একাধারে লেখক, নায়ক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন তিনি! ধর্মের নামে অধর্মের ব্যবসা তো করেনই, আদালতের চোখে তিনি ধর্ষকও! আর তা প্রমাণ হতেই তার স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ভক্তরা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিল, এই ভণ্ড ধর্ষকের মুক্তির জন্য প্রাণ দিয়েছিল পঞ্চাশজনের বেশি মানুষ!

ভারতের মিডিয়ায় তার পরিচয় ছিল 'রকস্টার বাবা' হিসেবে।  শীর্ষস্থানীয় সব টিভি চ্যানেল ইন্টারভিউর জন্য ডাকতো তাকে, উপস্থাপকেরা প্রশংসায় গদগদ হয়ে কথা বলতো তার সঙ্গে। নিজেকে তিনি দাবী করতেন লেখক হিসেবে, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, সেগুলোতে নায়কও ছিলেন তিনি, আধ্যাত্নিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে সেসব সিনেমায় এলিয়েন আর হাতিদের বিপক্ষে লড়াই করতেও দেখা গেছে তাকে নায়ক হিসেবে তিনি হিরো আলমের চাইতেও খারাপ ছিলেন- বলে রাখছি। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ধর্মের নামে অধর্মের ব্যবসা করে বেড়াতেন, ভারতের সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে, তাদের চোখে ধুলো দিয়ে টাকা আর ক্ষমতার পাহাড় বানিয়েছিলেন। 

নাম তার রাম রহিম গুরমিত সিং, নামের মধ্যে হিন্দু মুসলমান পাঞ্জাবী সব টাইটেল উপস্থিত, নিজেকে দাবী করতেন সব ধর্মের মানুষের জন্যে ভগবান হিসেবে! তবে আদালতের দৃষ্টিতে তিনি একজন ধর্ষক, যিনি ধর্ষণ করেছেন নিজের আশ্রমের সেবিকাদের। সেটি প্রমাণ হয়েছে আদালতে, আর এতেই তার স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ভক্তরা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিল হরিয়ানা-পাঞ্জাব আর দিল্লীতে। ভাংচুর আর অগ্নিসংযোগে শহর করে তুলেছিল উন্মাতাল! সেই গোলযোগে অন্তত, ৫০ জন মানুুষ মারা গিয়েছিল, আহত হয়েছে প্রায় ৫০০ জন! হিন্দু, মুসলমান আর শিখ- এই তিন ধর্মের চেতনা মিলে গড়ে ওঠা হরিয়ানাভিত্তিক অলাভজনক আধ্যাত্নিক সংগঠন 'ডেরা সাচা সৌদা'র প্রধান গুরু ছিলেন আমাদের এই ভণ্ড রাম রহিম। 

জন্ম হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। নাম ছিল গুরমিত সিং। তরুণ বয়সে দারুণ হিপহপ টাইপের ছিলেন। ১৯৯০ সালে ডেরা সাচা সৌদায় যোগ দেন। নামের আগে রাম রহিম টাইটেল যোগ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চার সন্তানের জনক। তার সংগঠনের মূল কার্যালয় হরিয়ানায়। ধারণা করা হয়, পাঁচ লক্ষ কর্মীর সঙ্গে ভারতজুড়ে প্রায় ছয় কোটি ভক্ত আছে এই বাবা রাম রহিম গুরমিত সিঙের! যদিও শিখ ধর্মাবলম্বীরা অভিযোগ করেন, রাম রহিম সিং তাদের ধর্মকে বিদ্রুপ করে চলেছেন। রাম রহিমের ভক্তদের সঙ্গে শিখদের অনেকবারই নানা ব্যপারে টক্কর লেগেছে। একারণে পাঞ্জাবে তার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাও ছিল। 

ধর্ষক গুরমিত সিং 

নিজের আশ্রমে নিয়মিত গানের জলসাও বসতো, আর তাতে প্রধান শিল্পীও থাকতেন তিনিই! এত ভক্ত কি করে জোটালেন রাম রহিম? জবাবটা সহজ, স্রোতে গা ভাসিয়ে চলতে পছন্দ করেন তিনি, সেভাবেই এতদূর এসেছেন। সঠিক সময়ে সঠিক দলে ভীড়েছেন, মাথা কাজে লাগিয়ে মানুষের অন্ধ বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছেন। সমাজসেবক সেজেছেন, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, যৌনকর্মীদের পূনর্বাসন সহ নানা কাজে হাত লাগিয়েছেন সরকার আর অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে মিলে। প্রচারণার আলোয় থেকেছেন বরাবর। একবার তো হাজারখানেক যৌনকর্মীর বিয়েও নাকি দিয়েছিলেন তিনি! দিনের পর দিন এসব করলে লোকের চোখে হিরো হওয়াটা মাসখানেকের ব্যাপার। 

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন নির্বাচনে জিতে 'স্বচ্ছ ভারত' অভিযানে নেমেছিলেন, তাতে সাড়া দিয়েছিলেন রাম রহিম। মোদীও তাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন! ভক্তসংখ্যা বাড়লে সেটা একটা আলাদা ভোটব্যাংক হিসেবেও কাজ করে, ফলে পাওয়া যায় রাজনীতিবিদদের আনুগত্যও। রাম রহিম সেটার ফায়দাও তুলেছেন পুরোপুরিই। 

তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রথম আসে ২০০২ সালে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপায়ীর কাছে ডেরা সাচা সৌদার এক নারী সেবিকা পরিচয়ে একটা বেনামী চিঠি প্রকাশিত হয় পত্রিকায়। সেখানে লেখা ছিল আশ্রমের গুরুজী তথা রাম রহিম গুরমিত সিঙের অবাধ যৌনাচার আর অত্যাচারের কথা। আশ্রমের শিষ্যাদের জোর করে ধর্ষন করতো সে। ওই নারীর অভিযোগ আমলে নেয়া হয়নি অনেকদিন, পরে হরিয়ানার আদালত স্বপ্রনোদিত হয়ে এই মামলায় উৎসাহ জ্ঞাপন করেন, এবং সিবিআইকে নির্দেশ দেয়া হয় এই কেস তদন্তের। আঠারো জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুইজন স্বীকার করেন যে তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, এই নরপশু এদের একজনকে ধর্ষণ করেছিল তাকে 'পবিত্র' করার নাম করে! 

এছাড়াও রাম রহিম গুরমিত সিং এবং তার ভক্তদের বিরুদ্ধে আরো অনেক হত্যা এবং অত্যাচারের রেকর্ড আছে। ২০০২ সালে ডেরা সাচা সৌদার ভেতরের কথাবার্তা নিয়ে খবর প্রকাশ করায় রাম রহিমের ভক্তরা সাংবাদিক রামচন্দ্র ছত্রপতিকে তার বাড়ীর সামনে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া আশ্রমের পরিচালনা সমিতির এক সদস্য রণজিৎ সিং খুন হন আশ্রমের ভেতরেই, সেটিরও কোন সুরাহা হয়নি। শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঝামেলার জের ধরে তাদের ধর্মীয় সম্মেলনে গুলি চালায় ডেরার ভক্তরা, নিহত হন এক শিখ যুবক।

এছাড়া মামলার বিচারককেও হুমকি দেয়া হয়েছিল একাধিকবার। ২০১০ সালে ডেরার প্রাক্তন সন্ন্যাসী রামকুমার বিষ্ণোই হাইকোর্টের কাছে অভিযোগ জানিয়ে বলেন যে আশ্রমের প্রাক্তন ম্যানেজার ফকির চাঁদকে গুমখুন করা হয়েছে। তিনি ওই ঘটনায় সি বি আই তদন্ত দাবী করেন।  মামলার রায়ে রাম রহিম গুরমিত সিংকে দোষী সাব্যস্ত করামাত্রই তার ভক্ত আর কর্মীরা পাঞ্জাব-হরিয়ানা এবং দিল্লীর পরিবেশ অশান্ত করে তুলেছিল। জ্বালিয়ে দিয়েছে যানবাহন, হামলা করেছে থানা আর সরকারী দপ্তরে। পঞ্চাশ হাজার পুলিশ মোতায়েন করেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি পরিস্থিতি। 

ভন্ড গুরমিত সিং 

সবাই জানতো মামলায় রায় সামান্য উনিশ বিশ হলে কি ঘটতে পারে, কিন্ত সেই অনুযায়ী ছিল না প্রস্ততি। মামলার রায়ের আগের দুইদিন দলে দলে লোক এসেছে হরিয়ানায়, এদের সবাই রান রহিমের কর্মী। সংখ্যাটা দুই থেকে আড়াই লাখ ছাড়িয়েছে, যখন শহর জ্বলেছে, তখন প্রশাসনের হুঁশ হয়েছে। এর পেছনে অবশ্যই রাজনৈতিক কারণ জড়িত। 

রাম রহিম সিঙের ভক্তের সংখ্যা ছিল ছয় কোটি, বিশাল একটা ভোটব্যাংক এটা। আর বর্তমান সরকারকে সমর্থন দিয়েছে সে, হরিয়ানায় কিছুদিন আগেই প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করেছে বিজেপি। স্বভাবতই এমন প্রভাবশালী মানুষ আর এতো বিশাল ভোটব্যাংককে চটাতে চায়নি প্রশাসন, আর তাই জ্বলেছে শহর, পুড়েছে সরকারী সম্পত্তি। যদিও আদালত আদেশ দিয়েছেন, যা ক্ষয়ক্ষতি হবে সব রাম রহিম সিঙের আশ্রম থেকে ক্ষতিপূরণ নেয়া হবে। 

শোনা যাচ্ছে, এখন জেলের ভেতরেও নাকী রাজার হালেই আছেন রাম রহিম গুরমিত সিং। এমন গুরমিত সিংদের দেখলে বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধীদের কথা মনে পড়ে যায়, যারা ধর্মের নাম করে নিজেদের রক্ষা করতে তাণ্ডব চালিয়েছিল দেশের নানা প্রান্তে। সেই ২০১৩-১৪ সালে, একে চাঁদে দেখা গেছে, ওকে মেঘে দেখা গেছে এমন হুজুগে গুজব তুলে দেশের নানাপ্রান্তে শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষকে বোকা বানিয়ে রক্তের হোলীখেলায় নেমেছিল কিছু নরপিশাচ, তাদের খুনী পিতাদের রক্ষায়। তারা সফল হয়নি, ভি সাইন দেখানো খুনী ধর্ষকেরা সবাই ঝুলেছে ফাঁসিকাষ্ঠে। একজনই কেবল ফাঁক গলে জেলের ঘানি টানছে। আশা করি, বাবা রাম রহিম গুরমিত সিংদের মতো এসব ঘৃণ্য ধর্ষকদের পরিণতিও তাদের মতোই হবে!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা