তিন কুখ্যাত 'আধ্যাত্মিক গুরু'র ভণ্ডামির আখ্যান
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোলা মানুষজন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, আর সেটারই সুযোগ নেয় এসব ভণ্ড গুরুরা। ধান্ধাবাজী করে হয়ে ওঠে কোটি কোটি টাকার মালিক, নিপীড়ন চালায় নারীদের ওপর। যখন সবাই বুঝতে পারে তাদের ভণ্ডামি, ততক্ষণে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় এরা...
মানুষ অজস্র কারনে প্রতিদিন ক্রমাগতই বিপর্যস্ত হয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বিভিন্নভাবেই শোষণ করে তাকে। বিপর্যয়ের এসব ঘটনায় মানুষকে ক্রমাগত অস্তিত্বের সংকটে ভুগতে হয়, হতে হয় নাকাল, বিপর্যস্ত, পরাজিত। পার্থিব বিষয়গুলো মানুষকে যখন "ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স"-এ ভোগাচ্ছে, মানুষ তখন অপার্থিব, স্পিরিচুয়াল ওয়ার্ল্ডে যেতে চায়। ব্যাঙের ছাতার মত অজস্র স্পিরিচুয়াল লিডারদের মধ্য থেকে কাউকে বেছে নিয়ে তাঁর ছত্রছায়ায় স্বস্তি পেতে চায়। কিন্তু পায় কী? সে প্রশ্ন খুব প্রাসঙ্গিক। তাছাড়া "আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু" হিসেবে যাদেরকে বেছে নেয়া, তারাও প্রকৃত মানুষ তো? তারা কী আধ্যাত্মিকতা মন থেকেই ছড়াচ্ছে? নাকি সেখানে রয়ে যাচ্ছে ব্যবসার ভেলকিবাজি। সেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ফাহাদ ফাসিলের অভিনীত মালয়লাম সিনেমা "Trance" আমরা অনেকেই দেখেছি। সেখানে অখ্যাত এক মোটিভেশন স্পিকারের রাতারাতি "ধর্মগুরু" হয়ে ওঠার ব্যবসায়িক যাত্রাটা আমাদের অনেককেই বিস্মিত করেছে। তাছাড়া আহমদ ছফার "একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন" অথবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ"র "লালসালু"তেও আমরা ধর্মব্যবসার রকমফের দেখি। শুধু সিনেমা-গল্প-সাহিত্যে কেন দেখছি? বাস্তবেও তো এমন উদাহরণ রয়েছে অজস্র। আজ কথা বলবো এমন তিনজন মানুষকে নিয়ে, যারা সমাজের চোখে ছিলেন সম্মানিত, অর্থ-বিত্ত-বৈভবের ঘাটতি ছিলো না। ঘাটতি ছিলো এক জায়গায়। মনুষ্যত্বে। কথা বলবো তাদের নিয়েই।
বিক্রম চৌধুরী- ইউ আর নট ওয়াইজ এনাফ টু আন্ডারস্ট্যান্ড হু আই এ্যাম
বিক্রম চৌধুরীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৭০ সালে তিনি কোলকাতা থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমান এবং সেখানে বিখ্যাত ইয়োগা-ট্রেইনার হয়ে যান অল্পদিনের মধ্যেই। যোগাসনের ২৬ রকম নতুন পজিশন ছিলো তার অন্যতম স্পেশালিটি। যদিও পরবর্তীতে জানা যায়, তার নিজের নামের ট্রেডমার্ক করা এই পজিশনগুলো তার নিজের আবিষ্কৃত না। কলকাতায় থাকাকালীন তার এক শিক্ষক থেকে বেমালুম মেরে দিয়েছেন পজিশনগুলো। এই পজিশনগুলোকে একত্রে বলা হতো বিক্রম ইয়োগা। বিক্রম ইয়োগা সম্পর্কে একটু বলা দরকার। না বললে কেউ কিছুই বুঝবেন না। এটা একরকমের হট ইয়োগা যেখানে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৯০ মিনিট ধরে এই ২৬টি পজিশন ক্রমাগত করে যেতে হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই ইয়োগা চলাকালীন সময়ে ঘরের পরিবেশ তো উত্তপ্ত হবেই, বলা বাহুল্য। কিন্তু আমাদের এই ট্রেনার ভদ্রলোক করতেন কী, তার নিজস্ব চেয়ার (যেটাতে বসে তিনি ইয়োগার ডিরেকশন দিতেন), তার পেছনে এয়ার কন্ডিশন ফিট করে রাখতেন। সবাই গরমে ভাজা ভাজা হচ্ছে আর তিনি খুব কৌশলে নিজেকে ঠাণ্ডা রাখতেন। কপটতার গল্প এখান থেকে শুরু।
তার এই "বিক্রম ইয়োগা" আমেরিকায় বেশ সাফল্য পায়। আমেরিকানরা নতুন কিছু দেখলে এমনিতেও একটু বেশি পাগলাটে হয়ে যায়, সেটা নতুন কিছু না। বিক্রম চৌধুরী ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা আর আমেরিকান পাগলামি মিলিয়েমিশিয়ে শুরু করেন তার যোগব্যায়ামের ব্যবসা। রাতারাতি বিজনেস মডেলটা পাবলিক নিয়ে ফেলে। তাছাড়া, মানুষকে কথার সাহায্যে খুব তাড়াতাড়ি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারতেন তিনি। এটাও বিজনেসে লাভ করার বেশ ভালো একটি টোটকা হিসেবে আসে। তার খুব জনপ্রিয় একটা ডায়লগও আছে-
You are not intelligent, wise, experienced enough to understand who I am.
তাতেও সমস্যা ছিলোনা। আধ্যাত্মিকতা নিয়ে ব্যবসা ফেঁদেছেন। সমস্যা নেই। রোলেক্স ঘড়ি আর বিলাসবহুল প্রেসিডিন্সিয়াল স্যুটে থাকেন, ক্লাসিক গাড়ি আর বিলাস-ব্যসনের চরম পরাকাষ্ঠা দেখান... তাতেও সমস্যা নেই। একজন আধ্যাত্মিক যোগীর এত টাকাপয়সা, অর্থের জৌলুশ থাকা উচিত কী না, সে উত্তরে "আমি তো যোগী না, আমি আমেরিকান যোগী" বলছেন হাসতে হাসতে, সেটাতেও কোনো সমস্যা ছিলোনা। দাবী করতেন, প্রেডিডেন্ট নিক্সন নাকি তার অধীনে যোগব্যায়াম করে পায়ের সমস্যা সারিয়েছেন, যদিও তার এ কথার স্বপক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। তবুও সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা তখন হলো, যখন কিছু মহিলা তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনলেন, ২০০০ সালে। যদিও তিনি তার শক্তি খাটিয়ে কয়েকটা মামলা রাতারাতি হাপিশ করে দিলেন। তাও একটা মামলায় ৭ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হলো তাকে। টাকাপয়সা না দিয়ে, সবার চোখে ধুলো দিয়ে রাতারাতি আমেরিকা থেকে মেক্সিকো পালিয়ে গেলেন এই ভদ্রলোক (!)।
২০১৪ সালে তার কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থী তার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনলেন আবার। ভারতীয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বেশ ক'টি দেশের শিক্ষার্থী ছিলো তারা। প্রথম দিকে তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতোনা, কারন অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তার উপরে। তাছাড়া তিনি বেশ প্রভাবশালীও ছিলেন। মানুষজন স্বভাবতই ভয় পেতো। কিন্তু আস্তে আস্তে মানুষের টনক নড়তে থাকে। যদিও লাভ হলোনা তাতে অবশ্য। বিক্রম চৌধুরীর টিকিটিও পাওয়া গেলোনা আর।
তিনি এখনো মেক্সিকোতেই আছেন। বেশ বহাল তবিয়তে আছেন। সেখানেও ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। চালাচ্ছেন ম্যানিপুলেশনের মকশোবাজি। ২০১৯ সালে নেটফ্লিক্স থেকে অস্কারবিজয়ী এভা অর্নার এর ডকুমেন্টারি "Bikram; Yogi, Guru, Predator" রিলিজ করার পরে তাকে নিয়ে আলোচনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাছাড়া তার কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায়, তিনি শিক্ষার্থীদের "বি*, চিকেন শি*" বলে গালিগালাজ করছেন ক্রমাগত। একজন স্পিরিচুয়াল লিডার এরকম ভাষায় কথা বলতে পারেন কী না, সে নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে। মিডিয়ার অনুসন্ধানে হুট করে হারিয়ে যাওয়া এই "ভন্ডসাধু" আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন।
আচার্য রাজনীশ- সেক্স গুরু, ড্রাগ ডিলার, ইমিগ্রেশন ফ্রড
এই ভদ্রলোকের অনেক নাম। কেউ ডাকেন আচার্য রাজনীশ, কেউ ডাকেন ভগবান শ্রী রাজনীশ, কেউ ডাকেন চন্দ্র মোহন জৈন, আবার কেউ ডাকেন ওশো। জন্ম ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাইজেন এ। আচার্য রাজনীশ তার আবিষ্কৃত "রাজনীশ মুভমেন্ট" এর জন্যে বেশ আলোচিত এবং সমালোচিতও। বিতর্কিত এই মুভমেন্ট শুরু হয় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস সহ বিভিন্ন দেশে। এবং এই আন্দোলন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় প্রথম আমেরিকাতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তীতে এই মুভমেন্টকে ব্যান করে দেয়।
আচার্য রাজনীশ ভারতবর্ষে বিতর্কিত হন প্রথম ১৯৬০ সালের দিকে। দেশের বিভিন্নপ্রান্তে ঘুরে ঘুরে তিনি "সোশ্যালিজম" এর বিরোধিতা করছিলেন। নিন্দা করছিলেন মহাত্মা গান্ধীরও। ভারতীয়রা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। ফলে, তাকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়। তাছাড়া তিনি "যৌন সম্পর্ক" এর ক্ষেত্রে আরেকটু খোলামেলা আচরণ করতে বলেন সবাইকে। বিতর্ক আরো বেড়ে যায়। তখন থেকে তাকে ট্রল করে ডাকা হয় "সেক্স গুরু" নামে।
যদিও তিনি দমে যাননি। বরং আস্তে আস্তে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও তিনি তার শেকড় বিস্তৃত করেন। ১৯৮০ সালের দিকে আমেরিকার অরিগনে তিনি তার সমর্থকগোষ্ঠীকে নিয়ে আশ্রম খোলেন। ৬৪০০০ একরের এরিয়াকে নাম দেন "রাজনীশপুরাম।" এবং তার একচেটিয়া সাম্রাজ্রের শুরু সেখান থেকেই। সমর্থকগোষ্ঠীকে নিয়ে ফ্যানাটিক কাজকর্ম, আধ্যাত্মিকতার নামে উগ্রতা, উদার যৌনতার নামে যথেচ্ছাচার ... সবই চলে সেখানে। রাজনীশপুরামের পুরো এলাকাই তিনি 'বাগড" করে রাখতেন, যাতে তার চোখের আড়ালে কোনো ঘটনা ঘটতে না পারে। নিজের সমর্থকগোষ্ঠীকে নিয়মিত ম্যানিপুলেট করতেন। অনেকটা "হারেমখানা"র মত করে গড়ে তোলা ইউটোপিয়ান এই রাজনীশপুরামে "উদার যৌন আচরন" এর নামে আচার্য রাজনীশ বেশ কিছু মহিলার সাথে নিয়মিত ঘনিষ্ঠ শারিরীক সম্পর্কও বজায় রাখতেন। তাছাড়া রাজনীশের সমর্থকগোষ্ঠী ছিলো খুবই বর্বর-রকমের। রাজনীশের ভক্ত-সমর্থকেরা এতটাই সহিংস ছিলো, অরিগনের স্থানীয় মানুষদের সাথেও তাদের হাতাহাতি হয় বেশ কবার।
আচার্য রাজনীশকে নিয়ে জোরেসোরে গবেষণা শুরু হয় তখন। একজন স্পিরিচুয়াল লিডারের কেন ৮০টা রোলস রয়েস থাকবে এবং মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার থাকবে, কেন বিশাল একটা এলাকাজুড়ে সাম্রাজ্য ফেঁদে বসবেন, কেন তার সমর্থকগোষ্ঠী উন্মাদের মত আচরণ করবে... এটা অনেককেই অবাক করে। কেঁচো খুড়তে শুরু করে সাংবাদিকেরা। আস্তে আস্তে আসতে থাকে বিস্ফোরক সব তথ্য। ভোট কারচুপি, মাদক ব্যবসা, আদম ব্যবসা... অনেক কিছুর সাথেই পাওয়া যায় এই ব্যক্তির নাম। জানা যায়, তিনি তীব্র মাদকাসক্তও ছিলেন। বিভিন্ন রকমের মাদক, বিশেষ করে ভ্যালিয়াম এবং নাইট্রাস অক্সাউড তিনি নিয়মিতভাবে ব্যবহার করতেন। এবং তার ভক্ত-সমর্থকদেরকে মধ্যেও কৌশলে এই ড্রাগগুলো তিনি ছড়িয়ে দিতেন।
এই অভিযোগগুলোর উন্মাতাল পালে হাওয়া দেন তার একসময়ের ব্যক্তিগত সহকারী মা আনন্দ শীলা। তিনি মারাত্মক মারাত্মক সব অভিযোগ আনেন রাজনীশের বিরুদ্ধে। জানা যায়-রাজনীশপুরামে অস্ত্র মজুদ থাকতো সবসময়ে। পয়েন্ট থ্রি ফিফটি সেভেন ম্যাগনাম রিভলবার থেকে অটোমেটিক মেশিনগান, টিয়ার গ্যাস, গ্রেনেড সবই মজুদ থাকতো সেখানে। নির্বাচনের ভোট কারচুপি করার জন্য আশ্রয়হীন লোকদের নিজের এই সাম্রাজ্যে রাখতেন রাজনীশ। আদম ব্যবসার কাজকর্মও এখান থেকে অপারেট হতো। তাছাড়া ডালাসের একটা কোর্টহাউজকে এ্যারোপ্লেন থেকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও করছিলেন এই আধ্যাত্মিক গুরু। যদিও তা সফল হয়নি। তাছাড়া আরেকটি কারনে বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে রাজনীশপুরাম এবং রাজনীশ। সেটা হচ্ছে, আমেরিকার "অভিবাসন আইন" এড়ানোর জন্যে রাজনীশপুরামে ৪০০টিরও বেশি "শ্যাম ম্যারেজ" বা "ভুয়া বিয়ে"র আয়োজন করা হয়। যেটাকে ধরা হয় আমেরিকার সবচেয়ে বড় "বিয়ে নিয়ে জোচ্চুরি"র ঘটনা। রাজনীশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগটা খুবই মারাত্নক ছিলো। আমেরিকান সরকার এই ঘটনার পরেই মূলত নড়েচড়ে বসে।
এরপর তাকে আর আমেরিকায় থাকতে দেয়া হয়না। ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতে, ১৯৮৫ সালে। পুনে তে তিনি তার এই স্পিরিচুয়াল জার্নি কন্টিনিউ করেছিলেন। তবে বেশিদিন পারেননি। ১৯৯০ সালে তিনি মারা যান। রেখে যান একশোটিরও বেশি সেন্টার, ৬০টিরও বেশি দেশে।
আচার্য রাজনীশ আর তার কেচ্ছাকাহিনী নিয়ে ম্যাকলেইন ওয়ে এবং চ্যাপম্যান ওয়ে একটা ডকু বানায় "Wild Wild Country" নামে। নেটফ্লিক্স সেটি ২০১৮ সালে রিলিজ করে। আগ্রহীরা দেখতে পারেন। আচার্য রাজনীশের অনেক বিতর্কিত বিষয় খোলাসা করা হয়েছে সেখানে।
মহাঋষি মহেশ যোগী- ফাউন্ডার অব "ওয়ার্ল্ড'স রিচেস্ট কাল্ট"
মহাঋষি মহেশ যোগীর আসল নাম মহেশ প্রসাদ ভার্মা। জন্ম মধ্যপ্রদেশে। ছাত্রজীবনের শুরুতে তিনি পড়াশোনা শুরু করেছিলেন পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে। এরপরই হুট করে সব ছেড়েছুড়ে বৈদিক আধ্যাত্মিক বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর দুই বছর পড়ে থাকেন হিমালয়ে, ধ্যান করেন। সেখানে তিনি একটা নতুন স্পিরিচুয়াল কনসেপ্টের সন্ধান পান। যার নাম Transcendental Meditation Movement, যেটা তাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এই মুভমেন্ট প্রথম শুরু হয় ভারতে, ১৯৫০ এর দিকে। এরপর তা ছড়িয়ে পরে সারা পৃথিবীতে। বর্তমানে ৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আছে এই মুভমেন্টে। এবং এটার মাধ্যমেই মূলত মহেশ যোগী দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও তার গণ্ডি বিস্তৃত করেন। এই বিষয়টি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে যায়, ভারত থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতেও এই Transcendental Meditation কে স্থান দেয়া হয়। টাকাপয়সাও আসতে থাকে খোলামকুচির মতন। "মহাঋষি মহেশ যোগী" শুরু করেন তার অবাধ ব্যবসা।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। পরবর্তীতে তিনি আবার আলোচনায় আসেন যখন বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলস তার কাছে লেকচার নিতে আসে। জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী প্যাটির প্ররোচনাতেই মূলত "বিটলস" এই লেকচারে আসে। যেটা সেসময়ে গনমাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। মহেশ যোশী ইন্টারন্যাশনালি বেশ কিছু ফুটেজ পান, এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই হুট করে মুদ্রার উল্টোপিঠে মানুষ আবিষ্কার করে এক অন্য মহেশ যোগীকে। আস্তে আস্তে বেশ কিছু মানুষজন যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনতে থাকে তার বিরুদ্ধে। ক্রমাগতই অভিযোগ গুলো বাড়ছিলো। ১৯৮৭ সালে তার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর এক অভিযোগ আসে। "টেলিগ্রাফ" সংবাদ করে যে, মহেশ যোগীর কোলকাতার এক আশ্রমে মানুষকে "গিনিপিগ" হিসেবে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টে ব্যবহার করা হচ্ছে। এবং এরকমই এক এক্সপেরিমেন্টের সময়ে পাঁচটি ছেলে মারা গিয়েছে।
এই ঘটনা বেশ শোরগোল তোলে সে সময়ে। পাশাপাশি তার "যৌন নির্যাতক" হিসেবে পরিচয়ও ক্রমশই উজ্জ্বল হচ্ছিলো। তবে সেগুলো খুব একটা আলোড়ন তুলছিলোনা। আলোড়ন আসে, যখন জানা যায়, তিনি আমেরিকান অভিনেত্রী এবং ফ্যাশন মডেল "মিয়া ফ্যারো"র সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীতে বিটলস ব্যান্ডের সদস্য এবং বিখ্যাত গায়ক "জন লেনন"ও বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন। এবং মহেশ যোশী যে তাকেও হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন, সেটাও বলেন।
যদিও এসব ঘটনা মহর্ষির বিজনেস এবং পপুলারিটি'তে কোনো প্রভাব ফেলছিলো না। ভক্তসংখ্যা ক্রমশই বাড়ছিলো। ১৯৭৫ সালে টাইমস ম্যাগাজিনের কাভার ফটোতেও চলে আসেন এই স্পিরিচুয়াল লিডার। বিলাসবহুল জীবনযাপন, ব্যক্তিগত গাড়ি, গোলাপি হেলিকপ্টার দুইশো রুমের ম্যানশন আর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে তিনি ছিলেন ধনীদেরও ধনী। স্পিরিচুয়াল লিডারদের আইডল এবং আইকন। তিনি যখন মারা যান তখনও তার ব্যাঙ্ক একাউন্টে রয়ে যায় ২ বিলিয়নেরও বেশি ডলার। তার এই Transcendental Meditation Movement কে ডাকা হয় "World's Richest Cult" নামে। নেদারল্যান্ডসে মারা যান এই বিতর্কিত আধ্যাত্মিক গুরু।
মানুষ মানসিকভাবে খুবই অসহায় প্রানী। অনেকেই উপরে উপরে হয়তো শক্ত আবরণের ভেক ধরে থাকেন, শক্ত বর্মের আড়ালে আগলে রাখেন নিজেদের। কিন্তু ভেতরের দুর্বল, বিপর্যস্ত, নাজুক অন্তরাত্মা নিয়ে ক্রমশই যুঝতে থাকেন তারা। এবং তাদের এই বিপর্যস্ত অন্দরমহলে ঢোকা যায় বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন পদ্ধতিতে। বিভিন্ন আধ্যাত্মিক গুরু এই কাজটিই করেন। ব্যতিক্রম নন বিক্রম, রাজনীশ অথবা মহেশ যোশীও। মানুষ যখন যাপিত জীবনের গ্লানিকে মুছতে আসেন তাদের কাছে, তারা তখন মুখে ভালো মানুষের ভেক ধরে তাদের গ্রহন করেন, ভরসা দেন, এরপর শোষণ করেন, নিজেদের আখের গোছান। আর ঐ মানুষগুলো আরো দুর্বল হতে থাকে নিয়মিত বিরতিতে। নিঃশেষে বিভাজ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত জীবন তাদের কাছে হয়ে যায় অসহনীয় এক যাত্রা। এভাবেই চলতে থাকে শোষণের বিভিন্ন সিস্টেম। বাড়তে থাকে আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন লেয়ার। মানুষের "ভরসা" করার জায়গাগুলো ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে। প্রকট হয়ে আসে Soudiere এর গাওয়া ঐ গানটাই- Everything is business!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন