অস্ট্রেলিয়ায় বুলিং এর শিকার শিশুটির ঘটনা কতটুকু সত্য?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এগিয়ে চলো থেকে ইতিমধ্যেই একটা লেখা প্রকাশ করা হয়েছে ঘটনাটি নিয়ে। তাই এই ঘটনার ফলোআপ করাটাও আমাদের দায়িত্ব। আসুন জেনে নেয়ার চেষ্টা করা যাক, এই ঘটনার পেছনের ঘটনা কী?
অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে বুলিং এর শিকার হয়ে একটি শিশু নিজের মৃত্যুকামনা করেছে। একন্ড্রপ্লাজিয়া নামক বামন রোগে আক্রান্ত শিশুটির এই শারিরীক অবস্থার জন্য সহপাঠীরা তার সঙ্গে বুলিং করে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলেছে ঝড়, মাত্র দুই দিনেই বিশ্বজুড়ে ভাইরাল হয়েছে ভিডিওটি। সাধারণ মানুষের মাঝে যেমন সাড়া ফেলেছে ঘটনাটি, তেমনি সেলিব্রেটিরাও এগিয়ে এসেছেন শিশু কয়েডিন এর জন্য।
এরই ফলশ্রুতিতে কয়েডিনকে ডিজনিল্যান্ড ঘুরিয়ে আনার জন্য কমেডিয়ান ব্র্যাড উইলিয়ামস একটি গো-ফান্ড-মি পেইজ খুলেছেন। সেখানে শিশুটির নামে ইতিমধ্যেই জমা হয়েছে তিন লাখ ডলারেরও বেশি অর্থ, সময় যতো যাচ্ছে কয়েডিনের গো-ফান্ড-মি পেইজের ডোনেশন বেড়েই চলেছে। উল্লেখ্য, কমেডিয়ান ব্র্যাড উইলিয়ামস নিজেও বামনাকৃতির শারিরীক প্রতিবন্ধকতার শিকার এবং তিনি নিজ উদ্যোগে এই কাজটি করেছেন। কয়েডিন এর প্রতি সহমর্মিতা দেখানো জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া।
এদিকে, ঘটনার দুইদিন পরে ইন্টারনেট ডিটেক্টিভেরা তৎপর হয়ে উঠেছেন। কয়ডিন সম্পর্কে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে ইউটিউব এবং টুইটারে। সেই তথ্য অনুযায়ী দাবী করা হচ্ছে, শিশুটির বয়স ১৮ বছর এবং সে একজন অভিনেতা। এই বুলিং এর ভিক্টিম হবার ব্যাপারটি পুরোটাই একটা স্ক্যাম। সহজ অর্থ উপার্জনের জন্য এই পথ বেছে নেয়া হয়েছে। মূলত এই দাবী তুলেছেন, ErbyGames সহ কিছু ইউটিউবার এবং কিছু র্যান্ডম টুইটার ব্যবহারকারী। কয়েডিনের পারিবারিক ইন্সটাগ্রামসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল থেকে কয়েডিনের কিছু ছবি নিয়ে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। সেখান থেকেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তারা।
এগিয়ে চলো থেকে ইতিমধ্যেই একটা লেখা প্রকাশ করা হয়েছে ঘটনাটি নিয়ে। তাই এই ঘটনার ফলোআপ করাটাও আমাদের দায়িত্ব। আসুন জেনে নেয়ার চেষ্টা করা যাক, এই ঘটনার পেছনের ঘটনা কী? কয়েডিনের মা ইয়ারাকা বেইলসের ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে দেখা যায়, তিনি উল্লেখিত অভিযোগ ও দাবিসমূহের প্রতিবাদ করেছেন। ইতিমধ্যেই কিছু নিউজ পোর্টালে তার বিবৃতি এসেছে। টুইটারে তার পক্ষে প্রমাণসহ কিছু টুইটের স্ক্রিনশটও শেয়ার করেছেন তিনি।
যে ছবিটি দেখে বলা হয়েছে কয়েডিনের বয়স ১৮ বছর সেটি আসলে একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানের ছবি, যেখানে কয়েডিনের সাথে আরও চারজন ছবিটিতে উপস্থিত ছিলো। সেটি ছিলো কয়েডিনের বড় ভাইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। এটা ফিজিক্স, ক্যামিস্ট্রির মতো কঠিন কিছু বিষয় না যে ধরে ধরে বুঝিয়ে দেয়া লাগবে। এখন আমি যদি তাজমহলের সামনে গিয়ে ছবি তুলি নিশ্চয়ই সেই মহলের মালিক আমি হয়ে যাবো না।
কয়েডিনের একটি ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট রয়েছে সেটিতে বর্তমানে ফলোয়ার সংখ্যা ২৬৪ হাজার। এই ফলোয়ার সংখ্যাতেও ইন্টারনেট ডিটেক্টিভদের সমস্যা, একটা বামন শিশুর এই পরিমাণ ফলোয়ার থাকতে পারে না। যারা এই দাবী তুলছে, তারা হয়তো গেইম অফ থ্রোন্সের টিরিয়ন ল্যানিস্টারকে চেনে না। ইনারা খুব সম্ভবত লেখক রিচার্ড আর মার্টিনের চাইতে বেশি অভিজ্ঞ। তাদের আচরণে তো তাই মনে হচ্ছে।
আমরা কি নিজেরা ইন্সটাগ্রাম ব্যবহার করি না? বাড়ির উঠান ঘুরে আসা ইউজারও ইন্সটাগ্রামে নিজেকে ট্রাভেলার দাবী করে। মিডলক্লাস লোকজন দামী রেস্টুরেন্টগুলোতে গিয়ে ছবি তোলে। পাবজি খেলা ছোকরাটাও নিজেকে সৈনিক ভাবে, টিকটক করা ছুকরিটাও নিজেকে অভিনেত্রী, মডেল, ইনফ্লুয়ান্সার দাবী করে। কাউকে দোষ দিচ্ছি না, সোশ্যাল মিডিয়ার জীবনটাই এমন। এখানে আঞ্জুমান জরিনাও হয়ে যায় অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। এই যখন প্রেক্ষাপট, একটা মানুষের ফলোয়ার থাকতেই পারে। তার মানে সে কি স্ক্যাম আর্টিস্ট? প্রশ্ন রয়েই যায়।
আমাদের একজন হুমায়ুন সাধু ছিলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালনায় উনমানুষ টেলিফিল্মটিতে অভিনয় করে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। সেই জনপ্রিয়তা কি তার জীবনের বাস্তবতা বদলে দিয়েছিলো? তিনি তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উনমানুষ থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। এটাই রুঢ় বাস্তবতা। কেউ তার শারীরিক ও মানসিক অসহায়ত্বের থেকে সহজে বের হয়ে আসতে পারে না, এই এলিট সমাজ সেটা হতে দেয় না। আপনার দুর্বলতায় বারবার আঘাত করে মনে করিয়ে দেয়া হবে আপনি কে, কোথায় আপনার অবস্থান।
শিশুটি কয়েডিনের বয়স মাত্র ৯ বছর। তার একন্ড্রপ্লাজিয়া ধরা পড়ে জন্মের তিন দিনের মাথায়। তার যে জীবন সম্পর্কে আমরা তিন দিন ধরে জানতে পেরেছি সে তার পুরো বয়সটা জুড়ে যাপন করে যাচ্ছে, যতদিন বেঁচে থাকতে তাকে এই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। সে কোনো দামী গাড়িতে চড়তে পারবে না, ভালো কোনো ব্র্যান্ডের জামাকাপড় পড়তে পারবে না, তার হাতে টাক-পয়সা থাকতে পারবে না। তার জন্মই হয়েছে ধুঁকে ধুঁকে মরার জন্য।
শিশুটি কিংবা তার পরিবার কোথাও দাবী করেনি তারা অর্থাভাবে ভুগছে। তারা আসলে ভুগছে সহনশীলতার অভাবে, সেটাই বারবার ভিডিওটিতে বলা হয়েছে। আর নিজেরাই অর্থের জন্য গোফান্ডিং পেইজ খুলে বসেনি। এই আইডিয়াটাও তাদের নয়। গো-ফান্ডিং এর কাজটি করেছেন কমেডিয়ান ব্র্যাড উইলিয়ামস, যিনি নিজেও বামনাকৃতির শারিরীক প্রতিবন্ধকতার শিকার। এই ব্র্যাড উইলিয়ামসের সাথে রক্তের বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই শিশুটার। একমাত্র একই শারীরিক অবস্থার প্রেক্ষাপট থেকে এগিয়ে এসেছেন তিনি। টুইট করেছেন উলভারিনখ্যাত বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় অভিনেতা হিউ জ্যাকমান।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করে সবাই এগিয়ে এসেছেন। ডোনেশনের ব্যাপারটিও এসেছে এই ভাবনা থেকেই। এমনকি এটাও বলা হয়েছে সেই গো-ফান্ডের পেইজে, কয়েডিনের ডিজনিল্যান্ড ভ্রমণ শেষে যে অর্থ বাঁচবে সেটা ব্যয় করা হবে একন্ড্রপ্লাজিয়া আক্রান্ত শিশুদের চ্যারিটির জন্যেই। এরপরেও অনেকের অনেক প্রশ্ন থেকে যাবে। খারাপ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া আমাদের ভালো কিছু দেখলেই মনে কু-ডাক দেয়। এটাই স্বাভাবিক।
এখানে সরাসরি আলাপটা হচ্ছে, কারও সোশ্যাল মিডিয়ার জীবন পর্যালোচনা করে কখনোই তার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে না। অনেক বিখ্যাত কিংবা অখ্যাত মানুষও খুব দারুণ জীবন পার করে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তার মানে এই না যে, তার জীবনে কোনও কষ্ট নেই।
শুধুমাত্র কিছু ইন্সটাগ্রামের ছবির ওপর ভিত্তি করে শিশু কয়েডিন এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো কিন্তু স্পস্টভাবে প্রমাণ করে না যে এরা সবাই অপরাধী। কোনও কিছুই প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়, তাই বলে ঢালাইভাবে দোষ চাপিয়ে দেয়াটাও যুক্তিযুক্ত নয়। তবে একজন দোষীর বিচার হওয়ার চাইতেও একজন নিরপরাধীর দোষী সাব্যস্ত না হওয়াটাই বেশি গুরত্বপূর্ণ, আইনও তাই বলে।
কমেন্ট সেকশনে যারা আরও প্রমাণ চাইবেন, তাদের জন্য অগ্রীম এই লিংক দিয়ে রাখলাম- Mum of bullied boy Quaden Bayles reacts to conspiracy theory about nine-year-old’s age আরও পড়ুন- বুলিং এর শিকার হয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করছে শিশুটি!