দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার ও পুলিশ সুপারের বাগড়া
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ডাক্তার ভদ্রমহিলাটি ভালোবেসে একজন নরসুন্দরকে বিয়ে করেছেন। তাই এসপি মিলু বিশ্বাসের চোখে এই ভালোবাসা হয়ে গেছে অপরাধ, কিংবা ব্যাভিচার, আর সেকারণে দুজনকে গ্রেপ্তার করে তিনি সংবাদ সম্মেলনে হাজির করেছেন...
ঠিক যেন নব্বইয়ের দশকের বাংলা সিনেমার গল্প। ধনীর দুলালী প্রেমে পড়েছে গরীব চাকরের। মেয়ের বাবা হচ্ছেন প্রতাপশালী চৌধুরী সাহেব, এই 'অসম প্রেম' তিনি কোনোভাবেই মেনে নেবেন না। বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ালেন তিনি দুজনের মাঝখানে, মেয়ের বিয়ে দিলেন অন্যত্র। ভাবলেন ল্যাঠা চুকে গেছে এবার।
কিন্ত না, চৌধুরী সাহেবরা ভালোবাসার শক্তি সম্পর্কে কখনোই পুরো ধারনা রাখেন না। তারা জানেন না, যারা ভালোবাসে, তারা লড়াই করতে জানে। তাই কয়েক বছর জোর করে সংসার করার পরে, এক সন্তানের মা হয়েও মেয়েটি মন থেকে মুছতে পারলো না তার প্রেমিককে, বাধ্য হয়েই স্বামীকে তালাক দিয়ে সে সন্তানকে কোলে নিয়ে ফিরে এলো প্রেমিকের কাছে। সেই প্রেমিকও তাকে গ্রহণ করলো সসম্মানে, দুজনে হাত ধরে পালিয়ে গেল অন্য এক শহরে।
বাংলা সিনেমা হলে গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতো, অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো- এরকম একটা বার্তা দিয়ে। কিন্ত ঘটনাটা যেহেতু বাস্তবের, তাই এখানে টুইস্ট আসবেই। ঘটনার বিস্তারিত বলা যাক। এক প্রাপ্তবয়স্ক নারী চিকিৎসক ভালোবেসে বিয়ে করেছেন তার প্রেমিককে, যিনি পেশায় একজন নরসুন্দর, খাঁটি বাংলায় বললে নাপিত। বিয়ের আগে ভদ্রমহিলা তার সাবেক স্বামীকে ছেড়ে এসেছেন, ডিভোর্সও দিয়েছেন। সেই নারীর বাবা তখন তার মেয়েকে অপহরণের অভিযোগে মামলা করেছেন।
কিন্ত তদন্তে নেমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি জানতে পেরেছে পুরো গল্পটা, তারা এও জেনেছে যে প্রাপ্তবয়স্কা সেই নারী নিজের ইচ্ছেতেই ঘর ছেড়েছেন, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে নতুন করে সংসার পেতেছেন। ওই চিকিৎসকের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। আগের স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সম্পর্ক তৈরি হয় আরেক জনের সঙ্গে। পরিবারের অমতে বিয়ে করে চলে আসেন ঢাকায়। রোগী দেখে সংসার চালান। নতুন সংসারে তাদের একটি সন্তানও হয়েছে। আগের সংসারের সন্তানকেও দেখাশোনা করেন তিনি।
তবুও ওই চিকিৎসক ও তার স্বামীকে ধরে এনে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে ‘আপত্তিকর’ বক্তব্য দিয়েছে তারা। সাংবাদিক ডেকে ছবিও তোলা হয়েছে। আর পুরো কাজটি করা হয়েছে রংপুর সিআইডির পুলিশ সুপার (এসপি) মিলু মিয়া বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে। কারন মিলু বিশ্বাস এই 'অসম প্রেমে' বিশ্বাসী নন, একজন ডাক্তার কোনোভাবেই একজন নরসুন্দরকে বিয়ে করতে পারেন না- এই হচ্ছে তার অভিমত। নিজের চেয়ে কম শিক্ষিত এবং সমাজের চোখে কম যোগ্যতাসম্পন্ন একজন পুরুষকে বিয়ে করে নারী চিকিৎসকটি 'অপরাধ' করেছেন বলেও মিলু বিশ্বাসের অভিমত।
ওই নারী যাকে বিয়ে করেছেন, তিনি পেশায় নাপিত। দুজনকে আটকের পর সংবাদ সম্মেলনে এনে তার পেশার পরিচয় সামনে এনে বক্তব্য দিয়েছে সিআইডি। বলা হয়েছে, এই দম্পতি নাকি ব্যভিচার করেছেন। তাদের দাবি, এই দুই পেশার মানুষের মধ্যে বিয়ে হতে পারে না। ২০২০ সালে এসে যে আইনের পোশাক গায়ে জড়িয়ে কেউ এমন অর্বাচীনের মতো কাজ করতে পারেন, এমন কুযুক্তি দিয়ে কথা বলতে পারেন, সেটা খবরটা পড়ার পরেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। সংবাদ সম্মেলনে গ্রেপ্তার হওয়া সেই নারী চিকিৎসক স্পষ্ট করেই বলেছেন যে তিনি নিজের ইচ্ছেতেই প্রেমিকের কাছে গেছেন, তাকে জোর করা হয়নি, কেউ অপহরণও করেনি। তবুও এসপি মিলু বিশ্বাসের অদ্ভুত সব বখাট্যে যুক্তির বহর থামছিল না।
মিলু বিশ্বাসের দাবী, এই নারী যা করেছেন তাতে আইনের লঙ্ঘন না হলেও নীতির লঙ্ঘন হয়েছে। মিলু বিশ্বাসের মতে, তারা দুজনে (নারী ও পুরুষটি) নাকি অপরাধ করেছেন, ব্যাভিচার করেছেন! মিলু বিশ্বাস বলেছেন- ‘আপনি আগে আইন বোঝেন। মনে করেন, আপনার ওয়াইফ বাচ্চাসহ আপনার কাছ থেকে চলে গেল। এটা সে করতে পারে না। আইনে এটা নিষেধ আছে। ব্যভিচার করেছে সে। যদি সে মেয়ে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায় তাইলে এটা ঠিক আছে।’ এসপি সাহেবকে যখন মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে যে ওই নারী তার স্বামীকে আগেই তালাক দিয়েছিলেন, তাহলে এমন কথা কেন- তখন তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর দেননি।
এসপি মিলু বিশ্বাসের কথা শুনলে যে কোন নীতিবান মানুষই অবাক হবেন। সংবাদ সম্মেলনে বসে এমন বিদ্বেষমূলক কথা যে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন অফিসার বলতে পারেন, সেটা ভাবতেই কষ্ট হয়। তিনি বলেছেন- 'ওই নারী নৈতিক অপরাধ করেছেন। তিনি এক জন ডাক্তার। তিনি যার সঙ্গে চলে গিয়েছেন, তার সঙ্গে তার যাওয়া মানায় না।' অর্থাৎ কে কার সঙ্গে প্রেম করবে, কার সঙ্গে সংসার পাতবে, কার সঙ্গে কার যাওয়া মানায় আর কারটা মানায় না- সেটা ঠিক করে দেয়ার দায়িত্ব মিলু বিশ্বাস নিজের কাঁধে তুলে নিয়েঁছেন। চমৎকার ব্যাপার!
মিলু বিশ্বাস আরও বলেছেন- ‘এইগুলা নৈতিক অপরাধ। এটা বিচারাধীন বিষয়, তবে তাতে সমস্যা নেই। আমরা মিডিয়ার সঙ্গে কাজ করি। আর আমরা যদি এই তথ্য প্রকাশ না করি তবে সমস্যা হবে। সমাজের তো বোধোদয় হতে হবে। এমন বোধোদয় আমাদের হওয়া উচিত। তিনি ডাক্তার সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি এক জন ডাক্তার। তাকে কি এমন কারও সঙ্গে চলে যেতে হবে? তার কাছে কি আর কোনো রাস্তা ছিল না? আমরা এটা জানান দিতে চেয়েছি।’
আমি যতদূর জানি, এদেশে রোগী মারা যাওয়ার পর স্বজনদের হাতে যখন ডাক্তারেরা নিগৃহীত হন, তখন পুরো ডাক্তার সমাজকে হেয়-প্রতিপন্ন করা হয়। কিন্ত একজন ডাক্তার একজন নাপিতের সঙ্গে সংসার করলে কেন ডাক্তার সমাজের অপমান হবে- এই কঠিন বিষয়টা মাথায় ঢুকলো না একদমই। এই ডাক্তার ভদ্রমহিলাটি যদি একজন ইঞ্জিনিয়ার অথবা চাকরিজীবীকে ভালোবেসে তার সঙ্গে সংসার শুরু করতেন, তাহলে এসপি মিলু বিশ্বাসের আপত্তি থাকতো বলে মনে হয় না। তার আপত্তির কারণ একটাই- নারীটি একজন নরসুন্দরকে ভালোবেসেছেন। তাই মিলু বিশ্বাসের চোখে এই ভালোবাসা হয়ে গেছে অপরাধ, কিংবা ব্যাভিচার! এই শব্দ দুটোর মানেই বদলে দিয়েছেন এসপি মিলু বিশ্বাস।
গোটা ব্যাপারটার মধ্যে চরম জাতিবিদ্বেষ আর মিথ্যে অহংবোধ মিশে আছে। শুধু ঘৃণার বশবর্তী হয়েই ওই নারী এবং তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদেরকে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করে অপমান করা হয়েছে। দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একে অন্যকে ভালোবাসবেন, বিয়ে করবেন, তাতে এদেশের কারো নাক গলানোর অধিকার নেই, সে যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন। এসপি মিলু বিশ্বাস যেটা করেছেন সেটা অন্যায়, সেটা ক্ষমতার অপব্যবহার। ভাগ্য ভালো যে আদালত এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে সেই নারীকে মুক্তি দিয়েছেন, তবে তার স্বামী এখনও কারাগারে।
সিনেমায় প্রদর্শিত দৃশ্যের কারনে নাকি পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে ইদানিং। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, পুলিশের পোশাক গায়ে জড়িয়ে জনাব মিলু বিশ্বাস যে কাজটা করেছেন, তাতে পুলিশের অপমানটা আরও বেশি হয়েছে। সেটা কি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বুঝতে পারছেন? ভাগ্যিস, গোটা পুলিশ ফোর্সের অবস্থাটা এমন নয়। পুলিশেই অনেক অফিসার আছেন, যারা নিয়মিত নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীবিদ্বেষ, ম্যারিটাল রেপের মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চার থাকেন। এসপি মিলু বিশ্বাসের এই ন্যাক্কারজনক কাণ্ডের পরেও তারা প্রতিবাদ করছেন নিজ নিজ জায়গা থেকে।
পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ খোলাখুলি বলেছেন, এ ধরনের সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ নিজেই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা ফেসবুকে লিখেছেন-
‘আমি দুঃখিত ডা. (...), আপনার অধিকারের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে আমার। আমি বিশ্বাস করি, আপনি আপনার পছন্দের ব্যক্তিকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারেন। কোনো সঙ্গীকে পছন্দ না হলে নিয়মতান্ত্রিক ও আইনি উপায়ে অপর কোনো সঙ্গী বা বন্ধু বেছে নেওয়ার অধিকার আপনারও রয়েছে, যেমন অধিকার এ দেশে আমি ভোগ করে থাকি প্রতিনিয়ত। আপনি যে নরসুন্দরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছায়, তাঁর প্রতিও রইল শ্রদ্ধা। আমার সীমাবদ্ধতার জন্যও আমি লজ্জিত। বিশাল প্রক্রিয়ার একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র আমি। কিন্তু নিশ্চিত জানবেন, সীমাহীন আঁধারের শূন্যতায় একটি জোনাক পোকা হয়ে হলেও জ্বলছে আমাদের উদ্যোগ।’
মিলু বিশ্বাসদের কাজকর্মে আমরা যখন আশা হারিয়ে ফেলি, বিস্ময়ে স্তব্ধ হই, তখন সোহেল রানার মতো মানুষগুলোর এসব প্রতিবাদ আমাদের আশা যোগায়, একটা বার্তা দেয় যে, সবকিছু এখনও নষ্টদের অধিকারে যায়নি, কিছু কণ্ঠ এখনও গর্জে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে...