রাষ্ট্র, আপনারা বরং আইন করে দিন, প্রত্যেক নাগরিককে দশ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে চলতে হবে। আকবরের মতো পুলিশরা ধরলেই যাতে টাকাটা বের করে দিয়ে মুক্তি পাওয়া যায়, রায়হানের মতো মরে যাতে যেতে না হয় কাউকে...
রায়হান উদ্দিন নামের যে তরুণটিকে গতকাল ভোরে মেরে ফেলা হয়েছে, তিনি সিলেট শহরের একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করতেন। দুই মাস বয়সী এক সন্তানের বাবা তিনি। ভোররাতে মায়ের নাম্বারর ফোন করে রায়হান আকুতি জানিয়েছিল, "দশ হাজার টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসো, আমাকে বাঁচাও!" রায়হান বাঁচতে পারেনি, বা তাকে বাঁচতে দেয়া হয়নি। পুলিশি হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের পর মৃত্যু হয়েছে তার, সেই মৃত্যুর খবরটাও তার পরিবার জানতে পেরেছে রায়হান মারা যাওয়ার ঘন্টা তিনেক পর।
গত শনিবার রাতে বাসায় না ফেরায় রায়হানকে খোঁজাখুঁজি করেন পরিবারের সদস্যরা। রোববার ভোরে রায়হানের পরিবারের সদস্যদের কাছে বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে ফোনে জানানো হয়, রায়হান পুলিশ হেফাজতে আছেন। তাকে ছাড়িয়ে নিতে হলে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। ৫০০০ টাকা নিয়ে রায়হানের চাচা পুলিশ ফাঁড়িতে যান, কিন্ত রায়হানের দেখা পাননি। তাকে সকাল দশটায় ফাঁড়িতে যেতে বলা হয়। সকালে যাওয়ার পরে তারা জানতে পারেন, রায়হান ভোরে মারা গেছেন। পুলিশ বলেছে, নগরীর কাষ্টঘর এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ধরা পড়ে গণপিটুনিতে রায়হান আহত হন। পরে তিনি মারা যান।
কিন্ত রায়হান যেদিন গ্রেপ্তার হন (১০ই অক্টোবর) সেদিন কোতোয়ালি থানাধীন কাষ্টঘর এলাকায় কোনও ছিনতাই কিংবা গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেনি। পুলিশ যে স্থানের কথা বলেছে, সেখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেই সিসিটিভির ফুটেজে এমন কোন ঘটনা নেই। কাষ্টঘর এলাকার বাসিন্দারাও বলছেন, ছিনতাই বা গণপিটুনির কোন ঘটনা সেদিন এই এলাকায় ঘটেনি। তাহলে রায়হানকে মারলো কারা? নখ উপড়ে নিলো কে? কাদের নির্যাতনে রায়হান অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে মারা গেলেন?
রায়হান আটক হয়েছিলেন দশ তারিখ বিকেলে। পরিবারের কাছে টাকা নিয়ে আসার জন্য তিনি ফোন করেছেন ভোররাতে। মাঝের এই দীর্ঘ সময়টায় তিনি ছিলেন পুলিশ ফাঁড়িতে। গণপিটুনির শিকার একজন 'ছিনতাইকারী'কে হাসপাতালে ভর্তি না করে পুলিশ কেন ফাঁড়িতে নিয়ে রাখলো? রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহকে পুলিশ জানিয়েছে, ভোররাতে রায়হানের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে তাকে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়, সকাল আটটার দিকে সেখানেই তিনি মারা যান। বিকেল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত পুরো সময়টা রায়হান পুলিশের জিম্মায় ছিলেন। তার শরীরের আঘাতগুলো কাদের তৈরি করা, সেটা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়।
রায়হানের স্ত্রী তার করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, “আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন।” এই 'কে বা কারা' নামক দুর্বৃত্তগুলো আসলে কে, এটা জানার আগ্রহ হচ্ছে। বাংলাদেশের একটা পুলিশ ফাঁড়ির ভেতরে নিশ্চয়ই 'র', 'আইএসআই' বা 'মোসাদে'র এজেন্টরা এসে একজন মানুষকে পিটিয়ে খুন করে যাবে না। পুলিশ ফাঁড়ির নিয়ন্ত্রণ যারা করে, তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। গ্রামের মহিলারা ভাসুরের নাম মুখে নেয় না, এই মামলার এজাহারেও সেভাবে পুলিশের নাম না নিয়ে 'কে বা কারা' হিসেবেই খুনীদের চিহ্নিত করা হয়েছে।
সিলেট পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তারাও শুরুতে অভিযোগ আমলে নিতে চাননি, রায়হান গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন বলে বক্তব্য ছিল তাদেরও। পরে যখন সিসিটিভি ফুটেজ বা গণপিটুনি নিয়ে এলাকার লোকজনের বক্তব্য জানানো হয়েছে তাদের, তখন তারা নড়েচড়ে বসেছেন। প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে সোমবার বিকেলে ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ছবিতে যে পুলিশ অফিসারটিকে দেখতে পাচ্ছেন, তিনিই এসআই আকবর, রায়হানকে গ্রেপ্তার করেছিল এই লোকই।
রাষ্ট্রের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের মহোৎসব থেকে মুক্তি মিলবে কবে? মেজর সিনহা হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপ বা এসআই লিয়াকতেরা গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেছে, কিন্ত তার সাগরেদ এস আই আকবরেরা যে ছড়িয়ে আছে সারা দেশজুড়ে, তাদের খোঁজ কে নেবে? গ্রেপ্তার করে পুলিশি হেফাজতে এনে টাকার জন্য পিটিয়ে মেরে ফেলাটা তো কিডন্যাপিংয়ের চেয়েও ভয়ানক। অপহরণকারীর বিরুদ্ধে আপনি পুলিশের কাছে যেতে পারবেন, আইনের সাহায্য নিতে পারবেন, কিন্ত খোদ পুলিশই যখন উর্দি পরে অপহরণে নেমে যায়, দশ হাজার টাকার জন্য তরতাজা একটা প্রাণকে রাতের আঁধারে পিটিয়ে মেরে ফেলে, তারপর গণপিটুনিতে মৃত বলে চালিয়ে দিতে চায়- তখন আমাদের যাওয়ার জায়গাটা কোথায়, বলতে পারেন?
এরচেয়ে বরং আইন করে দেয়া হোক, প্রত্যেক নাগরিককে দশ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে চলতে হবে। আকবরের মতো পুলিশরা ধরলেই যাতে টাকাটা বের করে দিয়ে মুক্তি পাওয়া যায়। টাকার অপেক্ষায় মার খেতে খেতে যেন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে না হয় আর কোন রায়হানকে। দশ হাজার টাকায় যদি এসব পুলিশের অত্যাচার থেকে বাঁচার আর জীবনের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়, সেই আবদার আমরা হাসিমুখে মানতে রাজী আছি...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন