করোনার সঙ্গে পাঁচ মাসের ম্যারাথন লড়াই: মিরাকলের জন্ম দিলেন যে বাংলাদেশী যুবক!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

আড়াই মাস তিনি কাটিয়েছেন আইসিইউতে, মোট পাঁচ মাস হাসপাতালে। অচেতন থাকার সময়টায় দেশে জন্ম নিয়েছে তার সন্তান, ছেলের মুখটা দেখবেন বলেই হয়তো কয়েকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার অবিশ্বাস্য এই গল্পটা লিখেছেন রাজু সরকার...
আড়াই মাস আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন তিনি, কয়েক দফা মৃত্যুর মুখে চলে গিয়েছিলেন। ডাক্তারেরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্ত হাল ছাড়েননি। লড়াইটা বন্ধ করেননি রাজু সরকার নিজেও। হয়তো যমদূত শিয়রে এসে দাঁড়ালেই রাজুর মনে পড়তো কিছুদিন আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের কথা, যার মুখটা তিনি তখনও দেখেননি। কে জানে, নিজের ঔরসজাতকে একটিবার দেখার প্রাণান্ত ইচ্ছেশক্তিই হয়তো তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। রহস্যটা আমরা জানিনা, আমরা জানি বাস্তবতা। আর সেই বাস্তবতা বলছে, দীর্ঘ পাঁচ মাস হাসপাতালে কাটিয়ে করোনার সঙ্গে লড়াই শেষ করে সুস্থ হবার পথে হাঁটছেন সিঙ্গাপুরের প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিক রাজু সরকার।
রাজুর এই ফিরে আসার গল্পটাকে ডাক্তারেরা বলছেন মিরাকল। কারণ রাজুর অবস্থা ছিল গুরুতর, করোনা ছাড়াও কয়েক রকমের শারীরিক জটিলতার কারণে কয়েক দফা তার অবস্থা প্রচণ্ড খারাপের দিকে গিয়েছিল। একাধিকবার ডাক্তারেরা ভেবেছেন, লড়াইটা বুঝি শেষ হয়ে গেল! তবুও হাল।না ছেড়ে প্রাণান্ত চেষ্টা করে গেছেন তারা, অন্য পাশ থেকে লড়েছেন রাজুও। প্রতিবারই জয় হয়েছে এই জুটির, যমদূত সুবিধা করতে না পেরে ফিরে গেছে ব্যর্থ মনোরথে।
৩৯ বছর বয়স্ক রাজু সরকার সিঙ্গাপুরে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। সেদেশে প্রথম যে কয়েকজন বিদেশি কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন রাজু তাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন সিঙ্গাপুরের ৪২তম করোনা রোগী। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। ভর্তি হবার সময় রাজু জানতেন না, আগামী পাঁচটা মাস তাকে কাটাতে হবে এখানে, যমে মানুষে টানাটানি হবে তাকে নিয়ে, প্রাণ সংশয়ে পড়বেন তিনি। তার জন্য ভীনদেশী ডাক্তাররা নিজেদের উজাড় করে দিয়ে অসম্ভব একটা যুদ্ধে নামবেন, সেটা হয়তো কল্পনাতেও ছিল না সংসার চালানোর জন্য দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে যাওয়া রাজুর।
সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যম স্ট্রেইট টাইমস একটা বড়সড় প্রতিবেদন করেছে রাজুর এই করোনাজয় নিয়ে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে পুরো জার্নির আদ্যোপান্ত। ফেব্রুয়ারীতে রাজু যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, দেশে রাজুর স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। সন্তানের মুখ দেখতে ছুটি নিয়ে দেশে আসবেন, এমন পরিকল্পনা ছিল রাজুর। ছুটির কথাও বলে রেখেছিলেন নিজের অফিসে।
কিন্ত নিয়তি অন্যরকম গল্প সাজিয়ে রেখেছিল রাজুর জন্য। করোনায় আক্রান্ত হলেন তিনি, শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় ভর্তি হতে হলো হাসপাতালে, সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে নেয়া হলো আইসিইউতে। সেই আইসিইউতে রাজু কাটালেন টানা আড়াই মাস! এরই মাঝে মার্চের ত্রিশ তারিখে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন রাজুর স্ত্রী, কিন্ত সেই খবর রাজুকে জানানোর উপায় ছিল না। আইসিইউ'র বেডে শুয়ে অর্ধচেতন অবস্থায় তিনি তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।

টিটিএস হাসপাতালের রেসপিরেটরি এন্ড ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. বেনজামিন হো বলছিলেন, "প্রথম যখন রাজু সরকারকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তখন তিনি খুবই অসুস্থ ছিলেন। অন্তত দুই থেকে তিনবার তিনি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন, আমরা ভেবেছি, সব চেষ্টা বুঝি বিফলে গেল! রাজুর রক্তচাপ খুবই কমে গিয়েছিল, অক্সিজেনের মাত্রাও একদম কম ছিল। আমরা ভেবেছিলাম তার দীর্ঘমেয়াদী অক্সিজেন সাপোর্ট লাগবে। আমাদের ভয় ছিল তিনি হয়তো সিঙ্গাপুরে একদম শুরুর দিকের মৃতদের মধ্যে একজন হতে যাচ্ছেন।"
রাজুকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় তার যে ওজন ছিল, আড়াই মাস পর আইসিইউ থেকে বের করার সময় দেখা গেল চব্বিশ কেজি ওজন হারিয়েছেন তিনি! করোনার প্রভাবে কি পরিমান ধকল তার শরীরের ওপর দিয়ে গেছে, সেটা এতেই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। তবে করোনার এমন সর্বগ্রাসী আক্রমণের পরও রাজু হার মানেননি। লড়াই করেছেন সর্বশক্তি দিয়ে। তার জীবনীশক্তির প্রশংসা করেছেন চিকিৎসকেরাও।
হাসপাতালের ফিজিওথেরাপিস্ট সিমন লাউ খুব কাছ থেকে দেখেছেন রাজুর এই লড়াইটা, তিনি বিভিন্ন শারীরিক ব্যায়ামে রাজু সরকারকে সাহায্যও করেছেন। লাউ জানালেন, “ওর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আইসিইউতে দীর্ঘ দিন থাকার কারণে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল সে। তবে সুস্থ হয়ে উঠতে ও নিজেই খুব আন্তরিক ছিল, যেভাবে তাকে বলা হয়েছে, সব নিয়ম মেনে চলেছে। জীবনের প্রতি অদ্ভুত একটা মায়া জন্ম নিয়েছিল ওর মধ্যে, ব্যায়ামের জন্য বলতে হতো না, নিজে থেকেই করতো সব। সেরে ওঠার চেষ্টাটা পুরোপুরি ছিল তার, সম্ভবত এটাই তাকে যুদ্ধে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে।”
দীর্ঘ এই সময়ে হাসপাতালের নার্সরাও রাজুর আপন হয়ে গিয়েছেন, রাজুর সঙ্গে এই যুদ্ধে তো তারাও সঙ্গ দিয়েছেন। চেতনা ফেরার পর আইসিইউ থেকে যখন কেবিনে নেয়া হলো রাজুকে, তখন নার্সরাই তাকে প্রথম ভিডিওকলে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন, নিজের সন্তানকে সেখানেই দেখেছেন রাজু। সিনিয়র স্টাফ নার্স কারমেইন লো বলছিলেন, সুস্থ হয়ে উঠতে রাজুর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল তার পরিবার। আইসিইউ থেকে ছাড়া পাওয়ার এক সপ্তাহ পর মধ্য এপ্রিলে প্রথম ভিডিও কলে ছেলেকে দেখেছেন রাজু সরকার।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন রাজু, তবে এখনও তাকে পুরোপুরি সুস্থ বলা যাবে না। করোনাভাইরাস রাজুর শরীরের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে, শরীরে লবণ ও ম্যাগনেসিয়ামের মাত্রা কমে গেছে, হৃদযন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফুসফুস, থাইরয়েড ও কিডনি জটিলতাও দেখা দিয়েছে। কিডনি সচল রাখার জন্য বাকী জীবন তাকে সাময়িকভাবে ডায়ালাইসিস করে যেতে হবে। দীর্ঘ সময় আইসিইউতে থাকায় তার মস্তিষ্কেও পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তবে এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলেই জানিয়েছেন ডাক্তাররা। এখনও সেরে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন তিনি।
হাসপাতাল থেকে রিলিজ হবার সময় রাজুর আনন্দিত মুখের ছবি ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। বৃদ্ধাঙ্গুলি উঁচিয়ে থামস আপ সাইন দেখিয়ে তিনি দ্যা স্ট্রেইট টাইমসকে জানিয়েছেন, এখন সবার আগে তিনি যা করতে চান তা হলো খাসির মাংসের তরকারি খাওয়া। রাজু বলেছেন, ছেলেকে দেখার জন্য তার তর সইছে না, নিজে সুস্থ হয়ে উঠলে, এবং করোনা পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই দেশে ফিরে আসবেন তিনি। তবে ডাক্তাররা তাকে আগামী দুইমাস ফলোআপে রাখবেন, নিয়মিত চেকআপের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তাকে।
মৃত্যুর কাছে হার না মানার অদম্য মানসিক জোর আর ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা রাজুকে ফিরিয়ে এনেছে মৃত্যুর মুখ থেকে, রাজু পেয়েছেন দ্বিতীয় জীবন। পাঁচ মাসের দীর্ঘ লড়াই শেষে করোনাকে হারিয়ে রাজুর এই ফিরে আসার গল্পটাকে তাই মিরাকল বললেও কম হয়ে যায়। আর এই গল্পের রচয়িতা একজন বঙ্গসন্তান- এটা ভাবলে জয়ের আনন্দটা বেড়ে যায় বহুগুণে...