কক্সবাজারের প্লেনের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না, হোটেলগুলোতে উপচে পড়া ভীড়, ঈদের ছুটিতে যেমনটা থাকে। সৈকতে মানুষের ভিড়ে দাঁড়ানো দায়! শুধু কি কক্সবাজার? সাজেক-শ্রীমঙ্গল কিংবা নীলগিরি-বিছানাকান্দি, কোথায় ভীড় জমেনি!

আমার সবসময় মনে হয়, স্রষ্টা পুরো দুনিয়ার মানুষকে বানিয়েছেন এক রকমের মাটি দিয়ে, বাঙালির বেলায় তিনি ব্যবহার করেছেন অন্যরকম কিছু। সেটা মাটি হতে পারে, গোবর হতে পারে, একদম আলাদা কিছুও হতে পারে। নইলে আমাদের মধ্যে এমন সব অদ্ভুত ব্যাপার কেন থাকবে- যেগুলো পুরো দুনিয়ার কারো মধ্যে নেই?

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে, সেটা যাতে মহামারীর পর্যায়ে না যায়, সেজন্যে খানিকটা দেরীতে হলেও সরকার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে, অনেক প্রাইভেট অফিসও কর্মীদের বাসায় থেকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। করোনার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে জনসমাগম, একজনের শরীর থেকে দশজনের শরীরে ভাইরাস ছড়ায়- সেরকম কিছু যাতে না হয়, সেকারণেই এত সাবধানতা। বিশ্বের বাকী দেশগুলো নিজেদের নিরাপদ রাখার জন্যে সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করেছে ইতিমধ্যেই।

এতসব দেখেশুনে আমরা কি করেছি? ছুটি পাওয়ামাত্রই খুশির আমেজে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়েছি! কক্সবাজারের প্লেনের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না, হোটেলগুলোতে উপচে পড়া ভীড়, ঈদের ছুটিতে যেমনটা থাকে। সৈকতে মানুষের ভিড়ে দাঁড়ানো দায়! শুধু কি কক্সবাজার? সাজেক-শ্রীমঙ্গল কিংবা নীলগিরি-বিছানাকান্দি, কোথায় ভীড় জমেনি! মানিক মিয়া এভিনিউতে সংসদ ভবনের সামনে শত শত মানুষ এসে বসে আছে সন্ধ্যেবেলায়, ফুচকা খাচ্ছে, ডেটিং করছে- আলো আঁধারির বুকে চমৎকার একটা উৎসবের আমেজ, যেন পৃথিবীর চারদিকে সুখ ঢলে ঢলে পড়ছে!

কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়া একজন ক্যামেরার সামনে নির্লজ্জের মতো হেসে হেসে বলছে- ‘আমরা আল্লাহকে ভয় পাই, করোনাকে ভয় পাই না!’ করোনা আমাদের কাছে হয়ে গেছে 'আয় মাম্মা, চিল করি'র আরেক নাম! গর্ধবটা জানে না, ভাইরাস হিন্দু-মুসলমান কিংবা আল্লাহ-ভগবান দেখে আক্রমণ করে না। করোনা একটা সাক্ষাৎ বিপদ, অথচ মাথামোটা জাতি এটাকে উৎসবের উপলক্ষ্য বানিয়ে ফেলেছে! আফসোস, ভাইরাসের নিউক্লিয়াসে যেটুকু পদার্থ আছে, এই গাধাদের মাথায় সেটুকুও যদি মগজ থাকতো!

করোনা মানেই যেন ছুটির আমেজ, উৎসবের উপলক্ষ্য!

টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, ইতালি থেকে ফেরা প্রবাসীদের কেউই হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম-কানুন মেনে চলছেন না। এদের সবার অন্তত ১৪ দিন আলাদা থাকার কথা ছিল, মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা উচিৎ ছিল। অথচ এরা হাটে-বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পরিবারের মানুষদের সংস্পর্শে আসছে, কেউ তো হোটেলে গিয়ে মিষ্টি সাবাড় করছে, যেন পৃথিবী থেকে মিষ্টি নামক বস্তুটা ফুরিয়ে যাবে কয়েক ঘন্টা পরে! কেউ আবার মোটরসাইকেলে প্রেমিকাকে নিয়ে ঘুরছে, শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে, কেউ তো বিয়ের পিঁড়িতেও বসছে! একদল আবার করোনা থেকে বাঁচার জন্যে থানকুনি পাতা চিবিয়ে খাচ্ছে। করোনার মগজ থাকলে এসব দেখে সে পাকিস্তানি ওই ক্রিকেট ভক্তের মতো মাথা চাপড়ে বলতো- ও ভাই, মারো, মুঝে মারো! পুরো পৃথিবী যে ব্যাপারটা নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে, সেটাকে আমরা কি হালকাভাবে, ছুটির আমেজে নিচ্ছি- ভাবতেই অবাক লাগে! বাঙালিকে যে স্রষ্টা সাধারণ কোন মাটি দয়ে তৈরি করেননি, সেটার জন্যে আরও প্রমাণ লাগবে কি?

এ তো গেল সাধারণ মানুষের কথা। মানুষকে যাদের বাঁচানোর দায়িত্ব- সরকার আর তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো কি করছে? কতটা উদ্যোগী তারা? মন্ত্রীরা ফাঁকা বুলি মেরে যাচ্ছেন- আমরা সক্ষম, আমরা সক্ষম বলে। সেই সক্ষমতার নমুনা কি এই, ইতালিফেরত মানুষগুলোর মাধ্যমে সারা দেশে ভাইরাসটা ছড়িয়ে পড়তে পারে জেনেও শুধুমাত্র তাদের প্রতিবাদের মুখে সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে না পাঠিয়ে বাড়ি যেতে দেয়া? আজ একজন বৃদ্ধ মারা গেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে, ইতালীফেরত একজনের সংস্পর্শে আসার পরেই করোনা ধরা পড়েছে তার। এই মৃত্যুর দায় সরকার কি এড়িয়ে যেতে পারে?

করোনার কারণে মুজিব বর্ষের মূল অনুষ্ঠান বাতিল করা হলো। করোনা যখন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে, সেই সময়টাতে হাতিরঝিলে আয়োজন করা হয়েছিল আতশবাজির উৎসব। শোনা যাচ্ছে, কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছে এই আয়োজনে। আমাদের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার-নার্সদের জন্যে প্রয়োজনীয় সার্জিক্যাল মাস্ক নেই, সতেরো কোটি মানুষের দেশে করোনার টেস্ট কিট আছে মাত্র ১৭০০ পিস, অথচ আমরা মুজিববর্ষের নামে কোটি কোটি টাকা অপাত্রে নষ্ট করি। শেখ মুজিবের আদর্শ কি এটাই বলে? ভাগ্যিস মানুষটা বেঁচে নেই, থাকলে হয়তো এসব দেখে মরে যাওয়াটাকেই সম্মানজনক বলে ভাবতেন তিনি। 

করোনা ঠেকাতে চলছে বিশেষ দোয়া মাহফিল

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে পঁচিশটি জায়গায় সাবান আর হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা চালু করেছে। মেয়র আতিকুল ইসলাম সেটা উদ্বোধন করতে গিয়েছেন কয়েকশো মানুষকে সাথে নিয়ে। এই নাকি আমাদের সচেতনতার নমুনা! বাইরের দেশগুলো যেখানে জনসমাগমকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, সেখানে আমরা পলিটিক্যাল শো-ডাউন করছি! সিটি কর্পোরেশনের সেই হাত ধোয়ার মঞ্চে বেসিন ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্যটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, করোনার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধের পরিমাণটা কত ক্ষুদ্র!

আরেক উপদ্রব আছে, সেটার নাম ওয়াজ আর দোয়া-মাহফিল। হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হচ্ছে একটা জায়গায়, খোদা না করুন, এদের মধ্যে একজনের শরীরেও যদি কড়নার ভাইরাস থেকে থাকে, সেটা মুহূর্তের মধ্যে হাজার মানুষের মধ্যে ছড়ানোর সামর্থ্য রাখে। সেই হাজারটা মানুষ আবার ছড়িয়ে পড়বেন আলাদা আলাদা জায়গায়। প্রশাসন নাকি জানেই না পঁচিশ হাজার মানুষের এই জমায়েতের খবর! প্রশাসনের কাজ তো আজকাল হয়ে গেছে একে তাকে রাত-বিরাতে ধরে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া- মিটিং-মিছিলের খোঁজ আর পাওয়া যাবে কোত্থেকে?

লক্ষ্মীপুরে করোনার বিরুদ্ধে দোয়া মাহফিল হয়েছে, পঁচিশ হাজার মানুষ একত্র হয়েছে সেখানে। এই দোয়া মাহফিল যে উল্টো বিপদ ডেকে আনবে, এটা মাথামোটা মানুষগুলো বুঝতে পারছে না। খতমে শেফার নামে এই উজবুকি কাণ্ডটা যে এদের জীবন খতম করে দিতে পারে- সেটা এদের কে বোঝাবে? সৌদি আরব, ইরান, কুয়েত যখন মসজিদে নামাজ আদায় বন্ধ করে দিচ্ছে ভাইরাসের আতঙ্কে, আমরা তখন হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে দোয়া পড়ছি! এর চেয়ে আহাম্মকির কাজ আর কি হতে পারে আমার জানা নেই।

করোনাকে সিরিয়াসলি নেয়ার ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে আসছে না, আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি না আসলে। আমাদের আতংকটা বাজার সদাই করে ঘর ভরিয়ে ফেলায়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত হ্যান্ডওয়াশ আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনে বাজারে সংকট তৈরী করায়। নিজেদের জীবন বাঁচানোর ব্যাপারে, পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ রাখার প্রশ্নে আমরা সচেতন নই। আতঙ্কের জন্যে আমাদের লাশ দরকার, তাজা লাশ। এই ঢাকা শহরে দু-চারশো মানুষ না মরলে আমাদের হুঁশ ফিরবে না, আমরা করোনাকে সিরিয়াসলি নেবো না। কিন্ত মহামারী শুরু হলে দু-চারশোতে যে সংখ্যাটা থামবে না, সেটা ইতালিকে দেখেও শেখা যায়। আফসোস, দেখে শেখার অভ্যাস আমাদের কোনকালেই ছিল না, হবেও না...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা