ছেলেদের সবার পরনে একই ডিজাইনের পাঞ্জাবী, মালিক শ্রমিকের ভেদাভেদ নেই কোথাও। কণের পরনে যে ডিজাইনের শাড়ি, সেই একই ডিজাইনের, একই মানের শাড়ি পরেছেন কারখানার নারী কর্মীরাও।
যন্ত্রপাতির আওয়াজে যে জায়গাটা প্রতিদিন গমগম করে, প্রায় দেড় হাজার কর্মচারীর পদভারে যে কারখানা মুখরিত হয়ে থাকে সারাদিন, সেই কারখানা গতকাল সেজেছিল অন্য এক রূপে। ছুটির দিনে নীরবতায় ঢেকে থাকার কথা ছিল কারখানার চত্বর, সেখানে গতকাল ছিল উৎসবমুখর ভাব, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বলে কথা! যে অনুষ্ঠানটা ছড়িয়েছে সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্যের অন্যরকম এক সৌন্দর্য্য, ভালোবাসা আর মায়ার বাঁধনে বেঁধেছে ধনী-গরীবকে, মালিক-শ্রমিককে।
চট্টগ্রামের বিয়ের অনুষ্ঠানের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দুটোই আছে। সেখানকার আতিথেয়তার প্রশংসা যেমন করা হয়, তেমনই যৌতুক প্রথা বা অতিরিক্ত দেনমোহরের ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনাও হয়। সেই চট্টগ্রামেই এবার অন্যরকম এক বিয়ের নজির দেখলো দেশের মানুষ, নিজের কারখানার দেড় হাজার শ্রমিককে নিয়ে মেয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করেছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাপারেলসের মালিক আবু তৈয়ব। কয়েক ঘন্টার জন্যে কারখানাটি পরিণত হয়েছিল কমিউনিটি সেন্টারে। সুই-সুতা তুলে রেখে সবাই মেতেছিলেন গায়েহলুদ অনুষ্ঠানে।
নাসিরাবাদের সেই গার্মেন্টস কারখানায় গতকাল দেখার মতো দৃশ্যের অবতারণাই হয়েছিল। ছেলেদের সবার পরনে একই ডিজাইনের পাঞ্জাবী, মালিক শ্রমিকের ভেদাভেদ নেই কোথাও। কণের পরনে যে ডিজাইনের শাড়ি, সেই একই ডিজাইনের, একই মানের শাড়ি পরেছেন কারখানার নারী কর্মীরাও। কারখানার সব নারী শ্রমিককেই আবু তৈয়ব দিয়েছেন হলুদ শাড়ি। যে শাড়িটি তিনি নিজের স্ত্রী ও স্বজনদের জন্য কিনেছেন, ঠিক একই শাড়ি কিনেছেন কারখানার নারী কর্মীদের জন্য। পুত্রসহ নিজে গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে যে পাঞ্জাবি পরেছেন, ঠিক একই পাঞ্জাবি দিয়েছেন গার্মেন্টসের পুরুষ শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের।
খাবারের বেলাতেও ছিল না আয়োজনের কমতি। স্পেশাল বা রিজার্ভ আইটেম বলে কিছু ছিল না, একই মেন্যুর রান্নার আয়োজন ছিল সবার জন্যে, একই পাতিলে হয়েছে সব অতিথির রান্না। একই খাবার খেয়েছেন সবাই। তারা নিজেরাই তদারক করেছেন সবকিছুর, নিজেদের বোনের বিয়ে হচ্ছে- এমনটাই ছিল তাদের আচরণ। এক এক করে প্রীতিকে হলুদের রঙে রাঙিয়েছেন তারা, তাকে ঘিরে নেচেছেন, গেয়েছেন, ভাগাভাগি করে নিয়েছেন প্রীতির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করার আনন্দটাকে।
কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল গতকাল, ছাদের ওপরে সামিয়ানা টানিয়ে সেখানে বানানো হয়েছে গায়ে হলুদের মঞ্চ। নাচ হয়েছে, গান হয়েছে, 'হলুদ বাটো মেন্দি বাটো' গানের তালে তালে কোমর দুলিয়েছে সবাই, যোগ দিয়েছেন কণে প্রীতি এবং তার পরিবারের সদস্যরাও। একপাশে গানের আসর বসেছে, আনন্দে গলা ছেড়ে গান ধরেছেন কেউ কেউ, তাদের ঘিরে ভীড় জমিয়েছেন বাকীরা। চারপাশে উৎসবের অনাবিল আনন্দ, মানুষে মানুষে ভেদাভেদটা যেন দূর কোন গ্রহে হারিয়ে গিয়েছিল কয়েক ঘন্টার জন্যে।
মেয়ের গায়ে হলুদে একদম নিজের পরিবারের সদস্যের মতোই কর্মচারীদের আপ্যায়ন করেছেন আবু তৈয়ব, কর্মচারীরাও বিনিময়ে ভালোবাসা উজাড় দিতে কার্পন্য করেনি একটুও। সবাই মিলে আগেই চাঁদা তুলেছেন নিজেদের সাধ্যমতো, কেউ পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন, কেউ একশো, কেউবা হাজার। দামী একটা গয়নার সেট তারা তুলে দিয়েছেন প্রীতির হাতে, বোনকে কী আর খালি হাতে বিদায় দেয়া যায়? সেই উপহার পেয়ে প্রীতির চোখে জল টলমল করেছে, আপ্লুত হয়েছেন আবু তৈয়ব নিজেও।
গণ্যমান্য কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করা হয়নি অনুষ্ঠানে, এমনকি শ্রমিক-কর্মচারী আর নিজেদের পরিবারের সদস্যরা ছাড়া আর কেউই ছিলেন না সেই অনুষ্ঠানে। গায়ে হলুদের পুরো আয়োজনটাই ছিল শুধু কারখানার কর্মচারীদের জন্যে। আবু তৈয়বের কাছে তারা একটা পরিবারের মতো। সেই পরিবারের সদস্যদের নিয়েই পুরো আয়োজনটা করতে চেয়েছিলেন তারা, প্রচারণাটা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না, থাকলে শত শত গণমাধ্যমকর্মী আর হাজারটা ক্যামেরাকে তো ডেকে নেয়াই যেতো। সেটা তারা করতে চাননি।
রেস্টুরেন্টে গিয়ে বাসার কাজে সাহায্যকারী ছেলে বা মেয়েটাকে একপাশে বসিয়ে, বা তার কোলে বাচ্চা ধরিয়ে দিয়ে গোগ্রাসে খাবার গিলতে দেখেছি সারা বছর অভুক্ত থাকা কিছু অমানুষকে। গৃহকর্মীদের ওপর অকথ্য নির্যাতনের ঘটনা নিজের চোখে দেখেছি, পত্রিকার পাতায় পড়েছি। পান থেকে চুন খসলেই কর্মচারীর গায়ে হাত তুলতে দেখেছি, গালাগাল তো নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার। কারখানায় আগুন লাগার পরেও ফায়ার এক্সিট খুলে না দিয়ে তালা মেরে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করার ঘটনা ঘটেছে এই বাংলাদেশে, চাকরি খেয়ে দেয়ার হুমকি দেখিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কাজ করতে বাধ্য করার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও এই বাংলাদেশেই ঘটেছে, ঘটছে। সেই দেশের মানুষ হয়ে কর্মচারীদের প্রতি মালিক পক্ষের এমন দরদ দেখলে অবাক লাগে, বিস্ময় জাগে মনের ভেতর।
প্রীতি নামের মেয়েটার কথা একবার ভাবুন, এমন চমৎকার একটা আয়োজনের মাধ্যমে নিজের জীবনের নতুন অধ্যায়টা শুরু হচ্ছে তার, দারুণ ভাগ্যবতী এই তরুণী। চারপাশে যখন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ক্রমেই বাড়ছে, বাড়ছে অসহিষ্ণুতার পরিমাণ আর ধনী-গরীবের পার্থক্য, তখন গায়ে হলুদের এমন আয়োজনের গল্প শুনে মনুষ্যত্ব নিয়ে আবারও স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে, মানবতার গল্পগুলো জনে জনে বলে বেড়াতে ইচ্ছে করে ভীষণ। মানুষের আবেগ-অনুভূতিরা যে এখনও মরে শেষ হয়ে যায়নি, সেটারই যেন বার্তা দেয় এই ঘটনাগুলো...