অধ্যাপক মনছুর খলীল- একজন অসামান্য ডাক্তারের গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দুটি শার্ট আর দুটি প্যান্ট দিয়েই বছরের পর বছর পার করে দিয়েছেন মানুষটি। যে রুমে থাকতেন, সেটায় একটা চৌকি, একেবারেই সস্তা দরের একটা চেয়ার,টেবিল; আর কিছুই ছিল না। অথচ তিনি ছিলেন মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপক।
দুটি শার্ট অার দুটি প্যান্ট দিয়েই বছরের পর বছর পার করে দিয়েছেন মানুষটি। যে রুমে থাকতেন, সেটায় একটা চৌকি, একেবারেই সস্তা দরের একটা চেয়ার আর একটা টেবিল অার কিছুই ছিল না। অথচ তিনি ছিলেন মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপক। একজন ডাক্তার।
বলছি অধ্যাপক মনছুর খলীলের কথা। বিশাল বড়মাপের একজন ডাক্তার, একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক হয়েও কতটা অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতে পারেন সেটি তার ছাত্রছাত্রীরা জানতেন। বিয়ে-থা করেননি। ছাত্রছাত্রীরাই ছিল তাঁর সব। মনছুর খলীলের জীবনটাও বড় বৈচিত্র্যময়। ১৯৬১ সালের ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ডা. মিরাজ আহমেদ ছিলেন সামরিক অফিসার, যিনি পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পরিচালক ছিলেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মনছুর খলীল মেজ, বড় ভাই অধ্যাপক ডা. মুহসীন খলীল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান। বোন সবার ছোট।
ছোটবেলা থেকেই অধ্যাপক মনছুর খলীল ছিলেন তুখোড় মেধার অধিকারী। তাঁর বড় ভাই ডা. মুহসীন খলিল যখন ক্লাস ওয়ানে পড়াশোনা করতেন, মনছুর খলীল নার্সারিতে অসাধারণ রেজাল্টের জন্য ডাবল প্রমোশন পেয়ে বড় ভাইয়ের সহপাঠী হয়ে যান। ক্লাস ওয়ানে পুনরায় অতুলনীয় রেজাল্টের জন্য তাঁকে ডাবল প্রমোশন দেওয়া হয়, তবে ভাইয়ের সঙ্গে পড়বেন বলে তিনি আর ডাবল প্রমোশন নেননি।
মনছুর খলীল ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৫তম স্থান অর্জন করে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষাতেও ১৫তম স্থান অর্জন করেন। এরপর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলেন ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু বড় ভাই ডা. মুহসীন খলীল চান্স পান ময়মনসিংহ মেডিকেলে। ভাইয়ের সঙ্গে থাকার অভিপ্রায়ে ঢাকা থেকে চলে আসেন ময়মনসিংহ মেডিকেলে। মেডিকেলেও তাঁর মেধার স্বাক্ষর রাখতে থাকেন, অভূতপূর্ব পারফরম্যান্সের জন্য পুরো মেডিকেলে সবাই তাঁকে একনামে চেনে। প্রথম পেশাগত পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম স্থান অধিকার করেন, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পেশাগত পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান এবং চতুর্থ অর্থাৎ শেষ পেশাগত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় রাখেন।
মেডিকেলে যতগুলো বিষয়ে পড়ানো হয়, এর মধ্যে শুধু কমিউনিটি মেডিসিন আর ফরেনসিক মেডিসিন বাদে বাকি সব বিষয়ে অনার্স মার্কস (৭৫%) অর্জন করে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। এখানেই থেমে থাকেননি এই কিংবদন্তি। ১৯৮৬ সালে অষ্টম বিসিএস পরীক্ষায় স্বাস্থ্য ক্যাডারে অংশগ্রহণ করেন এবং পুরো বাংলাদেশে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
শরীয়তপুরের জাজিরা থানায় দুই বছর মেডিকেল অফিসার হিসেবে এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করে অ্যানাটমিতে স্নাতকোত্তর কোর্সের জন্য প্রেষণে যান ১৯৯০ সালে। তৎকালীন আইপিজিএমআরের অধীনে এমফিল অ্যানাটমিতে পাস করেন ৭৫% মার্কসহ এবং ঠিক যেন গৎ বাঁধা নিয়মে এখানেও প্রথম স্থান অধিকার করেন। অ্যানাটমিতে পিএইচডি অর্জনের জন্য তিনি পাড়ি জমান জাপানে, ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেন ১৯৯৯ সালে। সেখানেও রেকর্ডসংখ্যক নম্বর পেয়ে স্পেশাল রিকমেন্ডেশন পান, তাঁকে গবেষণার কাজে জাপানে থেকে যেতে বলা হয়, বেশ উচ্চ পারিশ্রমিকেই, কিন্তু তিনি রাজি হননি।
পয়সা আর আর সম্মানের লিপ্সা কখনো তাঁকে টানেনি। চলে আসেন দেশে। জ্ঞানের নেশা ছিল তাঁর। এরপর ২০০১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেরিনারি অ্যানাটমিতে কম্পেয়ারেটিভ অ্যানাটমিতে এম এস কোর্সে প্রবেশ করেন এবং ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। এরপর ২০০৪ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে ফরেনসিক মেডিসিনে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৫ সালে অর্জন করেন ফরেনসিক মেডিসিনে এমসিপিএস ডিগ্রি।
একই জায়গায় বেশি দিন চাকরি করা তাঁর ধাতে ছিল না। একে একে বগুড়া মেডিকেল, চট্টগ্রাম মেডিকেল, সিলেট মেডিকেল, ময়মনসিংহ মেডিকেল এবং সবশেষে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। সারাটাজীবন তিনি শুধু রোগী অার ছাত্রদের কথা ভেবেছেন। অধ্যাপক মনছুরের সাথে অামার কখনো পরিচয় ছিল না। ২০১৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। পরের বছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে কয়েকজন ডাক্তার তাকে স্মরণ করে একটা লেখা লিখেন। অামি সেই লেখাটা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতে গিয়ে মানবিক এই মানুষটা সম্পর্কে জানতে পারি। অার তখন থেকেই তাকে ভীষন শ্রদ্ধা করি।
অাজকের যুগের ডাক্তার কিংবা যে কোন পেশার মানুষ অামরা মনছুর খলীলের কাছ থেকে শিখতে পারি কী করে নির্লোভ একটা জীবন কাটিয়ে মানুষের পাশে থাকা যায়। স্যারের সব শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক মনছুর খলীলের নামে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এনাটমি মিউজিয়ামের নামকরণের প্রস্তাব করেন যাতে করে ক্ষণজন্মা এই মানুষটিকে স্মরণ করে রাখা যায়। জানি তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মনের ভেতরে সব সময়ই থাকবেন শ্রদ্ধার সঙ্গে। কারণ তাঁর মতো শিক্ষক পাওয়া যে বিরল ঘটনা। পরপারে ভালো থাকুন স্যার।
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন