পুষ্পক সেন: ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে অভিনব প্রতিবাদে যিনি এখন ভাইরাল!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মুখভর্তি দাড়িগোঁফ, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল- কলকাতার পুষ্পক সেন অদ্ভুত এক ভঙ্গিমায় এলেন সবার সামনে। জানা গেল, মায়ের অপমান সইতে না পেরে ছেলের এমন বিচিত্র সাজের পেছনে থাকা প্রতিবাদের এক গল্প...
সেদিন বাবার জন্যে একটা পাঞ্জাবি কিনতে 'আড়ং' এ গেলাম। পাঞ্জাবি, শাড়ি, জামাকাপড়ের ডিজাইন, কালার, ফেব্রিক...এসব নিয়ে আমার জানাশোনা বরাবরই শূন্যের ঘরে। তাও ইতস্তত কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে পাঞ্জাবি একটাও পছন্দ করতে না পেরে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবার জন্যে একটা পাঞ্জাবি নিতে চাচ্ছি। কোনগুলো ভালো হবে? সেলসম্যান পাঞ্জাবির যে কর্ণার দেখালেন, সেখানে শুধুই সাদা আর ধূসর রঙা পাঞ্জাবি।
আমি একটু থমকে গেলাম। বয়স বাড়লেই কী জীবন থেকে রঙ মুছে যেতে হবে? এত এত সব রং-ডিজাইন এর পাঞ্জাবি থাকার পরেও সেলসম্যান জানাচ্ছে, বাবার জন্যে ঐ বিবর্ণ পাঞ্জাবিগুলোই ভালো হবে। বয়স বাড়লেই কী সব আনন্দ করা বারন? রঙিন হওয়া মানা? আমি কথা বাড়ালাম না। শেষপর্যন্ত বাবার জন্যে যে পাঞ্জাবি কিনলাম সেখানে প্রচুর রং এর আনাগোনা, ডিজাইনটাও সুন্দর। এটা আমি পড়লেও মানাবে। বাবা পড়লেও মানাবে। ম্যাচিং করেই কিনে নিলাম।
এটা আমাদের অনেকের মধ্যেই একটা খুব সাধারণ ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছে, বাবা-মা'র জন্যে আমরা কালারফুল কিছু কিনতে চাই না। অথবা, পারি না। আমরা ধরেই নেই, বয়স বাড়লে সবকিছু ত্যাগ করে 'সন্ন্যাসী'টাইপ জামাকাপড় পড়তে হবে৷ এছাড়াও বৃদ্ধ মানুষদের গায়ে রঙচঙা জামাকাপড় দেখলে অনেকেই তির্যক মন্তব্য ছুঁড়তে থাকেন, নানারকম কটাক্ষ-বানেও বিব্রত হতে হয় এই বয়স্ক মানুষদের। যেন এরকম পোশাক পড়ে তারা খুব অন্যায় করে ফেলেছে, যেন সমাজকে অবক্ষয়ের শেষসীমায় ঠেলে নিয়ে গিয়েছেন তারা।
সম্প্রতি এরকমই এক ঘটনার প্রতিবাদ হতে দেখি কলকাতায়। যে ঘটনা ইতোমধ্যে বেশ ভাইরালও হয়ে গিয়েছে। কলকাতার পুষ্পক সেন নামের একজনের ইন্সটাগ্রাম পোস্ট ও ছবি হয়েছে ভাইরাল। পুষ্পক সেনের ছবি ও পোস্টের আগে আমাদের যেতে হবে মূল ঘটনার দিনে। পুষ্পকের মা, যার বয়স ৫৪, তিনি গিয়েছিলেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে অনুষ্ঠানে। সেখানে এই ভদ্রমহিলাকে সবার তীব্র বাক্যবানে জর্জরিত হতে হয়েছে। বিচিত্র, বিব্রতকর, আপত্তিকর কথার 'হলাহল' বিষে নীলবর্ণ হতে হয়েছে। অপরাধ তার একটিই- এই বয়স্ক মানুষটি ঠোঁটে 'লাল লিপস্টিক' দিয়ে গিয়েছিলেন অনুষ্ঠানটিতে। যেটাই তার জন্যে হয়ে গিয়েছে অমোচনীয় পাপ।
বাড়িতে এসে তিনি ছেলেকে জানান সব। ছেলে পুষ্পক সেন এরপর করেন অদ্ভুত এক কাজ। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়ে তিনি ছবি তুলে আপলোড করেন ইনস্টাগ্রামে। প্রতিবাদ জানান, তার মায়ের সাথে করা অন্যায়ের বিপক্ষে। যেন সমাজে এতদিন ধরে চলে আসা এক সংকীর্ণ সংস্কৃতির গালেই চপেটাঘাত করেন তিনি, ছবি দিয়ে। যেন বুঝিয়ে দিলেন, যার যার ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দ, রুচি তার তার কাছেই প্রাধান্য পাবে। সেটাই হওয়া উচিত। এটা নিয়ে অন্য কেউ কিছু বলতে আসা, নিজেদের দৃষ্টিকোন, রুচি,অরুচি চাপিয়ে দেয়া শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই না, অসভ্যতাও।
যারাই এই লেখাটি শেষপর্যন্ত পড়লেন, তাদের কাছে অনুরোধ, নিজের বাবা-মা'কে সবসময় রঙিন পোশাক কিনে দিন। বাবা-মা'র বয়স বাড়লে এরা ভেতরে ভেতরে 'শিশু' হয়ে যান৷ এই শিশুদের খেয়াল রাখুন। রঙিন রাখুন৷ যে মানুষগুলো আপনার জীবনকে রঙিন করেছে, আপনিও নাহয় তাদের জীবনকে সামান্য হলেও রঙিন করলেন। সে চেষ্টাই করুন। তাছাড়া নিজে কী পড়ে, কীভাবে চলে স্বাচ্ছন্দ্য পাবেন, সেটা নিয়ে ভাবুন। অন্যরা কি ভাবলো আপনাকে নিয়ে, তাতে কিছু আসে যায় না। কখনোই না। তাই, আস্তে আস্তে শুরু হোক সচেতনতা। যেটা পুষ্পক সেন করলেন। এভাবেই হোক প্রতিবাদ। এটা দরকারও।
হয়তো এটা এখনই বড় কোনো পরিবর্তন আনবেনা। তবে শুরুটা হয়তো এভাবেই হতে পারে। এখনই হতে পারে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন