তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জন ম্যাগুফুলিকে আপনি যদি এখনো না চিনে থাকেন, সেটি আপনার ব্যর্থতা। 'হীরক রাজার দেশে'র অত্যাচারী রাজা, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং 'দ্য ডিক্টেটর' এর জেনারেল আলাদিনের মিলিত চরিত্র যেন এই প্রেসিডেন্ট। নির্বাচিত হওয়ার পর যিনি 'একঘরে' করে রেখেছেন পুরো তানজানিয়াকেই। নিচ্ছেন একেক পর এক ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পুরাতন ভৃত্য' কবিতার একটা লাইন আমার খুব প্রিয়-

যা-কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, “কেষ্ট বেটাই চোর

আমাদেরই সেই একই অবস্থা। 'আধপাগলা রাষ্ট্রপতি'র উদাহরণ দিতে গেলে আমরা বরাবরই আঙ্গুল তুলি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে।  লোকটি আপত্তিকর কিছু করলেই হাসির তোড়ে ভাসিয়ে দেই তাকে। অথচ এই লোকটির চেয়েও এক কাঠি সরেস 'আধপাগলা রাষ্ট্রপতি' জন ম্যাগুফুলি। তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট তিনি। নানাসময়ে দেয়া নানারকম সিদ্ধান্তের কারণে তিনি বেশ সমালোচিতও হন মাঝেমধ্যে।

তবে শুরু থেকেই যে এরকম পাগলাটে ছিলেন তিনি, এরকম না। ২০১৫ সালে তিনি যখন প্রথমবারের মতন তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট হন, শুরুর দিকে তার ভালো কাজের জন্যে সবাই তার বেশ ভূয়সী প্রশংসাই করেছিলো। দেশটির স্বাধীনতা দিবস উদযাপন বাতিল করেন প্রথমবারের মতন এবং সেই টাকা দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালান তিনি।  এছাড়াও সরকারি চাকরিজীবীদের দুর্নীতি রোধেও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন তিনি।

মানুষজন বেশ প্রশংসা করেছিলেন তার এ কার্যক্রমের। তবে আস্তে আস্তে বোঝা যায়, জন ম্যাগুফুলি কী জিনিস। ভালো মানুষের ভেকধারী ম্যাগুফুলির স্বরূপও ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে জনগনের সামনে। হুট করেই রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে সংসদীয় অধিবেশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাও ক্ষমতা পাওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যেই। সে কারণে তিনি প্রবল সমালোচনার মুখেও পড়েন সে সময়। তবে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে নিজের সিদ্ধান্তেই তিনি ছিলেন অটল। ম্যাগুফুলির এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিরোধী দল পরবর্তীতে আন্দোলন শুরু করেছিলো। বিরোধীদলের সেই আন্দোলনকেও নিষিদ্ধ করে দেন তিনি।

হীরক রাজা'র মত অত্যাচারী হওয়া শুরু তখন থেকেই। স্কুলপড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থী গর্ভবতী হলে, সন্তান জন্মদানের পর সে আবার  শিক্ষাজীবন শুরু করতে পারবে না, এরকম সিদ্ধান্তও নেয় তার প্রশাসন। কোনো নাগরিক রাষ্ট্রীয় নথিপত্রের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করলে বা গোয়েন্দাগিরি করতে গেলে, সেখানেও শাস্তির বিধান রেখে আইন জারি করা হয়। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে একটুখানি কুৎসারটনা করলেও শাস্তির বিধান রাখা হয় তানজানিয়ায়।

বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের মাঝেমধ্যেই নিপীড়ন করেন তিনি। মেরেধরে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে রাখেন। পুলিশকে এসব বিষয়ে তদন্তও করতেও মানা করে দেন তিনি। গনমাধ্যমকে চুপ করিয়ে রেখেছেন। 'টু' শব্দ করতে দিচ্ছেন না সাধারণ মানুষকেও। কেউ সরকারের বিপক্ষে একটুখানি কথা বললেই নেমে আসছে দমন, নিপীড়ন, নির্যাতন।

ভিন্নমতকে একদমই পছন্দ করেন না তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জন ম্যাগুফুলি!

মহামারী করোনাভাইরাসের সময়েও তিনি নিয়েছিলেন ভয়ঙ্কর সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ। তানজানিয়ায় করোনার প্রকোপ দেখা দেয় মার্চের মাঝামাঝি। সে সময়ে মানুষকে ঘরে না থেকে গির্জা ও মসজিদে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, 'করোনাভাইরাস' একটি শয়তান। ধর্মীয় উপাসনা করেই একে প্রতিহত করতে হবে। তাছাড়া সামাজিক দূরত্ব মানা ও মাস্ক পড়াকেও তিনি দেখেন গর্হিত কাজ হিসেবে। প্রথমদিকে অফিস-আদালত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিছুই বন্ধ করছিলেন না তিনি। তার ইচ্ছে ছিলো, আফ্রিকান অন্য দেশগুলো লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে তানজানিয়ার দ্বারস্থ হবে। এ কারণেই খোলা রেখেছিলেন সব। গোপন করেছিলেন মহামারী সংক্রান্ত অনেক নথিপত্রও। চাপের মুখে পরবর্তীতে অফিস-আদালত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেও জুন মাসেই আবার সব খুলে দেন। বলেন- সব ঠিক আছে। কোনো করোনা রোগী নেই দেশে। প্রকাশ করেন নি কোনো কাগজপত্রও।

বেশ কিছু বছর আগে ল্যারি চার্লসের বিখ্যাত সিনেমা 'দ্য ডিক্টেটর' দেখেছিলাম। সে সিনেমার কল্পিত স্বৈরশাসক 'জেনারেল আলাদিন' এর সাথে খুব বেশি পার্থক্য নেই তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জন ম্যাগুফুলির। এবারে দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্যে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। তবে কেউ তার বিপক্ষে দাঁড়াতেও ভয় পাচ্ছেন এখন। তাছাড়া এই স্বৈরশাসক আবার নির্বাচিত হলে তানজানিয়ার অবস্থা যে কোনদিকে দাঁড়াবে, সেটাই এখন অনেকের কৌতূহলের ও আশঙ্কার বিষয়।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা