অমুক-তমুক টোয়েন্টিফোর ডটকম এসব কাজ করলে মেনে নেয়া যায়, কিন্ত প্রথম আলো কেন এই স্রোতে গা ভাসাবে? যারা বাকীদের জন্য একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দেয়ার কাজ করে, তারা কেন জনপ্রিয়তার জন্য এমন নোংরা রাস্তা বেছে নেবে?

দেশে একটা সময় ওয়েব পোর্টালের মেলা বসেছিল। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় অমুক-তমুক টোয়েন্টিফোর/বিডি নামধারী সেসব ওয়েবসাইটে যা তা খবর ছাপানো হতো, মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য উল্টোপাল্টা ছবি আর ক্লিকবেট হেডলাইন দিয়ে আর্টিকেলের নামে আবর্জনা বানানো হতো। রেডিওমুন্না টাইপের ভুঁইফোড় সেসব অনলাইন পোর্টাল কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে, বরং নামীদামী মিডিয়া হাউজগুলোই এখন নাম লেখাচ্ছে এসব ক্লিকবেট হেডিং দিয়ে পাঠক টানার মিছিলে।

অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া গতকাল ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন আম খাওয়া নিয়ে। ফারিয়া লিখেছিলেন, ‘আজ জিম ছিল না, সন্ধ্যায় বোরড ছিলাম, মনটাও একটু খারাপ। ভাবলাম কিছু যখন করার নেই, কিছু খাই। দেখলাম নতুন আম আনা হয়েছে, খেলাম। খেতে খেতে ৮টা আম খেয়ে ফেলছি। এখন যেন কেমন লাগছে। সারমর্ম হলো, এক বসায় কেউ ৭টার বেশি আম খাবেন না! শরীর খারাপ করতে পারে।’ ঘন্টাখানেকের মধ্যে প্রথম আলো অনলাইনে সেটা নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়ে গেছে, যেটার শিরোনাম ছিল- 'খেতে খেতে ৮টা আম খেয়ে ফেলেছি!'

গত দুই দশক ধরে প্রথম আলো দেশের এক নম্বর জাতীয় দৈনিক। সেটা তাদের সাংবাদিকতার মানের কারণেই সম্ভব হয়েছে। প্রথম আলোর যে অনলাইন ভার্সনটা, সেটাও সম্ভবত সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে যে কোন পত্রিকা বা পোর্টালের অনলাইন ভার্সনের চেয়ে বেশিবার পড়া হয়। সেই প্রথম আলোকে কেন পাঠক টানার জন্য এরকম ক্লিকবেট হেডলাইনের আশ্রয় নিতে হবে, এটা ঠিক মাথায় ঢুকলো না। 

এরকম শিরোনামে একটা খবর প্রকাশিত হলে সেটা নিয়ে অনলাইনে নোংরামি হবেই, ডাবল মিনিং বের করে আজেবাজে কথা লিখবে অনেকে, লিখছেও। খবরের বিষয়বস্তু যেহেতু একজন নারী, এবং মিডিয়া কর্মী- তাই নোংরামির পরিমাণটাও বেশি। প্রকাশিত এই সংবাদের শিরোনামের ব্যপারে শবনম ফারিয়া আপত্তি জানিয়েছেন প্রথম আলোর কাছে, আরেকটি স্ট্যাটাসের কমেন্টে সেটা বলেছেন তিনি। কিন্ত সংবাদ প্রকাশের পরে প্রায় একদিন পার হয়ে গেলেও, প্রথম আলো অনলাইনের বিনোদন বিভাগ সেই খবরের শিরোনাম পরিবর্তন করেনি। 

পত্রিকা পড়া যখন থেকে শুরু করেছি, প্রথম আলো সেই সময় থেকেই সঙ্গী। সময়ের অংকে সেটা পনেরো বছরের বেশি হবে। ভোরবেলা হকার পত্রিকা দিয়ে গেলেই সবার আগে খেলার পাতাটা খুলে বসতাম। উৎপল শুভ্র, পবিত্র কুণ্ডু, তারেক মাহমুদ, দেবব্রত মুখার্জী বা আরিফুল ইসলাম রনিদের লেখা গোগ্রাসে গিলতাম। উৎপল শুভ্রের লেখা পড়ে ক্রীড়া সাংবাদিক হবার স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমাদের জেনারেশনের অনেকেই এরকম স্বপ্ন দেখেছে। এই মানুষগুলোর লেখনী অন্ধের মতো অনুসরণ করতাম, খেলোয়াড়দের ছবি কেটে আঠা দিয়ে ডাইরিতে লাগিয়ে রাখতাম।

এমন শিরোনাম কি প্রথম আলোর নামের সঙ্গে মানানসই?

বৃ্স্পতিবার মূল পত্রিকার সঙ্গে আনন্দ ম্যাগাজিন দিতো, বিনোদনের হরেক রকম খবরের মেলা বসতো সেখানে। তখন তো ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিল না, শাহরুখ-সালমান বা ডি-ক্যাপ্রিও-ব্র‍্যাড পিটদের অজানা সব গল্প জানার জন্য আনন্দ-ই ছিল ভরসা। ফিচার, মুভি রিভিউ- এগুলোতে নেশাগ্রস্তের মতো ডুবে থাকতাম। দুর্দান্ত সব লেখা ছাপা হতো তখন, দেশের সিনেমা থেকে হলিউড-বলিউড, সব আমাদের নখদর্পণে থাকতো প্রথম আলোর কল্যানে। আলপিন থেকে রস আলো, বা প্রথম আলোর ঈদসংখ্যা- সবকিছুর নিয়মিত পাঠক ছিলাম। 

সেই প্রথম আলো এখন তারকাদের আম খাওয়া নিয়ে ক্লিকবেট শিরোনাম দিয়ে আর্টিকেল ছাপায় অনলাইন ভার্সনে, বিতর্ক উস্কে দিয়ে, অন্যকে বিপদে ফেলে জঘন্য মানের একটা কন্টেন্টকে হিট করাতে চায়। প্রথম আলো সবসময় বলে, যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো- এটাই বুঝি সেই ভালোর নমুনা? শবনম ফারিয়া একজন তারকা, পাশাপাশি একজন মানুষও। তার পরিবার আছে, আত্মীয়-স্বজন আছেন। বিতর্কিত এই শিরোনাম নিয়ে অনলাইনের এসব নোংরামিগুলোর কারণে তাকে অপদস্থ হতে হচ্ছে, সেটার দায়ভার তো পুরোপুরি প্রথম আলোর। 

কিছুদিন আগে একটা শিরোনাম চোখে পড়লো- মাহির আম খেয়ে খুশি ডিএ তায়েব। খবরের সারমর্ম হচ্ছে, চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি নাকি অভিনেতা ডিএ তায়েবের জন্য উপহার হিসেবে আম পাঠিয়েছেন, সেই আম পেয়ে মাহিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তায়েব। স্বাভাবিক একটা খবর, অথচ সেটার শিরোনামটা বিভ্রান্তিকর। সেই অনলাইন পোর্টালটা খুব বিখ্যাত কিছু ছিল না। জাগোনিউজ কয়েকদিন আগেই মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নিয়ে শিরোনাম করেছে, স্ত্রীকে রাস্তায় ফেলে গেলেন স্বামী, কাছে টেনে নিলেন মাশরাফি! অথচ মূল খবরটা হচ্ছে, মাশরাফি সেই মহিলাকে আশ্রয় এবং সাহায্য দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন!

ক্ষণিকের জনপ্রিয়তার জন্য অনলাইনে এরকম ক্লিকবেট শিরোনাম অনেকেউ ব্যবহার করে। অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানকে তো কয়েক দফা মেরে ফেলা হয়েছে এপর্যন্ত। কিন্ত আমাদের প্রশ্ন একটাই, প্রথম আলো কেন এই স্রোতে গা ভাসাবে? যারা বাকীদের জন্য একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দেয়ার কাজ করে, তারা কেন জনপ্রিয়তার জন্য এমন নোংরা রাস্তা বেছে নেবে? শীর্ষে থাকলে যে বাড়তি কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়, সেটা কি তারা বেমালুম ভুলে গেছে?

প্রথম আলোর অনলাইন সেকশনের বিনোদন বিভাগে এমন সার্কাস বেশ কিছুদিন ধরেই চোখে পড়ছে। কোন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের আগে একটু ভালোভাবে রিসার্চ করা দরকার, সেটা ইদানিং তাদের কাজ দেখে বোঝার উপায় নেই। অদ্ভুত সব ভুলভাল তথ্য দিয়ে তারা খবর প্রকাশ করে ফেলে, যেগুলো চোখে পড়লে হাসি আর বিরক্তি- দুটোই একসঙ্গে আসে। কয়েকদিন আগে সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর প্রথম আলো অনলাইনে তাকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদে এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি সিনেমার পরিচালক হিসেবে লেখা হয়েছে অরুণ পাণ্ডের নাম, যিনি ধোনির ম্যানেজার। অথচ সিনেমাটি পরিচালনা করেছিলেন বিখ্যাত পরিচালক নীরাজ পাণ্ডে। নামের শেষে পাণ্ডে দেখেই প্রথম আলো অরুণ পাণ্ডেকে পরিচালক বানিয়ে দিয়েছে! এমন শিশুতোষ ভুল প্রথম আলোর বিনোদন বিভাগে হরহামেশাই চোখে পড়ে। 

গতকাল জানতে পারলাম, করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রথম আলো নাকি তাদের এক তৃতীয়াংশ কর্মী ছাঁটাই করবে।  প্রথম আলোর সঙ্গে আমাদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে, আবেগ মিশে আছে। তাই তাদের প্রতি পরামর্শ, কাউকে যদি ছাঁটাই করতেই হয়, বিনোদন বিভাগের অকালপক্ক অকর্মণ্য লোকগুলোকে করুন, যারা ক্লিকবেট হেডলাইনে খবর ছাপিয়ে প্রথম আলোর মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। রোল নম্বর সত্তর-আশিতে থাকা ছাত্ররা উল্টোপাল্টা কাজ করলে মনকে বোঝানো যায়, রোল এক যদি সেটা করে, তাহলে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা