কিছু মানুষ আছেন, যাদের সব সময়ই সব কিছু গণ্ডগোল মনে হয়। সেটা একাত্তর হোক, সেটা শাহবাগ হোক কিংবা আমেরিকার এই প্রটেস্ট। 'ভাঙচুর করার কি দরকার? উফফ, আন্দোলন করবি একটু ভদ্র করে কর না!'

ওয়ারফেইজের জনপ্রিয় গান 'অসামাজিক' এর এই লাইনটা ধ্রুব সত্য। যেকোন ন্যায্য দাবী আদায়ের সংগ্রামে অন্যতম বাধকতা যেটা হয়ে দাঁড়ায়, তা হলো এই সচকিত নাগরিকগোষ্ঠী। এনাদেরকে খারাপ বলবো না, কিন্তু এই 'ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার বাপু' মানসিকতাটা শোষকগোষ্ঠী খুব ভালোমত কাজে লাগাতে পারে।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ছিলেন যাদেরকে ঠিক খারাপ বলা যাবে না। এনারা নিপাট 'ভদ্র' মানুষ, ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন, পাকিস্তানী শাসকের বুটের তলায় পিষে চ্যাপ্টা হলেও 'এই তো বেশ আছি' বলে ভালো থাকতে চেয়েছেন।

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

তাই প্রথমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, পরে যা রূপান্তরিত হলো স্বাধীনতার এবং এর পরে নয়মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তির সংগ্রামে, তারা পুরোটা সময় দূরে থেকে এক প্রকার ভয় এবং এক প্রকার বিরক্ত নিয়ে থেকেছেন, কারণ তাদের সুন্দর সাজানো গোছানো পৃথিবীটা উলটপালট হয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য তাই সময়টা হয়ে যায় 'উফফ সেই গন্ডগোলের সময়' বলে বিরক্তি প্রকাশ করার সময়।

কিই বা দরকার ছিল বাবা এসবের মধ্যে যাওয়ার? যেমন ছিলাম ভালোই তো ছিলাম! পাকিস্তানী শাসকরা এবং তাদের দেশীয় দালালরা কিন্তু এই মানসিকতার ভালোই ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল, মুক্তির সংগ্রামটাকে বাঞ্চাল করতে। ভাগ্যের জোরে এই মানসিকতা থেকে মুক্ত উড়নচণ্ডী 'গুন্ডা' মনোবৃত্তির ক্র্যাক মানুষ একটু বেশীই দৃঢ় চেতার ছিল বলে সফল হয় নাই।

এই মানসিকতাটা হিউম্যান নেচার আসলে। এখন যখন কৃষ্ণাঙ্গদের মানুশের মত বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে একটা দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে আমেরিকাতে, বছরের পর বছর ধরে পুলিশ এবং কিছু ক্ষেত্রে 'সচেতন' শ্বেতাঙ্গ নাগরিকের হাতে তুচ্ছ কারনে মার খেয়েছে, খুন হয়েছে একের পর এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক, কোন বিচার হয় নাই, এসবের বিরুদ্ধে অবশেষে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়ে ক্রোধে ফুসে উঠেছে অনেক মানুষ, তখনও দেখতে পারছি এক শ্রেনীর সেই তথাকথিত 'সচকিত নাগরিক' মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

''ভাঙচুর করার কি দরকার? উফফ, আন্দোলন করবি একটু ভদ্র করে কর না।"

"এদের জন্য আমাদের স্থানীয় ওয়ালমার্ট বন্ধ করে দিয়েছে। আমি বাজার কিভাবে করবো?"

"এসব গণ্ডগোলের মানেটা কি? যারা খুন করেছে তাদের তো চাকরীচ্যুত করেছে আর পুলিশ গ্রেফতার করেছেই, এখনও কিসের এত ক্ষোভ?"

এই মানসিকতাকে এদেশের শ্বেতাঙ্গ শাসকগোষ্ঠীও খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে জানে। ট্রাম্প ইতিমধ্যে 'গুড প্রটেস্টর' 'ব্যাড প্রটেস্টর' এর মধ্যে বিভেদ করছে। লুটপাটের ঘটনাগুলোকেই হাইলাইট বেশী করা হচ্ছে, এর অন্তর্নিহিত কারণ, ক্ষোভগুলো উপেক্ষা করে। এই দেশের মিডিয়াও কম ছাগল না। তথাকথিত প্রগতিশীল ঘরানার মিডিয়াও অনেক ক্ষেত্রে ব্যালেন্স করে চলছে, বিক্ষোভকারী এবং খুনি বর্ণবাদী পুলিশ/উগ্রপন্থী শ্বেতাঙ্গরা একই রকম খারাপ, সেটাই প্রচার করছে। এ যেন সেই ২০১৪-২০১৫ সালে বাংলাদেশে দেখা 'নাস্তিক/মৌলবাদ দুইটাই সমান' যুক্তির নতুন রূপ!

যে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে

দেখার বিষয় এই যে, 'সচকিত নাগরিকদের' ঠ্যালায় কৃষ্ণাঙ্গদের এই ন্যায্য দাবী আদায়ের আন্দোলন আরেকবার মাঠে মারা যাবে কিনা। কারণ ট্রাম্প এবং তার সমর্থকগোষ্ঠীর তরুপের টেক্কা এটাই। বারেবার বেশ সফলতার সাথে এটা ব্যবহার করেছে এরা। খুব সম্ভবত এবারও হবে, শুধু তাই না, এটাকে পুঁজি করে ট্রাম্পের মত ধূর্ত সাম্প্রদায়িক ইতর আসছে নভেম্বরে আরেকবার নির্বাচনও জিতে যাবে।

নাকি এই আন্দোলন সফল হবে, এই গা বাঁচিয়ে চলা মানুষদের উপেক্ষা করে, এই আলোচনার শুরুতে উল্লেখিত 'অসামাজিক' গানেরই কোরাসটার মতো:

"হে সমাজ, আমি অন্ধকারে আর নয়
হে সমাজ, আমি করবো নাকো আর ভয়
আমি ভাঙ্গতে চাই সেই রীতিনীতি
যেথা অন্যায় হয় স্বীকৃত
হে সমাজ, আমি অন্ধকারে আর নয়..."

আশা শূন্যর কোঠায় থাকলেও মাঝে মাঝে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা নিয়ে অলীক স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা