রায়হানের সঙ্গে মালয়েশিয়া যা করছে, একজন ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে সেটা করার সাহস পেতো দেশটা? সেরকম কিছু হলে সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, হাইকমিশন- সবাই আদাজল খেয়ে নেমে পড়তো তাদের দেশের নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে...

রায়হান কবীরের বন্ধু হৃদয়কে ধরে নিয়ে গিয়েছিল মালয়েশিয়ান পুলিশ, আটকে রেখেছিল ডিটেনশান সেন্টারে। আল জাজিরার কয়েকজন সাংবাদিক তখন একটা প্রতিবেদন তৈরী করছিলেন, অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের নির্যাতনের ব্যাপারে। বন্ধুর খোঁজ করতে যাওয়া রায়হানের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তারা, রায়হানও তাদের জানিয়েছিলেন, সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও কিভাবে মালয়েশিয়ান পুলিশ নানা অজুহাতে নির্যাতন চালায় তাদের ওপর। 

আল জাজিরার পঁচিশ মিনিটের সেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটা প্রকাশিত হবার পরপরই যেন মৌমাছির চাকে ঢিল পড়েছে। নগ্ন একটা সত্য, যেটা এতদিন সবাই জানতো, কিন্ত মুখ ফুটে কেউ বলতো না, সেটা প্রকাশের পরপরই মালয়েশিয়ান সরকারের গায়ে যেন আগুন ধরে গেল। হন্যে হয়ে তারা এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে রায়হান কবীরকে, মালয়েশিয়ার মোস্ট ওয়ান্টেড 'ক্রিমিনাল' এখন এই বাংলাদেশী তরুণ। তার ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করেছে মালয়েশিয়া। তাকে এখন গ্রেপ্তার ধরে দেশে পাঠিয়ে দিতে চায় দেশটি।

পেপার-পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হচ্ছে রায়হানের ছবি, সেদেশের পুলিশ আদাজল খেয়ে নেমেছে রায়হানকে গ্রেফতার করার জন্য। যেভাবে রায়হানের খোঁজে নেমেছে মালয়েশিয়ার সরকার, মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এই তরুণ বুঝি কয়েকশো মানুষকে খুনের দায়ে ফেরারী হয়ে আছেন! অথচ রায়হান কোন অপরাধই করেননি, তিনি কেবল সত্যি কথাটা বলেছিলেন, তাদের ওপর হওয়া অমানবিক আচরণের বর্ণনা দিয়েছিলেন আল জাজিরার ক্যামেরার সামনে। 

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা আজ নতুন ঘটছে না। ব্র‍্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান তার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের একটা বড় সময়জুড়ে মালয়েশিয়া প্রবাসীদের দুরবস্থা নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি লিখেছেন- 

"সাংবাদিক হিসেবে মালয়েশিয়া প্রবাসীদের দুরবস্থা নিয়ে গতে একযুগে অনেক কাজ করতে হয়েছে। এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ মালয়েশিয়া। রাস্তার দুই পাশে আকাশছোঁয়া সব অট্টালিকা, অসংখ্য ফ্লাইওভার, প্রশস্ত সব সড়ক দেখে মুগ্ধ হতে হয়। কিন্তু এমন একটি দেশে অধিকাংশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের দাসের মতো জীবন কাটাতে হয়। যতোবার মালয়েশিয়ায় কাজ করতে গিয়েছে সবসময় শুনতে হয়েছে বিপুল পরিমান লোকের কাগেজপত্র ঠিক নেই। এর একটা বড় কারণ নিয়োগকর্তারা সেগুলো যথাসময়ে করেন না। আবার অনেকে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে থাকেন। ফলে এই বাংলাদেশিদের সবসময় পুলিশের ভয়ে থাকতে হয়। ভয়ে বাড়ি থেকে লাফ দিয়ে অনেকের হাত-পাও ভেঙেছে।

গরু-ছাগলের মতো শেকল দিয়ে টানা হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের

মালয়েশিয়া প্রবাসীদের কাছে ভয়াবহ আতঙ্কের নাম রতান (বেত মারা)। ভয়ে গা শিউরে ওঠে রতানের বর্ণনা শুনে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘এ ব্লো টু হিউম্যানিটি: টর্চার বাই জুডিশিয়াল ক্যানিং ইন মালয়েশিয়া’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে বলেছে, ক্যাম্প বা কারাগারে ৫০ থেকে ৬০ জনকে একসঙ্গে রেখে মধ্যযুগীয় কায়দার বেত মারা হয়। চার ফুট লম্বা ও এক ইঞ্চি মোটা এই বেতের প্রচণ্ড এক আঘাতেই অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞান হয়ে যান। শরীরের চামড়া কেটে যায়, রক্ত জমাট বেঁধে যায়। জ্ঞান ফেরে ১২ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর। অসংখ্য বাংলাদেশি এই নির্যাতনের শিকার। অভিবাসীদের কীভাবে অসম্মান করা হয় আল জাজিরার প্রতিবেদনে সেটি দেখানো হয়েছে।"

এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর মালয়েশিয়ার পক্ষ থেজে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, আল জাজিরাকে বলা হয়েছে প্রতিবেদনটি সরিয়ে নেয়ার জন্য। আল জাজিরার পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, তারা সৎ সাংবাদিকতা করেছে, এখানে মিথ্যা বা মনগড়া কোন তথ্য নেই। মালয়েশিয়ার সরকার তখন এই প্রতিবেদনের সঙ্গে জড়িতদের পেছনে লেগেছে, সেখানে সাক্ষাৎকার দেয়ায় স্বভাবতই টার্গেটে পরিণত হয়েছেন রায়হান কবীর। 

আল জাজিরার সাতজন সাংবাদিককেও তলব করেছে পুলিশ, কিন্ত তাদের সঙ্গে যুক্তিতর্কে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি তারা। কারণ তাদের বেশিরভাগই আমেরিকা-আরব আমিরাত বা উন্নত দেশগুলোর নাগরিক। আর সেকারণেই ক্ষোভের পুরোটা গিয়ে পড়েছে রায়হানের ওপর। রায়হানের পেছনে তো কোন ব্যাকাপ নেই, তিনি কোন উন্নত দেশের নাগরিকও নন। মালয়েশিয়ার পুলিশ তাকে ধরে পিটিয়ে মেরে ফেললেও হয়তো কেউ প্রতিবাদ জানাবে না, এটা মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ ভালো করেই জানে। 

আমেরিকা-কানাডার কথা বাদই দিলাম। ভাবুন তো একবার, ভারতীয় কোন নাগরিকের পেছনে মালয়েশিয়ার পুলিশ এভাবে লাগার সাহস পাবে? তার ছবি পত্রিকায়-টিভিতে দিয়ে তাকে ফেরারি আসামী ঘোষণা করতে পারবে? ভারত সরকার, সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, হাইকমিশন- সবাই আদাজল খেয়ে নেমে পড়বে তাদের দেশের নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। দরকার হলে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে, তবুও নিজেদের নাগরিকের গায়ে টোকাটাও লাগতে দেবে না। 

এই জায়গাটায় আমরা বরাবরই ব্যর্থ। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের দেশ থেকে যাওয়া প্রবাসীরা নির্যাতিত হয়, অত্যাচারের শিকার হয়ে মারা যায়, আমরা প্রতিবাদ করি না, বরং সেই মৃত্যুকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা চলে। আমার দেশের মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়, আমরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাই। আমাদের গায়ে লাগে না কিছুই। এই যে রায়হানের ঘটনাটা গত কয়েকদিন ধরে ঘটে চলেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শক্ত কোন বিবৃতি আসেনি এখনও, মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন রায়হানের পাশে দাঁড়ায়নি। কিসের অপেক্ষায় আছেন তারা, আমরা জানিনা। রায়হান বাংলাদেশী নাগরিক বলেই হয়তো এত ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে তাকে, ভারত বা অন্য কোন দেশের নাগরিক হলে তিনি বেঁচেই যেতেন হয়তো...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা