
এত পেশা থাকতে গাড়ির মেকানিক কেন হতে গেলেন রাব্বি আপা? সেটার পেছনে একটা গল্প আছে, দৃঢ়চেতা এক নারীর জীবন সংগ্রামের গল্প...
গাড়ির নিচে শুয়ে হাতুড়ি আর স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে কাজ করছে একজন, সারা শরীরে লেগে আছে কালিঝুলি- মোটর গ্যারেজের ভীষণ পরিচিত একটা দৃশ্য এটা। কালিমাখা শরীরটা গাড়ির নিচ থেকে বেরিয়ে এলেই চমকে উঠবেন আপনি, আরে! এ যে দেখি মহিলা! নারী শিক্ষক হতে পারে, ডাক্তার হতে পারে, ইঞ্জিনিয়ার-পাইলট সবকিছুই হতে পারে, তাই বলে মোটর মেকানিক! চোখ কচলে হয়তো আরও একবার দেখতে ইচ্ছে হবে, পুরো ব্যাপারটা দেখার ভুল কীনা!
চোখ কচলান আর মাথায় পানি ঢালুন- ঘটনা কিন্ত বদলাবে না। গ্যারেজের মোটর মেকানিক হিসেবে কাজ করছেন একজন নারী- খবরটা বিশ্বাস করতে অনেকের কষ্ট হলেও, ব্যাপারটা কিন্ত নির্জলা সত্য। শুধু 'পুরুষের কাজ' বলে যে কিছু নেই, বা 'মেয়েরা এটা করতে পারবে না, অমুক কাজটা মেয়েদের নয়' টাইপের একপেশে ধারণাগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দেয়ার কাজটা যিনি করেছেন, সেই আয়রন লেডির নাম রাবেয়া সুলতানা রাব্বি। পান্থপথের একটা গাড়ির গ্যারেজে কাজ করেন তিনি, সেখানে তার পরিচয় 'রাব্বি আপা' নামে।
কিন্ত বাকী সব পেশা ছেড়ে মোটর মেকানিক কেন হলেন রাব্বী আপা? সেই গল্পটা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ষোলো বছর, কিংবা তারও আগে। ২০০৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল রাব্বির। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে তিনি, বাবা ছিলেন সবজি বিক্রেতা, বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। ভাইয়েরাও বিয়েশাদী করে নিজেদের পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। টাকার অভাবে সেবছর পরীক্ষা দেয়া হলো না রাব্বির। তখন থেকেই মনের ভেতরে একটা প্রতিজ্ঞা কাজ করছিল, আমার ভাইয়েরা যখন বাবা-মাকে দেখছে না, আমিই তাদের দেখব, সংসারটা আমিই চালাবো।

কেয়ার নামে একটা এনজিওর কর্মীদের কাছেই শুনলেন, তারা নারীদের স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিচ্ছে। যারা সেলাই শিখতে চায়, তাদেরকে সেলাই মেশিন কিনে দেয়া হবে। আর যারা ড্রাইভিং শিখতে চায়, তাদেরকে ড্রাইভিং শেখানোর পরে চাকরিও দেয়া হবে। বেতনও বেশ ভালো, দশ হাজার টাকা। ২০০৩-২০০৪ সালের কথা বলছি, তখন দশ হাজার টাকা মানে রাব্বির কাছে অনেক কিছু, এত টাকা একসঙ্গে জীবনে চোখেও দেখেননি তিনি। চাকরিটা পেলে সংসারের হাল ধরতে পারবেন, এই আশায় ভর্তি হলেন ড্রাইভিং শেখার কোর্সে। কিন্ত তাকে নেয়া হলো না চালক হিসেবে।
কয়েকমাস পরে সেই এনজিওর পক্ষ থেকে আবার যোগাযোগ করা হলো রাব্বির সঙ্গে, তাকে বলা হলো, 'ড্রাইভার হিসেবে তো আমরা তোমাকে নিতে পারছি না, তুমি মেকানিক হিসেবে জয়েন করো।' রাব্বির তখন একটা চাকরি দরকার, কেমন চাকরি, কি কাজ- এতসব সাতপাঁচ ভাবারও সময় নেই। কিন্ত ঝামেলাটা হলো অন্য জায়গায়। বাড়ি থেকে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে তখন। রাব্বির মা রাজী হলেন না মেয়েকে মেকানিক হিসেবে চাকরীতে পাঠাতে, পাছে যদি বিয়েটা ভেঙে যায়!
রাব্বি তখন যোগাযোগ করলেন তার হবু বরের সঙ্গে। রাব্বির আজকের এই জায়গায় আসার পেছনে এই ভদ্রলোকের অসীম অবদান। তিনি নিজে তো রাজী হলেননই, তার বাবা-মাকেও রাজী করালেন, তারা যাত্ব পুত্রবধুর বাইরে কাজ করার ব্যাপারটা মেনে নেয়। সংগ্রাম শুরু হলো রাব্বির, দিনে গ্যারেজ, রাতে সংসার। সারাদিন কালিঝুলি গায়ে মেখে গাড়ির সঙ্গে বসবাস তার, গাড়ির ব্রেক ঠিক করছেন, মবিল বদলাচ্ছেন, ফিল্টার পাল্টাচ্ছেন, কখনও বা জুনিয়র কারো সাহায্য নিয়ে আস্ত গিয়ারবক্সটাই বের করে আনছেন!

শুরুর দিকে প্রতিবন্ধকতা তো ছিলোই। মোটরসাইকেল বা গাড়ির সার্ভিসিং করাতে আসা লোকজন যখন দেখতো যে একজন নারী তাদের গাড়ি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন, তখন বাঁকা চোখে তাকাতো তারা। চেষ্টা করতো পুরুষ কর্মচারীকে দিয়ে কাজ করাতে, কারণ একটা বদ্ধমূল ধারণা তাদের ছিল- মেয়ে মানুষ গাড়ির কি বোঝে? কিন্ত রাব্বির কাজের দক্ষতার কারণেই তাদের সেই ভুল ধারণা ভেঙেছে। একবার যারা রাব্বির হাতে নিজের গাড়ি সার্ভিসিং করিয়ে নিয়েছেন, আবারও কোন দরকারে গ্যারেজে এলে তারা এখন সবার আগে 'রাব্বি আপা'কেই খোঁজে।
রাব্বি নিজেও এই বিষয়টা উপভোগ করেন। গর্বের সঙ্গেই তিনি বলেন, 'গাড়ির চাকায় হাত দিলেই বুঝতে পারি কি সমস্যা হয়েছে।' আরেকটা জিনিসও তিনি গর্ব করে বলেন, সেটা হচ্ছে তার আয়ের অঙ্ক। ওভারটাইম মিলিয়ে মাসে প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা কামাই করেন তিনি। বেতনের অঙ্ক বলার কারণটা নিজেকে জাহির করা নয় মোটেও। রাব্বি চান, তাকে দেখে, তার সাফল্যের গল্প শুনে আরও অনেক নারী এই পেশায় যুক্ত হোক। এজন্যেই তিনি টাকার অঙ্কটা বলে দেন অকপটে, কারণ তার কামাই করা প্রত্যেকটা পয়সা হালাল, প্রতিটা টাকার বিপরীতে তিনি ট্যাক্স দেন। বেতনের অঙ্ক তিনি বুক ফুলিয়ে বলতেই পারেন!
লোকজন যখন শোনে রাব্বি মোটর মেকানিক হিসেবে গ্যারেজে কাজ করেন, তখন চোখ কপালে তোলে। বিশেষ করে নিজের শহর দিনাজপুরে গেলে এই প্রশ্নটা তাকে শুনতেই হয়- মেয়ে হয়ে কীভাবে গ্যারেজে কাজ করো তুমি? রাব্বি অকপটে জবাব দেন- কাজ করার দক্ষতা আমার আছে, এজন্যে। একবার ব্যাংকে লোনের জন্যে গিয়েছিলেন ব্যাংক ম্যানেজার তার পেশাগত পরিচয় শুনে বিশ্বাসই করছিলেন না। পরিচয়পত্র দেখানোর পরেও তার বিস্ময় কাটেনি।

রাব্বি আপার একার আয়ে দুটো সংসার চলে এখন। বাবা-মায়ের সংসারে তো টাকা পাঠান, নিজের পরিবারটাও চলে তার টাকাতেই। রাব্বির স্বামী একটা চাকরি করতেন আগে, কিন্ত বছর চারেক আগে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হবার পর সেই চাকরিটা ছেড়ে সন্তানকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। ঘরটা তিনি সামলান, বাইরের দুনিয়াটা সামলাচ্ছেন রাব্বি। আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে সংসারে, স্রষ্টার কাছে তার একটাই চাওয়া এখন, তাদের ছেলেটা যেন মানুষের মতো মানুষ হয়।
রাব্বি আপার গল্পটা এখানেই শেষ। এবার নিজেদের কথা বলি। রাব্বি আপা, ছেলেকে মানুষ করা নিয়ে আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। রত্নগর্ভা মায়ের কথা শুনেছি, আপনি নিজেই তো এক টুকরো রত্ন, আপনার গর্ভেও রত্নেরই জন্ম হবে। হাজারটা বাধা আর কটুকথা উপেক্ষা করে সাহসের বাতি জ্বেলে যেভাবে আপনি এগিয়ে গিয়েছেন, সেটা এদেশের নারীদের জন্যে অনুকরণীয় একটা আদর্শ। ধর্মান্ধ ইতরেরা যখন নারীকে ঘরে বেঁধে রাখার ফতোয়া দেয়, আপনার মতো নারীরা তখন আলোর মশাল হয়ে তাদের মুখে চুনকালি মাখানোর কাজটা করেন। আপনার এই জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক রাব্বি আপা, আপনার জন্যে ভালোবাসা, এবং শুভকামনা...