শিশুর উপর যৌন নিপীড়ন আমাদের সমাজে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। প্রতিদিনই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অসংখ্য শিশু। কে জানে, পরবর্তী শিকার হতে পারে আপনার সন্তানও। তা যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করুন এখনই।
ধর্ষণের খবর তো প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা টিভিতে দেখতে পাই আমরা। কিন্তু জানেন কি, ২০১৫ সালে ডেইলি স্টারের করা এক জরিপে উঠে এসেছিল বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকারদের মধ্যে শতকরা ৮৫ জনের বয়সই বিশের নিচে! তাহলে বুঝতেই পারছেন, শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের হার আমাদের দেশে ঠিক কতটা বেশি।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ২০১৮ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুর সংখ্যা ৪৭৭। এদের মধ্যে সরাসরি ধর্ষিত হয়েছে ৩৫১ জন, যা গেল বছরের তুলনায় ১৫% বেশি। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে ৪৩ জন শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৭ জন, আর যৌন নিগ্রহের শিকার সাতজন।
২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসে ধর্ষণের ঘটনা আগের বছরকেও হার মানিয়েছে। কথায় আছে না, পরিসংখ্যান সবসময় সত্য কথা বলে না, সেটি শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের বেলায় সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। ৪৭৭ জন শিশু না হয় মুখ ফুটে তাদের উপর যৌন নিপীড়নের কথা বলেছে এবং তাদের বাবা-মাও সেগুলো প্রকাশ্যে এনেছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এরচেয়ে দশগুণ বেশি শিশু সম্ভবত যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, কিন্তু শিশুরা ভয়ে সেগুলো তাদের অভিভাবককে জানাতে পারে না, বা জানালেও অভিভাবকেরা লোকলজ্জার ভয়ে সেগুলো স্রেফ চেপে যায়।
শিশুরা কাদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়? মূলত পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বা প্রতিবেশীরাই শিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন চালিয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। এছাড়া রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের দ্বারা, শিশুরা কোনো বাসায় কাজ করলে সেখানের মালিক বা অন্যান্য কর্মচারী দ্বারা, স্কুলপড়ুয়া শিশুরা তাদের শিক্ষক বা স্কুলের বিভিন্ন কর্মচারী দ্বারা (মাদ্রাসার ছাত্ররাও), কিংবা বাসায় গৃহশিক্ষক দ্বারা শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি।
অনেকে হয়ত আরেকটি তথ্য জেনে অবাক হবেন যে, বিশ্বব্যাপী ২৩% শিশু আসলে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দ্বারা নয়, বরং অন্য কোনো শিশুর দ্বারাই হয়ে থাকে যৌন নিপীড়নের শিকার। এটি হয় মূলত যৌন শিক্ষার অভাবের কারণে। একটি শিশু হয়ত বাসার আশেপাশে খেলতে গেছে। তখন সমবয়সী বা বয়সে কিছুটা বড় কোনো শিশু তাকে প্রলুব্ধ করল শরীরের গোপন জায়গাগুলো ছোঁয়ার ব্যাপারে। মনে রাখবেন, শিশুর কাছে এটি কিন্তু নিছকই একটি খেলা। এবং খেলার ছলেই সে আরেকটি শিশুর দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে যেতে পারে।
এতটুকু পড়ে অনেকেরই হয়ত গা গুলাতে শুরু করে দিয়েছে। অনেকে হয়ত ভাবছেন গাঁজাখুরি একটা লেখা লিখছি, যাতে এই ওয়েবসাইটের ভিউ বাড়ে। কিন্তু না পাঠক, এতক্ষণ যা লিখেছি তাতে একবিন্দুও মিথ্যা নেই। অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে যদি কোনোভাবে ভুল প্রমাণিত হতে পারতাম, তাহলে আমি নিজেই হয়ত সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। কিন্তু কী করব বলুন, বাস্তবতা যে এমনই নির্মম।
তবে সে যাইহোক, বাস্তবতাকে তো অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিংবা 'ধুর, আমাদের শিশুদের সাথে কখনও এগুলো হবে না' বলে নিশ্চিন্তে থাকারও জো নেই। আপনি যদি একজন সচেতন বাবা বা মা হয়ে থাকেন, তাহলে নিজের শিশুর যৌন সুরক্ষার ব্যাপারে আপনাকে নজর দিতেই হবে। যদি না দেন, তাহলে কবে হয়ত আপনার শিশুই পত্রিকার শিরোনাম হবে যৌন নিপীড়নের শিকার হিসেবে।
কিংবা কে জানে, আপনার শিশু হয়ত কারও দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে এসেও লজ্জা বা ভয়ে আপনাকে কোনোদিন সেটি জানাতেও পারবে না। অথচ দুনিয়াটাকে ঠিকমত বুঝে ওঠার আগেই তার অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে এ জগতের ভয়াবহতম নিষ্ঠুরতার। মানসিকভাবে সে হয়ত এতটাই বিকলাঙ্গ হয়ে পড়বে যে কোনোদিন তাকে আর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এক দুর্বিষহ মানসিক ট্রমা তাকে তাড়া করে ফিরবে জীবনভর।
তবে এখন কথা হলো, চাইলে কি বাবা-মা কিংবা শিশুর অভিভাবকগণ এসব বিষয়ে আগে থেকেই সচেতনতা অবলম্বন করতে পারেন না, যাতে করে তাদের সন্তানের সাথে কোনোদিন এমন কিছু না হয়? নিশ্চয়ই পারেন। শিশুর যৌন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাবা-মা বা অভিভাবকদের করণীয় রয়েছে অনেক কিছুই। এমনই দশটি অত্যাবশ্যকীয় করণীয়ের ব্যাপারে আলোকপাত করছি।
১। আপনার শিশুকে তার পুরো শরীরটি চিনিয়ে দিন এখনই। তাকে যেরকম তার হাত-পা, চোখ-কান-নাকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন একেবারে শৈশব থেকেই, ঠিক একইভাবে তাকে পরিচয় করিয়ে দিন তার স্তন, শিশ্ন, যোনী ও পশ্চাদ্দেশের সাথেও। এবং তাকে বুঝিয়ে বলুন যে, শরীরের এই বিশেষ অংশগুলো খুবই ব্যক্তিগত।
২। শরীর চেনানো সম্পন্ন হলে তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন, শরীরের ব্যক্তিগত অংশগুলো ব্যক্তিগত এ জন্য যে, সেগুলো দেখার অধিকার একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর বাবা-মা ছাড়া আর কারোই নেই। এমনকি ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য যাওয়া হলেও, বাবা-মায়ের অনুমতি বা পরামর্শ ছাড়া ডাক্তারের সামনে নগ্ন হওয়া যাবে না।
৩। এবার তাদের বলুন, শরীরের ব্যক্তিগত অংশগুলো অন্য কেউ যেমন দেখতে পারবে না, তেমনই ছুঁতে পর্যন্ত পারবে না, এবং কেউ ছোঁয়ার কথা বলতেও পারবে না। বিগত বাক্যের শেষাংশটি খেয়াল করুন। ছুঁতে পারবে না তা তো ঠিকই আছে, কিন্তু ছোঁয়ার ব্যাপারে কথাও বলা যাবে না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ক শুরুতে শিশুকে খেলার ছলে তার শরীরের ব্যক্তিগত অংশ ছোঁয়ার কথা বলে থাকে, এবং ক্রমশ নিজের লক্ষ্য অর্জনের দিকে ধাবিত হয়।
৪। শিশুকে বলুন, নিজের শরীর নিয়ে কোনো গোপনীয়তা চলবে না। শরীরের ব্যক্তিগত অংশে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে লজ্জা না পেয়ে সাথে সাথেই সেগুলো যেমন বাবা-মাকে জানাতে হবে, ঠিক তেমনই কেউ যদি তাদের শরীরের ব্যক্তিগত অংশ দেখে ফেলে বা ছুঁয়ে ফেলে, সে বিষয়েও বাবা-মাকে অবগত করতে হবে।
৫। শিশুকে বলুন, অপরিচিত কেউ যেন তাদের ছবিও না তোলে। এই পয়েন্টটি দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হতে পারেন। ভাবতে পারেন, শিশুর ছবি তোলায় কী এমন যায় আসে! আসলেই যায় আসে। পৃথিবী এখন বিকৃত মনস্ক পেডোফাইলে ভরে গেছে। কোনো ব্যক্তি হয়ত সরলমনেই আপনার শিশুর ছবি তুলে অনলাইনে আপলোড করল, কিন্তু সেটি দেখে যে কোনো পেডোফাইলের জিভ লকলক করে উঠবে না বা সে আপনার শিশুকে কামনা করতে শুরু করবে না, সে গ্যারান্টি কে দেবে!
৬। শিশুকে শিখিয়ে দিন কীভাবে কোনো ভীতিপ্রদ বা অস্বাচ্ছন্দ্যদায়ক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। ধরুন কেউ হয়ত তার শরীরের ব্যক্তিগত অংশ দেখতে বা ছুঁতে চাইল, বা তাকে জাপটে ধরল। তখন সে যেন দ্রুত ওই ব্যক্তির নাগালের বাইরে চলে আসার চেষ্টা করে, এবং বিশ্বাসভাজন কাউকে এ ব্যাপারে অবগত করে। বাসার আশেপাশে হলে বাবা-মাকে বা স্কুলে হয়ত শিক্ষকদেরকে এ ব্যাপারে জানিয়ে দেয়।
৭। শিশু একটু বড় হলে তার সাথে সাংকেতিক ভাষায় কথা বলা শুরু করুন। তাকে কোনো একটি বিশেষ সাংকেতিক শব্দ শিখিয়ে দিন, যেটি সে বাসায় আসা কোনো অতিথির দ্বারা আক্রান্ত হলে ব্যবহার করে বাবা-মাকে অবগত করতে পারে, বা বাইরে কোনো পাবলিক প্লেসে কারও দ্বারা আক্রান্ত হলেও অন্য কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে কেবল বাবা-মাকে জানাতে পারে।
৮। শিশুর মনে সাহস জোগান, তার মনের ভয় দূর করুন। যৌন নিপীড়করা শিশুর সাথে অনাচার করার পর তাদেরকে ভয় দেখায় যেন সে এ কথা কারও কাছে প্রকাশ না করে, যদি প্রকাশ করে তবে তার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই শিশুকে বোঝান, বাবা-মা থাকতে তার কোনো ভয় নেই। নির্বিঘ্নে সে বাবা-মাকে সব কথা বলতে পারে।
৯। এবারের পয়েন্টটিও কিছুটা বিভ্রান্তিকর। আপনি যদি ধারণা করে থাকেন যে আপনার শিশুকে কেউ খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে স্পর্শ করলেই সে সেটি বুঝে যাবে, তা কিন্তু ঠিক নয়। বরং খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে করা স্পর্শেও অনেক শিশুর মনে ভালো লাগা তৈরী হতে পারে, সে এটিকে একটি মজার খেলা বলে বিবেচনা করতে পারে। তাই তাকে 'ভালো স্পর্শ', 'খারাপ স্পর্শ' না শিখিয়ে, 'প্রকাশ্য স্পর্শ' ও 'গোপন স্পর্শ' সম্পর্কে শিক্ষা দিন। অর্থাৎ শরীরের কোন কোন জায়গায় সবার সামনে স্পর্শ করা যায়, আর কোন কোন জায়গায় তা করা যায় না।
১০। আপনার শিশুকে ভালো করে বুঝিয়ে দিন যে উপরের নিয়মকানুনগুলো সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমনকি সমবয়সী কোনো বন্ধু, কাছের বড় ভাই-বোন বা প্রিয় আংকেল-আন্টি হলেও, তাদেরকে গোপন স্পর্শ করতে দেয়া যাবে না, বরং অতিসত্বর বাবা-মাকে সেটি জানিয়ে দিতে হবে।
আমি বলছি না, উপরের দশটি কাজ করলেই আপনার শিশুর যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে। এই প্রতিটি নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার পরও হয়ত আপনার শিশু কোনো দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। তাই শিশুকে যৌন নিপীড়নের ব্যাপারে যাবতীয় শিক্ষা প্রদানের পরও নিশ্চিন্তে থাকা চলবে না, বরং যতদিন না সে যথেষ্ট বড় হচ্ছে এবং নিজের ভালোমন্দ নিজে বোঝার ক্ষমতা অর্জন করছে, ততদিন পর্যন্ত যথাসম্ভব তাকে চোখে চোখে রাখুন, নিজ দায়িত্বে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন