাতাও নড়তে চায় না। ধর্ষণের মহামারী থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্যে একটু কঠোর হোন দয়া করে।
ভারতের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম, ভারতকে দিয়েই শেষ করি। দিল্লিকে একটা সময় বলা হতো রেপ ক্যাপিটাল অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। সন্ধ্যার পরে মেয়েদের বাইরে বের হওয়াটাই ছিল ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার। বন্ধুর সঙ্গে রাতে সিনেমা দেখতে যাওয়া নির্ভয়াকে ধর্ষণ এবং অত্যাচার করে মেরে ফেলার ঘটনাটার পরেই নড়েচড়ে বসেছিল দিল্লি সরকার। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি সেখানে ক্ষমতায় আসার পরে প্রথমেই দিল্লির কপাল থেকে এই কলঙ্ক ঘোচানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
দিল্লিতে দুই লক্ষ পথবাতি লাগানো হয়েছে নতুন করে, পুরনোগুলো মেরামত করে ঠিক করা হয়েছে। এক লক্ষ চল্লিশ হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে গত পাঁচ বছরে, আরও দেড় লক্ষ ক্যামেরা লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দিল্লির প্রতিটি কোণা আজ আলোকিত, দিল্লির শতকরা আশিভাগ জায়গা সর্বক্ষণ পুলিশের নজরদারির ভেতরে থাকে। শুধুমাত্র নারীদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে দিল্ল পুলিশের আলাদা ইউনিট আছে, হেল্প সেন্টারে ইমার্জেন্সি ফোন নম্বরের সামনে দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা বসে আছেন জনা পঞ্চাশেক এজেন্ট। মোড়ে মোড়ে ডিউটিতে থাকে পুলিশের পেট্রোল টিম, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কর্মব্যস্ততা বাড়ে।
দিল্লির এই মডেলটা আমরা অনুসরণ করতে পারি না? গ্রীন ঢাকা, যানযটমুক্ত ঢাকারমতোই ধর্ষণ মুক্ত ঢাকা, নিরাপদ ঢাকাও তো আমাদের চাহিদা। সেই চাহিদাটা পূরণ হবে কবে? কবে আমাদের মেয়েরা রাত বিরাতে এই শহরের পথে-প্রান্তরে একাকী চলাফেরা করতে পারবে? আদৌ কী পারবে? নাকি ঢাকা পরিণত হবে ভবিষ্যত রেপ ক্যাপিটাল অফ দ্য ওয়ার্ল্ডে?