হারশাদ মেহতা যখন লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছেন ভারতের অর্থনীতিকে, রাকেশ তখন সামান্য এক দর্শক। হারশাদের পতনের পরে তিনি এলেন লাইমলাইটে। ঠান্ডা মেজাজে আস্তে আস্তে দখল করলেন দালাল স্ট্রিটের পুরোটাই। হয়ে গেলেন ভারতের ওয়ারেন বাফেট...

'স্টক মার্কেট কেলেঙ্কারি' নিয়ে কথা বলতে গেলে সেখানে লতায়পাতায় জড়িয়ে চলে আসে আরেকটি নাম; হারশাদ মেহতা। টিভি সিরিজ, প্রিন্ট মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়া... সবখানে হারশাদ মেহতা'কে নিয়ে ইদানীংকালে এত কথাবার্তা হয়েছে যে, এখন তাকে নিয়ে আবার কিছু বললে চর্বিতচর্বন হয়ে যাবে। মাছ-মাংস অনেকক্ষণ খেলে যখন একঘেয়ে লাগে, তখন বোরহানি, তরল পানীয় বা সালাদ খেয়ে মুখটা একটু ঠিক করে নিতে হয়। আজকে তাই হারশাদ মেহতা নয়, আজ কথা হবে রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালাকে নিয়ে, হারশাদ মেহতার পরে যিনি হয়েছিলেন দালাল স্ট্রিটের 'বিগ বুল।' হারশাদের মতন তার গল্প অত ইন্টারেস্টিং না হলেও, বৈচিত্র‍্যও খুব একটা কম নেই।

'স্ক্যাম ১৯৯২ঃ দ্য হারশাদ মেহতা স্টোরি'তেও দেখা গিয়েছিলো রাকেশকে। যদিও আলাদা করে কেউ তাকে মনে রেখেছে বলে মনে হয় না। তবে যদি কেউ মনে করতে চান, তাদের মস্তিষ্কে একটু গুঁতো দিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। শেয়ার মার্কেটের ব্ল্যাক কোবরা 'মানু মানেক'কে মনে আছে? যার মুখ দিয়ে স্রোতের মতন অবিরল ধারায় গালিগালাজ বের হয়ে আসতো? যদি ব্ল্যাক কোবরাকে মনে পড়ে থাকে, তাহলে তার তিন সাগরেদকেও মনে পড়ার কথা। তাদের মধ্যে একজন বেশ মোটাসোটা, গোলগাল। ফর্সা চেহারা। চোখে চশমা। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।

যদি চিনতে পেরে থাকেন, তাহলে আপনার সুবিধের জন্যে বলি, তিনিই রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা। এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন 'কেভিন ডেইভ।' যদিও সিরিজে খুব বেশি স্ক্রিনটাইম পাননি তিনি৷ তবে রিয়েল লাইফে হারশাদ মেহতার পরে রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার স্ক্রিনটাইম যে সবচেয়ে বেশি, তা সংশ্লিষ্টরা জানেন৷ যিনি ভারতের 'ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট'কে নিয়ে গিয়েছেন অন্য উচ্চতায়। যাকে ডাকা হয় ভারতের 'ওয়ারেন বাফেট' নামেও।

বাস্তবের রাকেশ ও পর্দার রাকেশ! 

রাকেশের জন্ম হায়দ্রাবাদে। বাবা ছিলেন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। একারণেই হয়তো টাকাপয়সা, শেয়ার নিয়ে রাকেশের ছোটবেলা থেকে ছিলো ব্যাপক আগ্রহ। কলেজে পড়ার সময় থেকেই সে স্টক মার্কেটে ইনভেস্ট করা শুরু করে। এরপরে পেশাগত জীবনে এসে তিনি হন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন চাকরীজীবন এর একেবারে শুরুতেই।

যখন হারশাদ মেহতা তোলপাড় করছেন স্টক মার্কেটে, তখন রাকেশ নেহায়েতই চুনোপুঁটি। শেয়ার মার্কেট থেকে তখন তিনি আয় করেছেন মাত্র বিশ-পঁচিশ লাখ রূপি। কাজ করছেন রাধাকৃষ্ণ দামানির সাথে (তাকেও সবাই দেখেছেন টিভি সিরিজে, মানু মানেকের দ্বিতীয় সাগরেদ, মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক)। এরপরে হারশাদ মেহতা'র পতনে যখন কেঁপে উঠেছে পুরো স্টক মার্কেট, শুরু হয় এক বিশাল শূন্যতা। তখন রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা ঢুকে পড়েন স্টক মার্কেটের লড়াইক্ষেত্রে। তিনি টাইটান, ক্রিসিল, অরবিন্দ ফার্মা, প্রাজ ইন্ডাস্ট্রিজ এর মতন নামীদামী প্রতিষ্ঠানে ইনভেস্ট করেন। এবং খুব অল্প দিনেই উঠে আসেন লাইমলাইটে। 'হারশাদ মেহতা' ছিলো রাকেশের টার্গেট, স্বপ্ন। সেটা তিনি অনেক জায়গায় বলেছেনও। হারশাদ মেহতা হওয়ার জন্যেই তিনি কাজ করেছেন। পাগলের মত ইনভেস্ট করে গিয়েছেন আশেপাশে।

হারশাদ মেহতা'ই ছিলেন রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার ইন্সপিরেশন 

হারশাদ মেহতাকে 'স্বপ্ন' মানলেও হারশাদের ভুলগুলো তিনি না করার চেষ্টা করেছিলেন বিজনেসের পুরোটা সময়ে। তাছাড়া হারশাদের কেলেঙ্কারি যখন ফাঁস হয় গোটা ভারতে, হারশাদকে গ্রেফতারের পরে গোয়েন্দাদের চোখ ছিলো রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা'সহ আরো অনেকের ওপরেই। তাই খুব অল্পবয়সেই আক্কেলদাঁত গজিয়ে যায় রাকেশের। সে নিজের গণ্ডি বুঝে এগোনো শুরু করে। যার সুফল এখন পাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি বিজনেস টুডে'র এক রিপোর্টে আসে, রাকেশ শুধুমাত্র এক কোম্পানি থেকেই প্রতিদিন ৫.৫৬ কোটি রূপি আয় করছেন গত মার্চ মাস থেকে। মহামারী করোনার মধ্যেও যিনি আয় করেছেন ১৪০০ কোটি রূপি! তবে স্বার্থপরের মত তিনি যে 'টাকার কুমির' হয়ে বসে থাকছেন, বিষয়টি মোটেও সেরকম না। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামী বছরের জুলাইয়ের মধ্যে তিনি তার সম্পদের ২৫ শতাংশ দান করে দেবেন জনকল্যাণমুখী কাজে।

ফোর্বস জানাচ্ছে, ২০২০ সালে ভারতের ৫৪তম ধনী হিসেবে তালিকায় আছেন রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা৷ তবে এই পুরো যাত্রাপথে তিনি দেখেছেন নানারকম উত্থান-পতন। চোখের সামনে দেখেছেন শূন্য থেকে আকাশে উঠতে থাকা হারশাদকে। যে হারশাদ আকাশে উঠতে গিয়ে মাঝপথ থেকেই আবার মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছে, চোখের সামনেই। ক্যালকুলেটিভ রিস্ক নিয়ে, ইনভেস্ট করে, বুঝেশুনে খেলে এরপরেই রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার আবির্ভাব, বিগশট হয়ে ওঠা, এবং দালাল স্ট্রিটের 'বিগ বুল' হয়ে ওঠা। তিনি ধীরে খেলেছেন। ডাউন দ্য উইকেটে সিক্স মারেননি মোটেও, গালি দিয়ে কনুইয়ের মোচড়ে ব্যাটের খোঁচায় বাউন্ডারিও যেমন মেরেছেন, আবার বাউন্সারে নিজেকে সামলেও নিয়েছেন।  এভাবেই তিনি টিকে গিয়েছেন। হয়ে গিয়েছেন 'লম্বা রেসের ঘোড়া।'

এবং রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার কথা ভেবেই হয়তো এসেছে এই প্রবাদ -

Slow & steady wins the race.

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা