আমার একটা গল্প আছে। হলিউডে বিক্রি করা যাবে। রোমান্টিক কমেডি। গল্প হলেও আসলে কিন্তু সত্যি। গভীর রাত। ক্রোয়েশিয়ান এক ভদ্রলোক ঢুকলো এক বারে...গল্পের শুরুটা এভাবেই।
২০১১ সাল। আমার বয়স মাত্র ২১। স্পেনে পৌঁছুতেই ম্যালা রাত হয়ে গেলো- রাত দশটার মতো হবে। আগের চার বছর আমি জার্মানীর শালকে'তে খেলতাম। পরের দিন সকালে সেভিয়া ক্লাবে সাইন করার সবকিছু রেডি। শুধু মেডিকেল টেষ্ট আর সাইনটাই বাকী আছে। আমার সাথে বড় ভাই, ডেজান। হোটেলে উঠে ফ্রেশটেশ হয়ে ডিনার করতে দেরী হয়ে গেলো। সেভিয়া ক্লাবেরও কয়েকজন ছিলো। ঠিক জানি না, কেন যেন খুব নার্ভাস লাগছিলো। খুব মনে হচ্ছিলো রাতের ঘুমটাই মাটি। ভাইকে বললাম, 'চল একটু গিলে আসি, তারপর বিছানায় যাওয়া যাবে ক্ষন।' এই একটা বাক্যের কারণে আমার জীবনটা বদলে গেলো।
কারণ? কারণ হোটেল বারে যে ভদ্রমহিলা কাজ করছিলেন…ওয়াও। আমার সিনেমার এই অংশে সবকিছু হবে স্লো মোশনে…জানেন তো সিনেমায় খুব রোমান্টিক কিছু হলে সব কিছু কেন যেন স্লো মোশনে শুরু হয়। মানুষটা ভয়াবহ সুন্দর। নিজেকেই বললাম, 'ওকে, সেভিয়া। ওয়াও। জায়গাটা সুন্দর। অদ্ভুত সুন্দর। ভালো লেগেছে।' ভালো লাগলেও এক 'ওলা' ছাড়া কিছুই বলতে পারিনি। কারণ স্প্যানিশ জানি না। জার্মান পারি, ইংরেজী, ইটালীয়ান, ফ্রেঞ্চ জানি, পারি আর সার্বো- ক্রোয়েশিয়ান তো মায়ের ভাষাই। পারি না খালি ঐ স্প্যানিশ। কি অবস্থা!
কি আর করা যাবে! আমি আর ভাই বসে বসে রাজা উজির মারছিলাম। ঠিক এই সময় ইউরোপিয়ান আরেকটা ক্লাব থেকে ফোন আসলো ভাইয়ের ফোনে। ওপাশ থেকে জানালো, ওরা শুনেছে আমরা সেভিয়াতে এসে পৌঁছেছি। চাইলে ওরা আমাদের জন্যে প্লেইন পাঠাবে, সেভিয়ার বদলে শুধু ঐ ক্লাবে সাইন করতে হবে । তখনো সেভিয়ার সাথে আমার চুক্তি হয়নি। স্পেনে আসাটা আমার জন্যে বিশাল একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার ছিলো, বিশাল একটা ঝুঁকিও বলতে পারেন। নতুন দেশ, নতুন ভাষা। কাউকে চিনিও না এখানে। যারা আমার জন্যে আস্ত একটা বিমান পাঠাতে চেয়েছিলো- তাদের ওখানে যোগ দিলে সবকিছু সহজ হতো হয়তো...চেনাজানা ছিলো, পরিচিত মুখ ছিলো।
ভাই জিজ্ঞাসা করলো, 'কি করবি?'
'কি আবার করবো? আমি তো সেভিয়ার প্রেসিডেন্টকে হ্যাঁ বলে দিয়েছি। ঐসব সিগনেচারের চাইতে আমার মুখের কথার দাম অনেক বেশি।'
'আচ্ছা। তাই বলে দিই ওদের।'
এরপর আমি ভাইকে বারের ওয়েইট্রেসকে দেখালাম। 'আমাদের ওয়েইট্রেসকে দেখেছিস? আমি এখানে সেভিয়াতে খেলবো আর ঐ মেয়েটাকেই বিয়ে করবো।' হুট করে এরকম কথা বললে কেউ বিশ্বাস করে? আমার ভাই হাসা শুরু করলো। বললো, 'আচ্ছা যা ভালো মনে করিস।' চেহারায় তীব্র অবিশ্বাস আর মুখে হাসি। এর মাঝে আবার সেই ওয়েইট্রেস এসে জিজ্ঞাসা করলো আমাদের শেষ হয়েছে কিনা। ভাইকে বললাম, 'আমার খুব নার্ভাস লাগছে। ঘুমাতে পারবো না মনে হয়। আরেকটু গিলি চল।'
পরেরদিন সকালে সেভিয়ার সাথে চুক্তির সমস্ত কাজ শেষ হয়ে গেলো। সেই হোটেলে ছিলাম টানা তিন মাস। থাকার একটা বাসা খুঁজছিলাম। টানা তিন মাস থাকাটা আমার জন্যে ছিলো তীব্র আনন্দের। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে যেতাম হোটেল বারে। এক কাপ কফি আর ঠান্ডা অরেঞ্জ ফান্টার জন্যে। আসলে ওসব খায় কে! যেতাম সুন্দর মানুষটাকে দেখার জন্যে। কালো একটা ভেষ্ট সামনে চেপে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে এক ডানা কাটা পরী। দেখতেই তো ভাল লাগে!
আমি শুধু মানুষটার নাম জানতাম। র্যাকুয়েল। বেচারি পারতো না ইংরেজী আর আমি স্প্যানিশ। তাই প্রতিটা দিন… “Buenos días, Raquel. Un café y un Fanta naranja.” কিভাবে ব্যাখ্যা করি বলুন তো! হয় না ওরকম…হঠাৎ কাউকে দেখলেন আর বুকের ভেতর ক্যামন ওলট পালট হয়ে গেলো। সেই মানুষটাকে প্রতিদিন দেখছেন, প্রতিদিন বুকের ভেতর ভাঙচুর হচ্ছে…মনে হয়ে ভেতরে বোমা ফাটছে নিঃশব্দে। দিনের পর দিন যায়, খুব আস্তে আস্তে আমি স্প্যানিশ শেখা শুরু করেছি…খুব অল্প কিছু শব্দ পেটের ভেতর আর পুরোটা কথার বেশিরভাগ অংশই হাত পা নেড়ে বোঝাতে হয়। তাই করতাম। কয়েকটা স্প্যানিশ শব্দ আর বাকীটা হাত পা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। খুব মজা পেতো মানুষটা। ঐ যে টারজান সিনেমাটা আছে না, ওখানে যেমন জেইন শেখায় টারজানকে…'আমি…জেইন। তুমি…টারজান।' ওরকম দৃশ্য আর কি!
শুধু বসে থাকার জন্যে কফি খেতাম। অনেক অনেক কফি। জঘন্য অবস্থা। এর মধ্যে কুড়ি ত্রিশবারের মতো অফার করে ফেলেছি মানুষটাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষটা আমাকে কখনো না বলেনি। কিন্তু সবসময়ই কিভাবে কিভাবে যেন একটা উছিলা তুলে বলতো, এই কাজটা করতে হবে তারপরে কাজে যেতে হবে আর কাজ থেকে ফিরে সোজা বিছানায়। সময় কোথায়? তিন মাস পর আমি বাড়িতে উঠে গেলাম। যাবার সময় ক্যামন যেন খারাপ লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো এভাবে শেষ হয়? এভাবে ভালোবাসা শেষ হয়? এভাবে আমার ভালোলাগাটা শেষ হবে? হাল ছাড়তে ইচ্ছে করছিলো না, ছাড়িনিও। প্রায়ই ড্রাইভ করে চলে যেতাম হোটেলে। জঘন্য কফি সামনে নিয়ে বসে থাকতাম। যদি দেখতাম মানুষটা নেই, সোজা বাইরে অন্য কোথাও…আর থাকলে…
তুই হেসে উঠলে, সূর্য লজ্জা পায়, আলোর মুকুটখানা তোকেই পড়াতে চায়…
তুই হাততালি দিলে জাকির হোসেন, তবলা বাজানো ছেড়ে পায়রা পোষেন…
ততদিনে আমার স্প্যানিশের অবস্থা মোটামুটি। আগের চাইতে ভাল হচ্ছে। নিজেকে জোর করে স্প্যানিশ টিভি দেখাচ্ছি, শুনছি স্প্যানিশ রেডিও সব সময়। একটা জিনিস কি জানেন, বলকানরা খুব দ্রুত ভাষা শিখে ফেলে, ভাষা শিক্ষায় বেশ মেধাবী, কেন কে জানে! আমিও বলকান কিনা, বেশ দ্রুতই শিখতে পেরেছিলাম। একদিন শেষমেষ ঝেড়ে কাশলো র্যাকুয়েল। কেন সে আমার সাথে ডেইটে যেতে চায়না তা ভেঙে বললো। 'তুমি হচ্ছো ফুটবলার। দেখা যাবে সামনের বছরেই অন্য কোন দেশে ফুড়ুত। সর্যি, নো।' আমার সাইজ তো দেখেছেন। আমি মানুষটা ছোটখাটো। আমার পৃথিবীটাও খুব ছোট। ভাবলাম, 'খাইছে! আমাকে নিশ্চয়ই খেলতে দেখেছে। খেলা দেখাই বুঝে গেছে সেভিয়া আমাকে পরের বছর রাখবে না। বেঁচে দেবে। খাইছে আমারে।'
প্রতিদিন ট্রেনিংয়ে যেতাম, মাথায় থাকতো আমাকে স্কোয়াডে থাকতেই হবে। স্কোয়াডে থাকলেই সামনের বছর এখানে থাকা যাবে। মানুষটার আশেপাশেও থাকা যাবে। শেষে হয়তো একটা ডেইট পেয়েও যেতে পারি। অসম্ভব বলে তো কিছু নেই। শেষে আমার সময় কত লাগল জানেন? সাত মাস।
আমি সেভিয়ায় পৌঁছেছি জানুয়ারির ২৭ তারিখ আর আগষ্টে এক মেসেজ পেলাম মোবাইলে। 'প্রজাপতি এখন বোনের সাথে বসে ড্রিঙ্ক করছে। বারে। কাজে নেই।' বুঝেছেন তো, টাউনের সবাই কিন্তু আমার গল্পটা জেনে গেছে। মানুষটা যে বারে গেছে সেই বারেই ছিলো এমন কেউ আমাকে টেক্সট পর্যন্ত করে দিয়েছে। যে দিয়েছে তার নাম বলবো না। সাথে এক বন্ধুকে নিয়ে সোজা সেই বারে। কোন কথা নেই একেবারে র্যাকুয়েলের পাশের চেয়ারে। বললাম, 'তো, এখন তো কাজে নেই। যাক শেষ পর্যন্ত ডিনারে আসার সময় হলো!' পুরো সারপ্রাইজড মানুষটা। বললো, জানি না। হয়তো… বললাম, 'না, আমিতো আজকে যাচ্ছি না। জানি আজকে বোনের সাথে এসেছো…ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকেই শুরু করতে হবে। আজকেই ডিনার। চলো। সবাই মিলেই যাই।' সবাই মিলেই গেলাম। পর দিন লাঞ্চে দেখা হলো। তারপর থেকে আমরা একসাথেই আছি।
দুটো পরীর মতো মেয়ে আছে আমার। এই দুটো মেয়ে পালাই আমার জীবনে এখন পর্যন্ত করা সবচে কঠিন কাজ। চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতার চাইতেও কঠিন। র্যাকুয়েলের পরিবারের সাথে প্রথম দেখা হবার দিনটাও খুব মজার। যখন আমার ঐ পরিবারের সাথে দেখা হয়, আমি ততদিনে খুব কনফিডেন্ট, আমার স্প্যানিশ বেশ ভালো। যখন বিশাল একটা পরিবারের সামনে পড়ে গেলাম…মাই গড…এত দ্রুত কথা বলছিলেন মানুষগুলো, তার উপর আবার সেভিয়ার অ্যাকসেন্ট। সেভিয়ার উচ্চারণ কিন্তু একটু আলাদা। র্যাকুয়েলের বাবা আমার সাথে খুব মজা করার চেষ্টা করছিলেন...আমি বুঝতেই পারছিলাম না বেচারা কি বলার চেষ্টা করছেন। ভাব ধরছিলাম, হ্যাঁ খুব বুঝতে পারছি, মাথা ঝাঁকাচ্ছি, আবার মাঝে মাঝে হাসছিও। ভদ্রলোক ঠিকই এক পর্যায়ে ধরে ফেললেন, আমি কিছুই বুঝিতে পারছি না। শেষতক বলেই ফেললেন, 'ব্যাপার না। মাস দুইতিনেক সময় দাও, সব বুঝে ফেলবে।'
সেভিয়া মানুষজনের চরিত্রে এটা হচ্ছে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ওদের মনটা খোলা জানালার মতো আর মেশেও সবাইকে পরিবারের অংশ ভেবে। খুব একটা জটিলতা নেই। র্যাকুয়েল কিন্তু ফুটবল খুব একটা পাত্তা দেয় না। ভেবেছিলাম ওর পরিবারেও নিশ্চয়ই একই অবস্থা হবে। দেখি তা না, ঘটনা ভিন্ন। ওর পরিবারের সবাই সেভিয়া পাঁড় সমর্থক। ওর দাদা যখন মৃত্যুশয্যায় তখন হাসপাতালের নার্স হসপিটাল গাউন পড়ানোর জন্যে সব কাপড়-চোপড় খুলে নিতে পারলেও হাতের ঘড়িটি খুলে নিতে পারেননি। উনি দেননি। বলেছেন, “না, এইটা আমার সাথে থাকবে। মরতে হলে ক্লাবকে সাথে নিয়েই মরবো।“ ঘড়িটা উনার স্পেশাল সেভিয়া ঘড়ি। এজন্যে খুলতে দেননি।
মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানেন, সাধারন জনগন জানেন না যে একজন ফুটবলার তার জীবনের অন্যান্য মানুষ দিয়ে কি বিপুল মাত্রায় প্রভাবিত হয়। আমাদের যখন ইন্টারভিউ করা হয় তখন সবাই আমাদের ম্যানেজার নিয়ে, ট্যাকটিকস নিয়ে, ট্রেনিং নিয়ে জিজ্ঞাসা করে। মাঠের বাইরে আমাদের জীবনে কি চলছে তা নিয়ে সুস্থ প্রশ্নটা কেউ করেনা। আমার কাছে এই জীবনটাও ক্যারিয়ারের মতোই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছয় বছর সময়ের মধ্যে আমি সুইজারল্যান্ড থেকে জার্মানী থেকে স্পেন চলে এসেছি। মাঝে মাঝে খুব শক্ত একা সময় আমাকে কাটাতে হয়েছে। বাসেল বা শালকে'তেও আমি যথেষ্ট ভালো খেলেছি, ভাল খেলোয়াড় ছিলাম, তাও মনে হতো কি যেন নেই! কি যেন নেই! যখন আমার স্ত্রীর সাথে দেখা হলো, মনে হলো হ্যাঁ আমি ওর জন্যে খেলছি। আমার ক্যারিয়ার একেবারে অন্য একটা লেভেলে চলে গেলো। অন্য মাত্রায় উঠে গেল বলতে পারেন।
সেভিয়াতে আমার অসাধারণ কিছু স্মৃতি আছে। ২০১৩ সালে আমাকে ক্লাবের কাপ্তেন বানানো হলো। বিদেশী একজন সেভিয়ার কাপ্তেন হিসেবে আমিই এখন পর্যন্ত দ্বিতীয়। প্রথমজনের নাম হচ্ছে ম্যারাডোনা। আমার জন্যে বিশেষ একটা সন্মান, বিরাট একটা ব্যাপার। একবার ভেবে দেখুন, একজন মানুষ মৃত্যুশয্যায় যে ক্লাবের ঘড়ি খুলতে চায়নি সে ক্লাবের সাথে থাকবে বলে, আমি সেই ক্লাবটার কাপ্তেন। ভাবা যায়!
এই সময়টা ইতিহাসের কারনেও আমার জন্যে খুব গর্বের। আমারই ইতিহাস। আমার পরিবারের ইতিহাস। আমার বাবা মা এসেছেন ক্রোয়েশিয়া থেকে। সুইজারল্যান্ডে অভিবাসী হয়েছেন বসনিয়ান যুদ্ধের ঠিক আগ দিয়ে। কিভাবে যেন আমার বাবা মা সামনের বিপদটা টের পেয়ে গিয়েছিলেন। সুইজারল্যান্ডে আমি বড় হয়েছি কিন্তু বুকের ভেতর রবার্ট প্রোসিনেস্কি। রবার্ট প্রোসিনেস্কি ক্রোয়েশিয়ার হিরো বলতে পারেন। ফুটবল হিরো। রিয়াল মাদ্রিদে খেলেছেন, বার্সেলোনায় খেলেছেন এবং এই সেভিয়াতেও তিনি খেলেছিলেন। যখন তিনি সেভিয়াতে খেলেছিলেন তখন আমার বয়স খুবই কম। আমার কপাল ভালো যে আমি সুইজারল্যান্ডে আমার বন্ধুদের সাথে বড় হয়েছি। যুদ্ধের কোন আঁচ আমার গায়ে লাগেনি। কিন্তু অনেক লম্বা একটা সময় ধরে আমরা ক্রোয়েশিয়ায় যেতে পারিনি। আমার,আমাদের শিকড়ে ফিরতে পারিনি।
প্রথম যখন আমি ক্রোয়েশিয়ায় যাই আমার তখন বয়স ৭ বছর। গিয়েছিলাম আমার ঠাকুরদা-ঠাকুমাকে দেখতে। তাই ক্রোয়েশিয়া নিয়ে আমার আলাদা কোন স্মৃতি ছিল না ওই এক রবার্ট প্রোসিনেস্কি ছাড়া। প্রোসিনেস্কি আর আমাদের ফুটবলের জাতীয় দলটাই ছিলো আমার ক্রোয়েশিয়ার একমাত্র শেকল। বড় আদরের শেকল। আমার মা বড় হবার পর আমাকে একটা গল্প বলতেন। আমি যখন স্কুলে যেতে শুরু করি তখনকার ঘটনা। স্কুলে যাচ্ছি মাত্র তিন কি চারদিন। তো একদিন স্কুল থেকে এসে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'মা, আমি আর স্কুলে যেতে চাইনা। শুধু খেলতে চাই। আমাকে আর কতদিন স্কুলে যেতে হবে?' উত্তরঃ নয় বছর। 'আচ্ছা। নয় বছর? নয় বছরই যাবো, এর বেশি একদিনও না।' এরকমই ঘটনাটা।
যা হবার এভাবেই হয়েছে আরকি। ১৭ বছর বয়সে আমি বাসেল এ পেশাদার ফুটবলে খেলতে শুরু করেছি। আমার স্বপ্নটা ছিলো খুবই পরিস্কার। রবার্ট প্রোসিনেস্কি হতে হবে। তাঁর মতো স্পেনে খেলতে যেতে হবে। এর মাঝে সেভিয়ার কাপ্তেনগিরি আমার জন্যে বাড়তি পাওনা। আশা করিনি। বার্সেলোনা থেকে ২০১৪-তে যখন প্রথম অফার আসে তখন একটা অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারনা হয়েছিলো। আমার স্ত্রীর পরিবারের কেউই চায়নি আমি সেভিলা ছেড়ে আসি। আবার তারা এও জানতো বড় ক্লাব থেকে অফার দিনে দুতিনটা করে আসেনা। শেষে যা হলো তা হচ্ছে আমার উপর সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার ছেড়ে দেয়া হলো। আমি যাই করি তাতে পরিবারের সমর্থন নাকি থাকবে। সিদ্ধান্তটা নেয়া আমাদের জন্যে সত্যিই কঠিন ছিলো। বোঝাতে পারছি না আসলে ঠিক কিরকম কঠিন ছিলো। তারপর সেভিয়া ক্লাব থেকে জানানো হলো বার্সেলোনা আমার জন্য যে টাকাটা দেবে তাতে তারা আমাকে ছেড়ে দিতে রাজী আছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ সেভিয়া সাথে আমি সম্পর্কটা খারাপ করতে চাইনি। এই ক্লাবে এসেই আমার গোটা জীবনটা পালটে গেছে। আমার শ্বশুর বললেন, 'ওকে, গুডলাক। কিন্তু সেভিয়ার বিপক্ষে যখন তোমাদের খেলা হবে…তখন…'
প্রতিটা বাচ্চার স্বপ্ন বার্সেলোনায় খেলা। বার্সেলোনার জন্যে খেলা। প্রেজেন্টেশনের জন্যে যখন গেলাম, প্রথমে আমার ড্রেসিং রুম…আমার আলাদা লকার, লকারে আলাদা বুট। শিহরণে আমার শরীরের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলো। পরিস্কার মনে আছে আমার। এ কোন সাধারন বুট না, বার্সেলোনার বুট। আমার বার্সেলোনায় খেলার বুট।
ফুটবলার হিসেবে আপনি অবশ্যই ম্যাচ জিততে চাইবেন। শিরোপা জিততে চাইবেন। কিন্তু এই ক্লাবের একটা অংশ হতে পারাটা একেবারে আলাদা একটা বিষয়। অন্য সব বড় ক্লাবের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, অন্য যেকোন জায়গার চাইতে বার্সেলোনার জনগনের সাথে অনুভূতিটা আলাদা। বিশেষ এক অনুভূতি। প্লেমেকার হিসেবে আমার সৌভাগ্য, বিশ্বের সেরা আক্রমণভাগের সাথে আমি খেলি। মেসির কথাই বলি। সারা দুনিয়া খেলাটাতে ওর মেধা দেখে, প্রতিভা দেখে। কিন্তু বিশ্বাস করুন ট্রেইনিংয়ে ও যা করে তা খেলার মাঠের চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি। ফুটবলের একনিষ্ঠ দর্শক হিসেবে এই খেলাটা দেখতে পারাটাও আনন্দের। ওর সাথে প্রতিদিন মাঠে নেমে খেলছি, ফুটবলের পাঁড় সমর্থক হিসেবে এটা আমার সৌভাগ্য।
শুধু মেসি না- নেইমার, জাভি, সুয়ারেজ, ইনিয়েস্তা, পিকে এরাও আছে। আমরা একটা ছন্দে খেলতে চেষ্টা করি। প্লে বাটন টেপার সাথে সাথে যেমন কোন যন্ত্রের সবগুলো অংশ জানে কখন তার কি করতে হবে, অনেকটা সেরকম। আমরা জানি কখন আমাদের কোথায় থাকতে হবে এবং কি করতে হবে। জিনিসটা টিভিতে দেখা বা গ্যালারীতে বসে দেখা বা আমাদের বিপক্ষে খেলতে নেমে দেখা আর নিজে সে অভিজ্ঞতাটা পাওয়া একেবারে আলাদা একটা বিষয়। বার্সেলোনার মধ্যে যদি কেউ ফুটবলটা উপভোগ না করে, তাহলে সেই মানুষটা আসলে ফুটবলটাকেই উপভোগ করেনা। ফুটবল নিয়ে থাকলে প্রতিটা দিনই আমার জন্যে উপভোগ্য। আমি তখন প্রতিটা দিনই উপভোগ করি। যখন এখানে এলাম তখন অনেকেই আমার স্প্যানিশ শুনে অবাক হয়েছিলো। তাও আবার সেভিয়ার উচ্চারণে স্প্যানিশ! আমার এই ভাষাটাই বার্সেলোনায় ড্রেসিংরুমে আমাকে দ্রুত মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। ড্রেসিংরুমের পরিবেশ বুঝতে সাহায্য করেছে। এর কৃতিত্ব পুরোটাই আমার স্ত্রীর। ওর কারণেই আমি টারজান থেকে সেভিয়া কাপ্তেন হয়ে বার্সায় চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছি!
আমার বড় মেয়েটার বয়স এখন চার বছর। এই বয়সেই ও বুঝে গেছে বার্সেলোনায় লোকজন ফুটবলটাকে কত সিরিয়াসলি নেয়। আমরা বোঝার চেষ্টা করছি মেয়েটা আমার মতো ফুটবল অন্তপ্রাণ হবে, না ওর মায়ের মতো হবে। এই মুহুর্তে বেচারি আছে মাঝামাঝি একটা অবস্থায়। ধরুন আমি বাড়িতে নেই, ও টিভিতে খেলা দেখছে। কেউ ধরুন গোল করে ফেললো, ওর সেটা পছন্দ হয় না। রীতিমতো ক্ষেপেই যায়। ওর কথা হচ্ছে গোলটা বাবাকেই করতে হবে। গোলটা মেসি বা সুয়ারেজ যেই-ই দিক, তাতে হবে না। বাবাকেই গোল দিতে হবে। দেখি মেসির সাথে কথাটথা বলে, কিছু করা যায় কিনা! এই নিয়েই আছি...
মূল: প্লেয়ার্স ট্রিবিউন