খিলজির চরিত্রের ভেতরে ঢোকার জন্য নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলেছিলেন রনবীর, তীব্র গরমের মধ্যে পনেরো কেজি ওজনের যুদ্ধ সরঞ্জাম লাগিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন, শুটিং শেষ হবার পর এই চরিত্র থেকে বের হবার পর তাকে ছুটতে হয়েছিল মনোবিদের কাছে...

অভিনেতা রনবীর সিং তার ফিল্মি ক্যারিয়ারের দশ বছর পার করছেন আজ। লুটেরা, রামলীলা, গালি বয় সহ দারুণ কিছু সিনেমায় অভিনয় করলেও, সমালোচকদের মতে, রনবীর তার ক্যারিয়ারের সেরা অভিনয়টা করেছেন পদ্মাবত সিনেমায়, আলাউদ্দীন খিলজীর চরিত্রে। 

সিনেমাটা নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয়েছিল, অনেক বিতর্কের পরে মুক্তি পেয়েছিল সঞ্জয় লীলা বানশালি'র 'ড্রীম প্রোজেক্ট' পদ্মাবত। রাজস্থানী রাজপুতেরদের তীব্র বিরোধীতা আর আন্দোলন, সিনেমার সেটে হামলা, রানী পদ্মাবতী চরিত্রে অভিনয় করা দীপিকা পাড়ুকোনের মাথার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া, যথাসময়ে সেন্সরবোর্ডে ছাড়পত্র না পেয়ে সিনেমার মুক্তি পেছানো সহ আরও নানা ঘটনায় আলোচনার তুঙ্গে ছিল সিনেমাটা। পরে তো 'পদ্মাবতী' থেকে নাম পরিবর্তন করে পদ্মাবত রাখতে হয়েছে। 

সিনেমা মুক্তির পরে মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় ভেসেছেন পরিচালক। অভিনেতাদের অভিনয়ের প্রশংসা হয়েছে কমবেশী। কেউ বানশালীর প্রশংসা করতে করতে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তো কেউ গালি দিতে দিতে। তবে একটা জায়গায় সবাই এক, প্রতিটা মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে সিনেমায় 'রনবীর সিং'- এর অভিনয় উপভোগ করেছেন। নেগেটিভ ক্যারেক্টারে বাজীমাত করে দিয়েছেন এই অভিনেতা। আলাউদ্দিন খিলজীর চরিত্রটা রনবীরের চেয়ে ভালো করা এই মূহুর্তে আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না বলে জানিয়ে দিয়েছেন সবাই একবাক্যে। অমিতাভ বচ্চন থেকে শাহরুখ খান, সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ রনবীরের দুর্দান্ত অভিনয়ের। বেশীরভাগ ফিল্ম ক্রিটিকের মতে, এটাই নাকি রনবীরের ক্যারিয়ারসেরা অভিনয়! 

ট্রেলার মুক্তির পরেই অবশ্য গুঞ্জন উঠেছিল একপ্রস্থ। রনবীরের একটাও ডায়লগ নেই দুই মিনিটের ট্রেলারে, তবুও শুধু চাউনি আর এক্সপ্রেশন দিয়েই চরিত্রের ভয়াবহতার খানিকটা নমুনা দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। আর সিনেমা মুক্তি পাবার পরে তো পদ্মাবত হয়ে গেছে আলাউদ্দিন খিলজীরূপী রনবীরের সিনেমাই! অথচ এমন ভিলেন ক্যারেক্টার করার আগে বলিউডের নায়কেরা দশবার ভাবেন। রনবীরও ভেবেছিলেন, ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই সিনেমায় কাজ করার ব্যপারে। চলুন জেনে নেয়া যাক, কিভাবে রনবীর সিং হয়ে উঠলেন পর্দার 'আলাউদ্দিন খিলজী'।

আলাউদ্দিন খিলজীর চরিত্রে রনবীর সিং

#১- আলাউদ্দিন খিলজীর রোলে প্রস্তাব পাবার পরে রনবীর সিং বেশ অবাক হয়েছিলেন। এন্টি-হিরোর রোলে তিনি কতটা মানানসই হবেন, নিজেকে চরিত্রের সাথে কতখানি মিশিয়ে ফেলতে পারবেন, দর্শকই বা কিভাবে তাকে গ্রহণ করবে- এসব দুশ্চিন্তা ছিলোই। আবার সঞ্জয় লীলা বানশালী নামটাও খানিকটা আশা যোগাচ্ছিল তাকে, বানশালীর 'রামলীলা' আর 'বাজীরাও মাস্তানী'তে নায়ক ছিলেন রনবীর। সেই বানশালীর ওপর ভরসা রেখেই অনেক ভেবেচিন্তে রনবীর 'হ্যাঁ' বলে দিয়েছিলেন পরিচালককে। 

#২- পুরো একটা বছর ধরে সিনেমার জন্যে 'আলাউদ্দিন খিলজি'র গেটাপে ছিলেন রনবীর। লম্বা দাড়ি-চুলে ঢাকা ছিলেন অনেকটা সময়। এমনিতে রনবীর বাচ্চাদের আদর করতে খুব পছন্দ করেন, ওদের সঙ্গে খেলতেও ভালোবাসেন। কিন্ত এই লুকের কারণে ছোট বাচ্চারা ভয়ে তার আশেপাশে আসতো না। একবার এক ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বেশ বিপদেই পড়ে গিয়েছিলেন রনবীর, ভয় পেয়ে বাচ্চাটা যে কান্না শুরু করেছিল, সেটা ঘন্টাখানেকের আগে থামেনি! 

#৩- পদ্মাবতের ক্লাইম্যাক্স সিনেমার শুটিং করার সময় মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন রনবীর। কিন্ত ডিরেক্টর 'কাট' বলার আগে টেরই পাননি সেটা। সেটের কেউ তখনও বুঝতে পারেনি যে তিনি আহত হয়েছেন। মাথার কাটা জায়গা থেকে রক্ত বেরিয়ে এসে চোখমুখ ভিজিয়ে দেয়ার পরে হুঁশ হয় রনবীরের। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। ব্যান্ডেজ করে কয়েক ঘন্টা পরেই নাকি আবার শুটিঙের সেটে চলে এসেছিলেন এই অভিনেতা!

#৪- ইস্ট গুরগাঁওয়ের ফিল্ম সিটিতে সিনেমার অনেকটা অংশের শুটিং হয়েছিল, সেট বানানো হয়েছিল সেখানে। রনবীর সেই ফিল্ম সিটির পাশেই একটা ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন। একাই থাকতেন সেখানে, একদম একা। মূলত আলাউদ্দিন খিলজীর চরিত্রে নিজেকে পুরোপুরি ঢুকিয়ে ফেলার জন্যেই এই কাজটা করেছিলেন তিনি, যাতে শুধু অভিনয়েই ডুব দিতে পারেন, রনবীর সিং নামের মানুষটাকে কিছুদিনের জন্যে ভুলে গিয়ে হয়ে উঠতে পারেন আলাউদ্দিন খিলজী। শুটিং শুরুর আগে একুশ দিন নিজেকে সেই ফ্ল্যাটে বন্দী করে রেখেছিলেন রনবীর, এই সময়ে কোথাও বের হননি তিনি, কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি, খাওয়া-দাওয়া সবকিছু ফ্ল্যাটের ভেতরেই হয়েছে। এই তিন সপ্তাহে তিনি স্ক্রীপ্টটা গিলে ফেলেছেন একদম। আলাউদ্দিন খিলজি আর তার সম্পর্কে প্রচুর বই সংগ্রহ করে পড়েছেন তিনি। 

#৫- খিলজীর চরিত্রে নিজেকে প্রস্তত করার জন্যে বাড়তি একজন ফিটনেস ট্রেনার রেখেছিলেন রনবীর। দিনের বেশীরভাগ সময় জিমেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন তিনি। এই সময়টায় বানশালী ছাড়া আর কারো সাথেই সেভাবে দেখা-সাক্ষাৎ হতো না তার। 

খিলজীর চরিত্র থেকে বের হবার জন্য মনোবিদের সাহায্যও নিতে হয়েছিল রনবীরকে

#৬- সঞ্জয় লীলা বানশালীর সঙ্গে রনবীরের সম্পর্কটা বেশ ভালো, বানশালীর প্রিয় অভিনেতাদের একজন তিনি। একসঙ্গে আগেও কাজ করেছেন, সম্পর্কটা বেশ পোক্ত ছিল গুরু-শিষ্যের। দুজনের জুটিটা এবারও বাজীমাত করেছে। শুটিং চলাকালীন সময়েই রনবীর বানশালীকে স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছিলেন, আলাউদ্দিন খিলজী হিসেবে যেকোনকিছুই তাকে দিয়ে পর্দায় করাতে পারবেন বানশালী। আবার বানশালীও রনবীরকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, নিজের মতো করে আলাউদ্দিন খিলজীকে তার ভেতরে ধারণ করার। ফলাফল তো সবার চোখের সামনেই!

#৭- খিলজীর চরিত্রটা পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে রনবীরকে। 'খালিবালি' গানটা যারা দেখেছেন, তারা জানেন, কি পরিমাণ এনার্জেটিক ছিল সেটা। সেই গানের শুটিং করার সময় একটা পর্যায়ে পা আর নরতে চাইতো না রনবীরের, রোবটের মতো শুধু স্টেপগুলো ফলো করতেন তিনি। মাইক্রোফোনে 'কাট' আওয়াজটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দুই হাঁটু চেপে ধরে বসে পড়তেন। মে মাসের তীব্র গরমে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রীরও বেশী তাপমাত্রায় গায়ে পনেরো কেজি ওজনের যুদ্ধ সরঞ্জাম লাগিয়ে একটানা দৌড়াতে হতো তাকে, কিংবা ঘোড়ায় চড়তে হতো। ক্লান্তিকে পাত্তা দেননি রনবীর। খানিকটা বিশ্রাম নিয়েই ছুটতেন পরের শটের জন্যে। 

#৮- শুধু শারিরীক নয়, মানসিকভাবেও খিলজী চরিত্রটা যথেষ্ট ভুগিয়েছে এই অভিনেতাকে। এই ডার্ক ক্যারেক্টারে এত বেশী ডুবে গিয়েছিলেন রনবীর, যে এখান থেকে একা বেরুতেই পারছিলেন না। শুটিং শেষ হবার পরেও নিজের মধ্যে খিলজীর ছায়া অনুভব করতেন তিনি বুঝতে পারতেন, তার নানা আচরণে কাছের মানুষেরা বেশ অবাক হচ্ছেন। একারণে মনোবিদের কাছেও যেতে হয়েছিক রনবীরকে। 

সিনেমা কখনও বাস্তব নয়। কিন্ত পর্দায় এটাকে বাস্তবের মতো জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলাটা মুখের কথা নয় মোটেও। খিলজীর চরিত্রে রূপদানের জন্যে রনবীরের এই ডেডিকেশনটাই বলে দেয়, অভিনয় জিনিসটা মোটেই ছেলের হাতের মোয়া নয়। পর্দায় আমরা যেসব অভিনয় দেখে বাহবা দেই, সিনেমা হলে বিভিন্ন দৃশ্যে হাততালি দিয়ে উঠি, সেসব দৃশ্য, সেসব চরিত্রের পেছনে না জানা কত ত্যাগ আর পরিশ্রমের গল্প যে লুকিয়ে থাকে...! 

তথ্যসূত্র- দ্যা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইমস।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা