পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দত হুসাইন আর নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাহি রাজিউন।
কত স্মৃতি স্যারের সাথে আমার! অথচ সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল ভীষণ তিক্ততা দিয়ে। পরে অবশ্য স্যারের সাথে দারুণ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। স্যার সম্ভবত বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন। ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইয়ের এক প্রবীণ সদস্যের সূত্রে কয়েকদিন আগে জানতে পারি তিনি বেশ সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন। তখনই আশঙ্কাটা বুকের মধ্যে এসেছিল।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সা’দত স্যার মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর ওই বছরের মে মাসে তাকে পিএসসির চেয়ারম্যান করা হয়। যোগ দিয়েই তিনি ২৭ তম বিসিএস এর ফলাফল বাতিল করলেন। শুরু হলো বিতর্ক।
বাংলাদেশের বি সি এস এর ইতিহাস ২৭ তম বিসিএস নিয়ে এই তর্কের শেষ হয় তা কোনদিনই হবে না। চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করার পর সেই ফল আবার বাতিল করা, আবার নতুন করে মৌখিক পরীক্ষা নেয়া,আবার ফল, আগের ফলে যারা বাদ পড়েছেন তাদের মামলা, নতুন ফলাফলে যারা উত্তীর্ণ তাদের নিয়োগ বিলম্ব আরো কত কি যে ঘটেছে এই বিসিএস নিয়ে। কত যে নিউজ আমি করেছে এই বিসিএস নিয়ে। ২৭ তম বিসিএস দিয়ে যাদের চাকরি হয়েছে বা চাকরি হয়েও যারা যোগ দিতে পারেননি, দুই পক্ষই তাকে আজীবন মনে রাখবে।
সা’দত স্যার ভীষণ বলিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। জরুরি অবস্থার সময় যেভাবে যা করতে চেয়েছেন করার চেষ্টা করেছেন সাদাত হোসাইন। তবে গণতান্ত্রিক সরকার আসার পর তার নানান সিদ্ধান্ত নিয়ে পিএসসির সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিশেষ করে সরকার নতুন যে তিনজন সদস্যকে পিএসসিতে নিয়োগ দেয় সাদাত হোসেন তাদের শুরুতে বসতে পর্যন্ত দেননি। দেননি তাদের কোন কাজ। পিএসসির ইতিহাসে এমন হয়েছে কিনা কারো জানা নেই। এক পর্যায়ে পিএসসিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়।
একপর্যায়ে সরকার চাইছিল তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করুক। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাঁকে চায়ের দাওয়াতও দেন। তাঁর বাসার নিরাপত্তাও শিথিল করা হয়। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে তিনি তার মতো করে ছিলেন। ওই সময়টা আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। আমার মনে হয় খুব কম লোকই সবকিছু উপেক্ষা করে এভাবে দিনের পর দিন দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারবেন।
আমার সাথে স্যারের সম্পর্কে আসি। পিএসসির অচলাবস্থা, নানান নিয়োগ জটিলতা, মামলা, সদস্যদের বসতে না দেয়া, পরীক্ষার ফলাফলে দীর্ঘসূত্রতা এসব বিষয় নিয়ে আমি অসংখ্য নিউজ করি। এসব নিউজে স্যারের বক্তব্য লাগতো। কিন্তু আমি যখন তার সাথে কথা বলতে চাইতাম তিনি আমার ফোনই ধরতেন না। পিএসসি বা তার বিরুদ্ধে যায় এমন কোন নিউজ প্রকাশ হোক এমনটা চাইতেন না তিনি। অথচ আমার বক্তব্য লাগবেই।
নিউজে বক্তব্য নেয়ার জন্য ব্যক্তিগত নম্বর থেকে শুরু করে তার পিএস মনজুর ভাই, জনসংযোগ কর্মকর্তা মোশাররফ ভাই, স্যারের অফিসের নম্বর, বাসার নম্বর কত জায়গায় যে ফোন দিয়েছি। তিনি কোন ভাবেই কথা বলতেন না। তবে নিউজ ছাপা হওয়ার পরের দিন তার জনসংযোগ কর্মকর্তা বিশাল দুই পৃষ্ঠার বক্তব্য পাঠাতেন। অবশ্য এই মানুষটার সাথে অল্প কিছুদিন পর আমার দারুন সম্পর্ক হয়ে গেল।
সম্পর্কটা দারুন হওয়ার কারণ, একটা পর্যায়ে তিনি তিনি বুঝলেন যেটা নিউজ সেটা আমি করবই। আমাকে তিনি ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। তিনি বুঝেছিলেন নিউজের বাইরে আমার কোন উদ্দেশ্য নাই। আর আমিও বুঝলাম তিনি চান প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হোক। বিসিএসের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে নিয়োগ হোক।
দুজনের চাওয়াগুলো মিলে যাওয়ায় আমাদের সম্পর্কটা এমন হয়ে গেল, আমি যখনই ফোন দিতাম স্যার ফোন ধরতেন। কখনো কখনো তিনিও ফোন দিতেন। নানান বিষয় নিয়ে তিনি আমার সাথে কথা বলতেন। আমাকে স্যার একবার বিসিএস পরীক্ষাও দিতে উৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যখন বুঝলেন লাভ নেই, পরে আর বলেননি।
আপনারা আজকের প্রজন্ম জানেন কিনা জানি না, জোট সরকারের আমলে এমন অবস্থা হয়েছিল যে বিসিএস মানে প্রশ্নপত্র ফাঁস। নিয়োগের নামে লেনদেন হতো নিয়মিত। সরকারি দলের লোকজন হলে নানান ধরনের অনৈতিক সুবিধা মিলতো। এমনকি বাইরে থেকে খাতা লেখা হয়ে আসতো। সব কিছু মিলে পিএসসির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যায়।
ওই সময় পিএসসির কয়েকজন সদস্যও নিয়োগ অনিয়মসহ নানান ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ছাত্রদলের শীর্ষ একজন নেতা তার বাসায় লেনদেন করে অনেককে ক্যাডার বানিয়েছিলেন এমনটাও শুনতাম ক্যাম্পাস। এমন একটি অবস্থার পর পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি।
আমি সব সময় বলি, জোট সরকার আমলে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া পিএসসি নতুন করে ঘুরে দাঁড়ায় সা’দত স্যারের হাত ধরে। ২৮,২৯,৩০ এই বিসিএসগুলোতে দারুন নিয়োগ হয়েছে। প্রায় শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে এর নিয়োগ প্রক্রিয়া। দু-একটা বিসিএস কিছু সমস্যা হলেও পরের বেশিরভাগ বিসিএসসি বেশ ভালো হয়েছে। আজকে সাধারণ ছেলে মেয়েদের বিসিএস এর প্রতি যে এত আগ্রহ সেই আগ্রহের শুরুটা করে দিতে পেরেছিলেন সা’দত স্যার।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি এগুলো মোটেও পছন্দ করতেন না সা’দত স্যার। বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় ১০০ নম্বর থাকুক তিনি সব সময় সেটা চাইতেন। আমাকে বলেছিলেন মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর ১০০ এর বেশি হওয়া উচিত না। এর বেশি হলে পক্ষপাতিত্ব সুযোগ বাড়ে।
সা’দত স্যার সবসময় কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাইতেন। চেয়ারম্যান থাকাকালে এই সংস্কার নিয়ে তিনি একটি প্রতিবেদন তৈরি দায়িত্ব দেন ড. আকবর আলি খানকে। সেই প্রতিবেদন আমার কাছে আছে। অসাধারণ সেই প্রতিবেদন। সা’দত স্যার বারবার বলতেন সাধারণ ছেলে মেয়ে মেধাবীরা যেন চাকরি পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগ দেন সা’দত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে প্রবাসী সরকারে দায়িত্ব পালন করেন। দারুন সৎ ও বলিষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। আমি খুব অবাক হতাম এমন বলিষ্ঠতা নিয়ে তিনি জোট সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে কী করে পাঁচটা বছর দায়িত্ব পালন করে গেলেন?
স্যারের সমালোচনা করার জন্য বলছি না। তবে আমার মনে হয়েছে, তিনি বেশ একনায়কতান্ত্রিক ছিলেন। তবে তার উদ্দেশ্য কখনো অসৎ ছিল না। কিন্তু সবাই মিলে আলোচনা করে কাজ করার চেয়ে নিজে যেটা ভালো বোঝেন সেটা করতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। তবে তার সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। বরং তিনি যে সবসময় চাইতেন মানুষ সৎ ভাবে জীবন যাপন করুক।
সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, ঘুষ খাওয়া এগুলো তিনি খুব অপছন্দ করতেন। বিশেষ করে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা যেন সৎ হয় সেটা তিনি সবসময় চাইতেন। অসৎ কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনি খুব আক্ষেপ করতেন। সততা নিয়ে স্যারের একটা গল্প বলি। বর্তমান যুগের সততা নিয়ে গল্পটি করেছিলেন তিনি।
সা’দত স্যার বললেন একদিন তার কাছে এক লোক আসে। কথায় কথায় সেই লোক একজন কর্মকর্তার নাম নিয়ে বলে লোকটা বেশ সৎ। স্যার বলেন আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ আমি তো লোকটাকে সৎ হিসেবে জানতাম না। লোকটাকে তখন জিজ্ঞেস করলাম আপনি নিশ্চিত তো লোকটা সৎ? লোকটা তখন বললেন, হ্যাঁ স্যার। তিনি টাকা নিয়ে কাজটা করে দিয়েছেন। আজকাল তো অনেক লোক আছে টাকা খায়, কিন্তু কাজ করে না। কাজেই তাকে তো সৎ বলতেই হবে।
সা’দত স্যারকে নিয়ে আরও অনেক গল্প বলা যায়। আমাদের বর্তমান জনপ্রশাসনে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, তেলবাজি যেখানে পন্থা, অসৎ মানুষদের যেখানে দাপট, ব্যক্তিত্ব বলে যেখানে কিছু নেই, সেখানে একজন সাদত হুসেইন দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ক। পরপারে ভালো থাকবেন স্যার।
আমি জানি, আপনি পিএসসির চেয়ারম্যান থাকাকালে যারা নিয়োগ পেয়েছে তারা নিশ্চয়ই আপনার কথা মনে রাখবে। তবে তারা যদি আপনার সততার বাণী, নিষ্ঠার বাণীর অর্থ বুঝতে পারে তাহলে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। সেটাই হবে আসল শ্রদ্ধা। পরপারে ভালো থাকবেন স্যার।
কথা বলুন নিঃসংকোচে
প্রিয় পাঠক, করোনার এই দুঃসময়ে আপনাদের সমস্যা কিংবা ভাবনা আমাদের মন খুলে বলুন। আমরা কথা বলব আপনার হয়ে, জানাব সংশ্লিষ্ট মহলকে। লিখে পাঠান আমাদের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে, কিংবা এই মেইল এড্রেসে- choloegiyebd@gmail.com