প্রবাসে হাজারটা কষ্টের মাঝেও রাজীবরা সততা বিসর্জন দেন না...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

প্রবাসে হাজারটা কষ্টের মধ্যেও রাজীবেরা সততা বিসর্জন দেন না, তাদের কীর্তিতে বাংলাদেশের নামটা উজ্জ্বল হয়, সবুজ রঙের ওই পাসপোর্টটার প্রশংসা বাড়ে। রাজীবের মতো মানুষদের নিয়ে গর্ব তো করাই যায়।
রহমতউল্লাহ রাজীবের বাড়ি শরীয়তপুরে, জীবিকার অন্বেষণে তিনি সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমিয়েছিলেন নয় বছর আগে। সেখানকার টাউন কাউন্সিলে চাকরি করেন তিনি। রোজকার জীবনে কোন নতুনত্ব নেই, দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে আপনজন ছেড়ে প্রবাস জীবনের ঘানি টেনেই দিন কাটতো রাজীবের। মাস কয়েক আগে হুট করেই সেই নিস্তরঙ্গ জীবনে আলোড়ন তুললো একটা ঘটনা।
কয়েক মাস আগে অফিসের কার পার্কিংয়ে একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে পান রাজীব, ব্যাগ খুলে দেখলেন, সেখানে দশ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার রাখা আছে। বাংলাদেশী টাকায় যেটার পরিমাণ প্রায় ছয় লক্ষ টাকা। এরকম কিছু হুট করে পেয়ে গেলে শতকরা ৯৯ জন মানুষই লোভে পড়ে ব্যাগটা সরিয়ে ফেলবে। রাজীব সেটা করলেন না। সেই কার পার্কিংয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন, কেউ মানিব্যাগটা ফেরত নিতে আসে কিনা সেজন্যে। কিন্ত কেউই এলো না সেদিন।
অফিসের বসকে জানালেন সবকিছু, বস তাকে পরামর্শ দিলেন ব্যাগটা নিজের কাছেই রেখে দেয়ার জন্যে। ব্যাগের আসল মালিক যদি খুঁজতে আসে, তখন তাকে সেটা বুঝিয়ে দেয়া যাবে। ব্যাগটা নিয়ে বাসায় ফিরলেন রাজীব, শুরু হলো অস্থিরতার সঙ্গে তার নিত্য বসবাস। সারাক্ষণ মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকেন, কেউ ফোন করলো কিনা সেটা দেখার জন্যে।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলেও ফোন চেক করেন, বসের ফোন এসেছে কিনা দেখেন। কারণ ব্যাগের মালিক ব্যাগ খুঁজতে গেলে অফিসেই আসবে, আর বস তখন তাকে ফোন দেবেন। কিন্ত কারো ফোন আর আসে না। আর যদি অফিসে না আসে তাহলেও তো কার পার্কিংয়ে তাকে আসতেই হবে- এই ভেবে তিনি প্রতিদিন অফিস টাইম শেষ হবার পরে পার্কিংয়ে বসে থাকেন। কিন্ত কারো খোঁজ পাওয়া গেল না।
রাজীবের কাণ্ডকীর্তি দেখে তার বস অবাক হলেন, বললেন- ‘এতগুলো টাকা তুমি কেন ফেরত দিতে চাও? নিজের কাছেই রেখে দাও৷’ কিন্তু রাজীব নাছোড়বান্দা। তিনি মালিকের কাছে টাকা ফেরত দিতে বদ্ধপরিকর৷ অফিসের বস শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে হাজির হলেন। পুরো কাহিনী শুনে পুলিশ কর্মকর্তা বললেন,
‘আমার কর্মজীবনে এই প্রথম কাউকে দেখছি এতগুলো টাকা ফেরত দিতে। তোমার দশ মাসের বেতন এটা। এই টাকা দেশে পাঠিয়ে তুমি কিছু করতে পারতে। কিন্তু তুমি তা না করে ফেরত দিতে এসেছো! তোমার সততাকে স্যালুট জানাই।’
মানিব্যাগে থাকা পরিচয়পত্র থেকে টাকার মালিকের নাম্বার বের কল দিলেন, কিন্তু কেউ সেই কল রিসিভ করলো না। দ্বিতীয় নাম্বারে কল দেয়ার পর একজন মহিলা কল রিসিভ করে বললেন, তিনি টাকার মালিকের বোন। পুলিশের কাছে পুরো ঘটনাটা শুনে ওই নারী কেঁদে ফেললেন। তিনি জানালেন, এই টাকা তার ভাই সংগ্রহ করেছিল তার মায়ের চিকিৎসা করানোর জন্য।
ভদ্রমহিলা আরও জানালেন, টাকা হারানোর পর ভাই তারর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। ভাই ভেবেছে তার বোন টাকাটা চুরি করেছেন! শুধু এই টাকার জন্য ভাই-বোন একে অপরের শত্রু হয়ে গেছেন। ওই মহিলাকে বলা হলো, তার ভাই যেন পরদিন পুলিশ স্টেশনে এসে মানিব্যাগটা বুঝে নেন।
পর দিন টাকার মালিক পুলিশ স্টেশনে এলেন, মানিব্যাগটা সংগ্রহ করে রাজীবের বসকে কল করলেন। রাজীবের বস রাজীবকে সঙ্গে করে পুলিশ স্টেশন হাজির হলেন সঙ্গে সঙ্গেই। টাকার মালিক চারশ ডলার পুরস্কার দিলেন রাজীবকে। রাজীবের সততার পুরস্কার হিসেবে টাউন কাউন্সিলের পক্ষ থেকে তাকে দেয়া হলো ‘সততার সার্টিফিকেট।
রাজীব যে টাকাটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, সেটার অঙ্ক নেহায়েত কম ছিল না। তার যা বেতন, সেই তুলনায় ছয় লাখ টাকা অনেক বেশি। কিন্ত লোভের কাছে হার না মেনে তিনি বিজয়ী করেছেন সততাকে। রাজীব বলছিলেন- “ভাই, টাকা পয়সা আজ আছে কাল নেই৷ কিন্তু আমি এই যে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারলাম এটাই আমার জীবনের সেরা অর্জন। আমি মানুষের জন্য কাজ করতে চাই, অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। কিন্তু কোন প্লাটফর্ম পাচ্ছি না।”
প্রবাসে হাজারটা কষ্টের মধ্যেও রাজীবেরা সততা বিসর্জন দেন না, তাদের কীর্তিতে বাংলাদেশের নামটা উজ্জ্বল হয়, সবুজ রঙের ওই পাসপোর্টটার প্রশংসা বাড়ে। রাজীবের মতো মানুষদের নিয়ে গর্ব তো করাই যায়।